মেয়েদের জীবন মানেই কি মানিয়ে চলা?

ফারহানা আফরোজ রেইনী:

দীপা বাবা মায়ের তিন মেয়ের মধ্যে ছোট। ছোট হওয়ার সুবাদে তার আদরের পরিমাণটা একটু বেশিই ছিল। শুধু মা কিংবা বাবা নয়, বড় দুই বোনের কাছ থেকে পেয়েছে সীমাহীন আদর আর অপরিসীম ভালবাসা। পরিবারের সকলের আদর অন্যদেরও বুঝিয়ে দিয়েছে ও আসলে ভালবাসারই মানুষ। তাই সকলের কাছে তার দাবি আর আব্দারের ও সীমা ছিল না। সেগুলো মেটাতে কেউই দ্বিতীয়বার কোন চিন্তা করেনি। সেখান থেকেই হয়তো ও ধরেই নিয়েছিল ওকে সব সময় সবাই ভালবাসবে; মানুষের কাছে ওর প্রত্যাশাটা বোধ হয় এখান থেকেই শুরু হয়।
স্নেহ-ভালবাসার গণ্ডি পেরিয়ে তাকে এক সময় স্বপ্নের রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। মা-বাবার আদরের “রাজকন্যা” মুখোমুখি হয় নতুন নতুন অবস্থা আর অভিজ্ঞতার। আর সাথে সাথে শুরু হয় তার প্রত্যাশা ভঙ্গের পালা।

প্রতিদিন একটু একটু করে সে উপলব্ধি করতে শিখেছে ভালবাসাহীন জীবনের রঙ কেমন হয়। এখন সে জেনে গিয়েছে তার কষ্ট বহন করার দায় শুধুই তার। তার শখ আহ্লাদ মেটানোর দায়ও তারই। দীপা নিজে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, মোটামুটি ব্যস্ত থাকে। তারপরও প্রতিদিনই তার স্বামী বাসায় ফেরার আগেই বাসায় ফেরে। প্রথম প্রথম খুব অপেক্ষা করে থাকতো বাসায় ফিরে দুইজন একসাথে চা খাবে। কিন্তু এখন দীপা বুঝে সে তার স্বামীর সাথে চা খেতে চাইলেও, তার স্বামীর মধ্যে এই ধরনের কোনো বিষয় কাজ করে না। একসাথে খাওয়া বিষয়টি দীপার জন্য এখন বেশ অস্বস্তির একটি বিষয়। অথচ ছোটবেলা থেকে সে জেনে এসেছে বাড়িতে সবাই একসাথে খেতে হয়। এখনো তাই বোন বা বাবার বাড়িতে গেলে ওই স্পর্শটুকু পায়। মা, বোন বা ভাই একজন আরেকজনের জন্য অপেক্ষা করে একসাথে খাওয়ার জন্য।

যেহেতু দীপা ও তার স্বামী দু জনেই চাকরি করে, তাই দীপা অপেক্ষা করতো সপ্তাহান্তে ছুটির দিনটার জন্য। একটু একসাথে বাইরে ঘুরতে যাবে, কিন্তু ক্রমেই সে আবিস্কার করে সে এই দিনটার জন্য যে কারণে অপেক্ষা করে তার স্বামীর সেটা দেখার বা বোঝার প্রয়োজন নেই। হয়তো ইচ্ছে করেই এই বিষয়টাকে সে পাত্তা দেয় না। তাই একই ছাদের নিচে বাস করলেও এই বাইরে যাওয়ার কথাটা বলতে খুবই অস্বস্তি বোধ করে সে। তাই তার প্রত্যাশা থেকে এই জিনিসটিও বাদ পড়েছে।

সময় এর সাথে সাথে দীপা অনেক কিছু মানিয়ে নিয়েছে। এখন সে দুই বাচ্চার মা। চাকরি আর সবার দায়িত্ব পালন করে দিনশেষে সে দেখে তার নিজের জন্য দায়িত্ব পালন করার সময় তার হাতে নেই। একবার বেশ শরীর খারাপ হলো তার। ডাক্তার দেখানো দরকার, কিন্তু সময় ও সুযোগ বের করতে পারছিল না। অনেক চেষ্টার পর একদিন ডাক্তার দেখালো। তিনি কিছু টেস্ট করতে দিলেন। আবার অপেক্ষা করতে লাগলো সময় ও সুযোগ এর। বেশ কয়েকদিন পর সেটা করতে পারলো। কিন্তু রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার জন্য চললো আরেক দফা অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত আরও দিন দশেক অপেক্ষার পর সেটি করা গিয়েছিল। আর তার এই চেষ্টার পিছনে কারও সাহায্যও পায়নি। অথচ ছোটবেলায় কী একটু গা গরম হলো না হলো অস্থির করে তুলতো বাড়ির সকলকে। কী খাবে, কী করবে পুরো হুলস্থল অবস্থা। আর এখন এক গ্লাস পানি কেউ ঢেলে দেয় না। অনেক জ্বরে অপেক্ষা করে কেউ হয়ত মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেখবে। না, তার অপেক্ষার শেষ হয় না। উঠে গিয়ে কলে হাত ভিজিয়ে নিজের মাথায় নিজেরই ঠাণ্ডা হাতটা রাখে।

দীপা তার দুই পুত্র সন্তানের দিকে তাকিয়ে ভাবে এদের হাত ধরে কোনো না কোনো ঘরের আদরের রাজকন্যারা তার ঘরে আসবে। তাহলে কি তাদের পরিণতিও তারই মতো হবে? নাহ, এমনটা সে ভাবতে চায় না। সে চায় না অপরিসীম ভালবাসা দিয়ে যাকে তিলে তিলে বড় করা হয়, সেই মেয়েটি অন্যের ঘরে এসে একটু ভালবাসা পাওয়ার জন্য হাহাকার করুক। তাই সে সব সময় কামনা করে তার সন্তান যেন ওইটুকু বিবেকবান হিসেবে বড় হয় যাতে শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক সীমাবদ্ধতার পরও যেন স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দিতে না ভুলে।

ফারহানা আফরোজ রেইনী
গবেষণাকর্মী

শেয়ার করুন: