শেখ তাসলিমা মুন:
নিম্নবিত্ত ধর্ষক যখন সুবিধাভোগী পেশীশক্তির বাই প্রডাক্ট। এ লেখায় হাত দেওয়া কঠিন। তবু উপায় নেই বিষয়টিকে উন্মোচনের চেষ্টা না করে। ধর্ষকাম কীভাবে কেবল একটি জেন্ডারের মগজ দখল করে রেখেছে সে আলোচনা একটি বড় আলোচনা। আর সে ধর্ষক যদি হয় নিম্নবিত্ত, অশিক্ষিত, বঞ্চিত শ্রেণির, তাহলে সে সমস্যা হয়ে ওঠে আরও জটিল। কোনটা রেখে কোনটা আগে, সেটি নির্ণয়ই কঠিন হয়ে যায়।
আমি দেখি ধর্ষকাম একটি শক্তির উন্নাসিকতা হিসেবে। ‘বাহুবলী’দের জয় জয়কারের আরেক নাম ধর্ষণ। এ কারণেই আমরা একটি জেন্ডারের ভেতর এটি মহামারী হিসেবে দেখি। একথা সত্য নয় যে, সেক্সুয়াল ডিজায়ার কেবল একটি জেন্ডারের ভেতর প্রকট এবং অন্য জেন্ডারের সেক্সুয়াল ডিজায়ার কম। কিন্তু পুরুষই কেন তবে ধর্ষণ নামক এ অপরাধটিকে সকল ক্ষেত্রে পরিচালিত করছে? কারণ ধর্ষণ ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত, যৌন আকাঙ্ক্ষার সাথে নয়। সর্বক্ষেত্রে ক্ষমতা ও পরাক্রমশালিতার যে চর্চা, তার আরেকটি ভয়ানক রূপ এ ধর্ষণ।
পৃথিবীটা এখনও পেশীশক্তির কাছে পদানত। এর যে সহিংস রূপ আমরা দেখি, তার সাথে যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, অর্থনৈতিক শোষণ, ধর্মের দৌরাত্ম্য, প্রথমবিশ্ব- তৃতীয়বিশ্ব সৃষ্টি অনেক বিষয় জড়িত। এর প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, মারণাস্ত্রের অধিকারী। এ শক্তিবলে তারা পদানত করে রাখে পৃথিবীর আরেক জনগোষ্ঠীকে। এ শক্তির খেলা চলছে বিভিন্ন ফর্মে। এক একটি যুগ শেষ হচ্ছে, শক্তির খেলার রূপ বলাচ্ছে, কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে না শোষণ এবং শক্তির সহিংসতা।
ব্রিটিশ রাজ্যে আগে সূর্য অস্ত যেতো না। আজ ইমপেরিয়ালিজম নতুন রূপে এসেছে। ট্রেড আর পারমানবিক শক্তির খেল চলছে পৃথিবীর পেশী শক্তিগুলোর ভেতর। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সুবিধার জোর দখল পেতে এ শক্তিগুলো পাশবিক হয়ে উঠেছে। একের পর এক জনপদ সভ্যতা রাষ্ট্র জাতি ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের ছুপা রূপ তারা গোপন করে রাখতে পারছে না। আর সেই সুযোগে আরও দানব শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। যার উদাহরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘ধনী সাদা তেল লোভী লুটেরাদের’র বিরুদ্ধে অন্ধকার সময়ের আইএস এর উত্থান। আইএস সে অর্থে ইম্পেরিয়ালিজমেরই বাই প্রডাক্ট।
এ শক্তির খেলা এখনও প্রকটভাবে পরাক্রম পুরুষশক্তির হাতে। ‘সেই প্রভাবে সহস্র বছর ধরে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় মানস। গড়ে উঠেছে সমাজের মানস।’ এ শক্তির নির্যাসে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো। শিক্ষা ব্যবস্থা। উপসনালয়, ধর্ম, আইন-আদালত, পঞ্চায়েত। এটার মূল শক্তি পেশী শক্তি, যা কাঠামোগত ক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে শক্তিশালী। এ ক্ষমতা চর্চা এমন একটি সুবিধাবাদের উপর দাঁড়িয়ে, যার সুবিধায় সুবিধাপুষ্ট পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র। পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে। এ সিস্টেমটিকে উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত এই পরাক্রমশালি ক্ষমতা চর্চা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
সকল সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দু। এবং এ ক্ষমতাই নারীর উপর সহিংসতার কারণ।
কীভাবে একটি নিম্ন শ্রেণীর, সুবিধাবঞ্চিত, বঞ্চিত শ্রেণি হয়েও ‘পেশী শক্তির’ অধিকারী হয়ে নারীর প্রতি সহিংস হয়ে ওঠে?
শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে আমরা দেখেছি শ্রমিক বঞ্চনার এক উপাখ্যান। তাদের গতরের সকল শক্তি নিংড়ে নিয়ে শিল্প ও পুঁজির বিকাশ। ধনিক শ্রেণির উত্থান। ইংল্যান্ডে, ইউরোপ বা জারের সময়ের সোভিয়েত শ্রমিকদের জীবন। সারা সপ্তাহ দিন রাত পরিশ্রম। সাপ্তাহিক ন্যুনতম পারিশ্রমিক হাতে নিয়ে শুঁড়িখানায় রাতভর মদ খাওয়া, মারামারি, টেবিল চেয়ার ভাঙা, জরিমানা, যৌনকর্মীকে পারিশ্রমিক দিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফেরা। বাড়িতে ক্ষুধার্ত পরিবার। ভাড়া বাকি। এ সুবিধাবঞ্চিত মাতাল পুরুষটির শিকার তার থেকেও দুর্বল তার ‘নারী’। তার উপরই সে নিতে পারে তার উপর হওয়া সকল বঞ্চনার প্রতিশোধ। তার হিংস্রতার শিকার হয়ে ওঠে নারী। নিত্য অনাহার, নিত্য প্রহার, নিত্য ধর্ষণে শেষ হয় রাতের শেষ প্রহর।
সুবিধাবঞ্চিত জীবনের ফ্রাস্ট্রেশন যৌন সন্ত্রাসে পরিণত হয়ে টিকিয়ে রাখে পেশীশক্তির খেলা, পেশী ক্ষমতার বাহাদুরি। খুব কমজোর পুরুষও তার পৌরুষত্ব জাহিরে সে তার লিঙ্গকে অবলম্বন করে। এখানে যৌন সম্পর্ক নয়, লিঙ্গ শক্তির শক্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। সে শক্তি দিয়ে সে নারীকে দুর্বল ভাবে। নিজেকে ক্ষমতাধর মনে করে। একজন সুবিধাবঞ্চিত পুরুষকে ধর্ষক হিসেবে গড়তে সেজন্য সুবিধাভোগী পুরুষের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে সবচাইতে বেশি। যতদিন সে ক্ষমতার অস্ত্রগুলো তারা জমা না দেবে, সে অস্ত্রগুলো কেড়ে না নেওয়া হবে, ততদিন এ ক্ষমতার প্রতাপ তারা দেখিয়েই চলবে। সেখানে প্রথম বিশ্বের সুবিধাভোগী পুরুষ এবং তাদের তৈরি সুবিধাবঞ্চিত পুরুষ, উভয়ই নারীর উপর এ সহিংসতায় তার লিঙ্গকে ব্যবহার করবে।
রূপার ধর্ষকরা ছিল বাসের শ্রমিক। রূপা ছিল এক শিক্ষিত তরুণী। জ্ঞানে-মানে-আচারে-আচরণে সে ছিল এ পুরুষগুলো থেকে অনেক উপরের। এখানে তাঁর শ্রেণি অবস্থান কোন ‘সুবিধা’ হিসেবে তাঁর পক্ষে কাজ করেনি। তার কারণ কী? তার কারণ সে নারী। নারীকে দুর্বলভাবে অবস্থায়িত করারই জন্য সে শ্রমিকের কাছেও পরাধীন শক্তিহীন বলে পরিগণিত। আর সে পুরুষগুলো রূপার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের ‘লিঙ্গ’ ক্ষমতা বলে।
বাংলাদেশের একটি বাসে যারা কাজ করে তাদের বেড়ে ওঠা আমি ভাবতে পারি। তারা জন্মায় কঠিন পরিস্থিতিতে। বড় না, তারা বেড়ে ওঠে। জীবনের পদে পদে থাকে সে জীবনে বঞ্চনা, অসহায় যুদ্ধ, অপমান, লাঞ্ছনা, অক্ষমতার এক বিশাল ঝোলা। অ্যাগ্রেশন যাদের জীবন সঙ্গী। জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া যাদের জীবনের অভ্যেস। স্নেহ মমতা ভালবাসা দূরের কথা, একটি ভাল বাক্য বিনিময় যাদের জীবন থেকে বহুদূরে। তাদের অ্যাগ্রেশন মারধর বিনোদনে পরিণত, এবং যৌনতা কিভাবে সহিংসতার বিনোদনে পরিণত হয় সে গবেষণা অবশ্যই সোশিও-মনস্তাত্বিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি কেবল বলবো, তার শিকার যাতে রূপাদের নিয়ত না হতে হয়, তার জন্য আমরা কি কিছু করছি?
পরিবার থেকে, বিদ্যালয় থেকে, চৌরাস্তা থেকে আমাদের ছেলেরা পুরুষ শিশু হবার সুবিধাভোগ এবং তার পুরুষ হবার গুণগাঁথা শুনে বড় হয়ে ওঠে। অন্যায় করে শাস্তি না পাবার নজির দেখে উপভোগ করে বড় হয়। যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা না পেয়ে বড় হয়ে ওঠে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের উদ্ভাবিত স্বভাবগুলো অসমাধিত, অকর্ষিত থেকে যায়। নিজের শরীরের বিষয়গুলো কীভাবে এক সময় এগ্রেশনের বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে, সে নিজেই কি সেটা জানে?
প্রতিটি উত্তর না পাওয়া, অসমাধিত শরীরের ও মনের অধ্যায়গুলো সামাজিক ন্যায়বিচারহীনতার সাথে মিশে অনাচার হয়ে ওঠে। অপরাধ হয়ে ওঠে। আর তা বপন করে রাখে সুবিধাবাদী সুবিধাভোগী শ্রেণী। তারাই মূল কারিগর। সেই কারিগরের নকশায় সুবিধাবঞ্চিত এক দঙ্গল বাস শ্রমিক রূপার দেহটি শকুনের মতো ব্যবচ্ছেদ করে নির্বিকার ঘাড় মটকে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায়। বিবেকবান হবার মতো যতটুকুন সুস্থ জীবন দরকার হয়, তারা সে জীবনের অধিকারী কোনকালে হতে পারেনি। তাদের এগ্রেশন তাদের লিঙ্গ নামক একটি ক্ষমতায় পরিণত হয়। যে লিঙ্গ বলে তাদের মতো সুবিধাবঞ্চিত শক্তিহীনরাও শক্তিহীন দেখতে সক্ষম হয় একজন নারীকে! হোক সে একজন শিক্ষিত, সক্ষম নারী, বা তাদেরই গোত্রের আরেক শ্রমিক নারী।
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭
স্টকহোম, সুইডেন