তারপরও সংসারটা টিকে থাকে ওদের !!!

ফেরদৌস কান্তা:

কদিন ধরেই মনটা খুব পোড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে দুনিয়ায় আত্মসম্মান কি শুধু আমারই বেশি? কেন মানুষ নিজের সম্মান খুইয়ে নিজেকে মৃত মানুষের মতো হয়ে যেতে দিয়ে দিনযাপন করে?

খুব কাছের দুজন মানুষের ঘটনা বলতে চাই। যারা আমার সাথে সবসময় এই ব্যাপারগুলি নিয়ে কথা বলে, কষ্ট পায়, এবং দিনশেষে আবার সব কিছু মেনে নিয়ে পরবর্তী দিনের জন্য অপেক্ষা করে।

যাদের কথা বলতে চাই, এরা প্রত্যেকেই স্বাবলম্বী। সমাজে নিজেদের পরিচয় দেবার মতো ভালো পজিশন আছে, চাকুরি করছে এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এতো কথা অবতারণার কারণ হচ্ছে, সবসময় আমরা বলে আসছি যে, আর্থিক স্বাবলম্বিতা না থাকার কারণে সমাজে মেয়েরা কোনো সিদ্ধান্ত সহজে নিতে ভয় পায়। এটা যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল ধারণা সেটাই বলতে চাই।

ঘটনা ১

আমরা সবাই একসাথে পড়েছি। ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও ভার্সিটিতে জমজমাট বন্ধুত্ব সবার মাঝে। এভাবে কেউ কেউ সহপাঠীর সাথে তুমুল প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম বর্ষ না গড়াতেই তাদের মাঝে একটা জুটি বিয়েও করে ফেলে। আমরা কাছ থেকেই তাদের দিনরাত এক করা উদ্দোম প্রেম দেখি কখনও ভয়ে, কখনও ভালবাসায়, কখনো বা ঈর্ষাতুর চোখে। দিন গড়ায়, আমাদের পড়াশোনা শেষ হয়। সবাই যার যার জীবনের পথে ব্যস্ত। খবর পাই সবাই ভালো আছে আমার মতো।
মাঝে মাঝে দেখা হয় পুরানো বন্ধুদের সাথে, জমে উঠে আড্ডা। দেখি সবাই ভালোই আছে। এরমাঝে হঠাৎ হঠাৎ বান্ধবীর ফোন। দুঃখের কথা, কান্নাকাটি। বুক পুড়ে, দেখা করতে যাই। শুনি, তার ভালবাসার স্বামীপ্রবরটি যখন তখন যার তার সাথে প্রেমে জড়াচ্ছে। সে একটার পর একটা হাতে নাতে ধরছে। ঝগড়া করছে, স্বামী সরি বলছে, আর সে বার বার মাফ করে দিচ্ছে। এক সন্তানের জননী সে তখন।
বলেছিলাম, বার বার ক্ষমা করিস না এভাবে। কেউ দয়া করে ভুল বুঝবেন না আমাকে, সেইসময় তাকে বলেছিলাম আর বাচ্চা না নিতে, কারণ চাকুরি করেও তার স্বামী ঠিকমতো খরচ দিতো না। সে নিজেও ভাল জব করতো, তাই চলে যেত সংসার। বছর দুয়েক একই রকম কাহিনী শুনে শুনে প্রচণ্ড রাগ আর বিরক্ত লাগতো।

এরই মাঝে একদিন সে বললো, তার স্বামী বয়সে অনেক বড় এক নারীর সাথে জড়িয়ে গেছে, যার স্বামী প্রবাসী। প্রায় সেই নারীর সাথেই থাকছে এখন, সেই নারীও নানা রকম গিফট এর বন্যায় ভাসিয়ে রাখছে তার পতিদেবকে। কখনও দামি মোবাইল সেট, লেটেস্ট মডেলের হোন্ডা, টাকা পর্যন্ত। আর এসবই তার বর খুব গর্বের সাথে তাকে বলতো। সপ্তাহে এক বা দুদিনের জন্য বাসায় ফিরতো, ঝগড়া হতো খুব, তারপর শেষ হতো শারীরিক মিলনে।

আমি তাকে শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর সাথে শুতে তোর ঘৃণা করে না? তার উত্তর ছিল, আমারও কিছু শারীরিক চাহিদা আছে, আমিতো ওর মতো যার তার সাথে শুতে পারবো না, তাই ওর সাথেই শুই। আমি নির্বাক হয়ে রই কথা শুনে! আরেকজনের সাথে শুয়ে বাসায় ফিরেছে, এটা জানার পর কীভাবে সম্ভব আবার সেই বেইমানের সাথে শোয়া, সেটা সেদিনও আমার মাথায় ঢুকেনি, আজও ঢুকে না। আর শোয়ার জন্য, আমার বান্ধবী নিজেই আগ্রহী থাকতো। ততদিনে সে তিন সন্তানের জননী। তিন-তিনটা বাচ্চা নিয়ে তার চাকুরি আর বাসা মিলে, নাকানি চুবানি অবস্থা। আমি ওর কথা শুনে মাঝে মাঝে অবাক হতেও ভুলে যেতাম। ঝর ঝর করে কাঁদতো আর বলতো, কেন যে বাচ্চা নিলাম এতোগুলি, এখন না পারি পালতে না পারি ফেলতে!

নিজেই বলতো, তোরা সবাই মানা করেছিলি আর বাচ্চা না নিতে, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম বাচ্চাদের টানে ওকে ঘরে ফেরাতে পারবো। কিন্তু পারিনি, দিন দিন সে দূর থেকে দূরেই সরে গেল। বলতে ভুলে গেছি, শ্বশুরবাড়ি থেকে সে কোন সহযোগিতাই পায়নি। প্রেমের বিয়ে বলে তাকে মেনে নেয়নি আমাদের বন্ধুর ফ্যামিলি। আর তাদের ছেলের অধ:পতনের জন্য সবসময় আমাদের বান্ধবীকেই দায়ী করা হয়েছে।
কিছুদিন আগেই শুনলাম, বাণিজ্য নগরী ছেড়ে এখন সে বাচ্চাদের নিয়ে তার পৈতৃক শহরে চলে গেছে। এর আগে চলতে না পেরে ছেড়েছে রাজধানী। তার বর আমাকে, আমাদের এককালের বন্ধুত্ব ভুলে ইনবক্সে অনেক গালাগালি করেছে অকথ্য ভাষায়। আমি নাকি *** নারীবাদী সেজে তার ঘর ভাঙতে চাইছিলাম। আমি হলাম মাগী, বেশ্যা। যেহেতু আমার সংসার নাই, তাই আমি অন্যের সুখ দেখতে পারি না। এতো কথা শুনে আমি একটুও কষ্ট পাইনি। কষ্ট পেয়েছি, এই গালাগালি সে করেছে আমাকে, আমার বান্ধবীর আইডি থেকে। আহা! আমার বান্ধবী আমাকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে মাফ চায়, তার বরের আমার সাথে এই ব্যবহারের জন্য। বলে তার আইডি-পাসওয়ার্ড তার বরের কাছে। আমি না মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাই।

ঘটনা-২

এই মেয়েও আমার পরিচিত একজন। নিজে খুব ভালো চাকরি করছে। একটা বাচ্চা তাদের, স্কুলে পড়ে। তার বরও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশ উঁচু পজিশনে আছে। আপাত দৃষ্টিতে সুখের সংসার। প্রেম ভালোবাসা কোনো কিছুর কমতি নাই। শুধু সমস্যা দেখা দেয় মাঝে মাঝে। তার বরের ভীষণ রকম অন্য নারী প্রীতি রয়েছে। যখন তখন হুটহাট করে যার তার সাথে জড়িয়ে পড়ে, আবার বেশ যোগ্যতার সাথে রিলেশন শেষ করে বের হয়েও আসে। তার বরের অন্য নারী পটানোর মূল অস্ত্র হলো, বউয়ের সাথে তার রিলেশন ভালো না, এটা বলা।
মানসিক শান্তি তিনি খুঁজে বেড়ান নারী থেকে নারীতে। কোনো নারী পটে যায় ভীষণ, আবার কেউ বা কৌশলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বউ সব জানে, কিন্তু কিছুই বলে না। এই মেয়ের ভাষ্য হচ্ছে, পুরুষের এইরকম স্বভাব একটু আধটু থাকেই। মেয়েগুলি সব খারাপ, তার বরের জন্য মুখিয়ে থাকে।
যেই রিলেশনগুলি মারাত্মক আকার ধারণ করে, বউয়ের পক্ষে আর মেনে নেয়া সম্ভব হয় না, তখন সে সেই নারীদের ফোন দিয়ে, ভয়ানক গালিগালাজ করে। তার বরকে ছেড়ে দিতে বলে, এবং খুব নোংরা ভাষাতেই বরের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। আর আমাদের কাছে হাসিমুখে গল্প করে বেড়ায়, কতদূর আর যাবে, যাক! নাটাই তো আমার হাতেই। আমার কাছেই ফিরতে হবে। এভাবেই বিভিন্ন স্বাদ আর বর্ণের নারীদের সাথে সময় কাটিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কিংবা নিয়ে ফিরে আসা স্বামীটিও পরিবারের প্রতি খুব দায়িত্ববান। বউকে খুব ভালবাসে, বাচ্চাকে খুব আদর করে। আসলেই, আমি মুগ্ধ হতে হতে দেখি ওদের। এট দা এন্ড অব দ্য ডে, “রিয়েলি দে আর হ্যাপি ফ্যামিলি”।

আমার শুধু মনে হয়, কেন ওরা কঠোর হয় না? কেন স্বামীর ভুল মেনে নিয়ে আরও নোংরা পথে যেতে এগিয়ে দেয়? কেন তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না যে, ওরা মানসিকভাবে নোংরা আর অসুস্থ? কিভাবে দিনের পর দিন এইসব মেনে নেয়? টাকার সমস্যা তো নাই। সমাজের ভয়? যে সমাজ মেয়েদের শুধু ভোগের পণ্য হিসাবে দেখে, সেই সমাজের ভয়, নাকি অন্য কিছু? তাদের চোখ কিন্তু মিথ্যা বলে না। সেখানে থাকে প্রতিদিন হেরে যাবার গল্প। কেন? আমি সত্যি জানি না। তবে জানতে চাই।

শিক্ষক ও লেখক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.