শিল্পী জলি:
‘পরকীয়া মানেই ডিভোর্স নয়’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম যেনো লোকে হুজুগে ডিভোর্স করে ইউটার্ন মেরে আবার আনডু করতে না ছোটে। তখন বেশ কয়েকজন ফেবু বন্ধু (অপরিচিত) তাহসান-মিথিলা জুটির উদাহরণ টেনে এনে বোঝালেন কতো সুন্দর জুটি তারা, কোনো পরকীয়া-ফরকিয়ায় না জড়িয়ে কতো সুন্দরভাবে ডিভোর্স করেছেন–জীবনে ওদের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকায় ইউটিউব ঘেঁটে জানলাম মিথিলা বলেছেন, ঘর কে ছাড়তে চায় বলুন, তবুও ছাড়তে হলো–দেখলাম আমরা দু’জন দু-টাইপের মানুষ, স্বপ্নও আলাদা…।
এই কথা শুনেও ভক্তরা বলছেন, মারহাবা মারহাব…কতো সুন্দর কথা!
ওদিকে মিথিলার কথায় বুঝলাম, ছাড়াছাড়ি হলেও ছাড়াছাড়ির ইচ্ছে তার ছিল না। তাহসানও মিথিলা সম্পর্কে বিরূপ কিছু বলেননি। ইউটিউবের কয়েকটি ভিডিও থেকে জানা গেল, তাহসান যখন তখন তার মহিলা কো-আর্টিস্টদের সাথে লং ড্রাইভে চলে যেতেন, সে কারণেই নাকি প্রথমে সেপারেশন এবং পরে ডিভোর্সে গড়ায়। তবে কেউই কিছুই বলেননি সরাসরি, হয়তোবা সামাজিক এবং ক্যারিয়ারের বিষয়াদি বিবেচনা করে।
আপাত দৃষ্টিতে ভদ্রতা বজায় রেখে এমন নীরব ডিভোর্সের বিষয়টিকে ভালোই মনে করা হয় আমাদের সমাজে। তবে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করলে সময়ে এর অর্থ অন্য রকমও হতে পারে। অনেক সময়ই বাচ্চাসহ ডিভোর্সে দেখা যায় যে, ডিভোর্সের পরবর্তীতে বাচ্চা দেয়া-নেয়া করতে করতে প্রাক্তনরা নিজেরাও গোপন দেয়া-নেয়া ঘটিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে তখনই, যখন এদের মাঝের একজন আরেকটি বন্ধনে আবদ্ধ হন। কেননা মানব চরিত্র বড় জটিল। তাই মাঝে দেয়াল তুলে নিয়ে ঊঁকি দিতেই দেখা যায় বেশি।
এমনও দম্পতি দেখেছি যারা বিবাহিত জীবনে মেরে হাড্ডিমাংস লাল করায় পুলিশ ডেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, অথচ ডিভোর্স হতেই ‘লাভ ইউ লাভ ইউ’ আর ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা বিতরণের শুরু।। হয়তো মালিকানা হাতছাড়া হলেই অনেকের টনক নড়ে ওঠে।
একটি লেখায় পড়লাম একজন লিখেছেন, ডিভোর্স মানেই এই নয় যে ছেলে বা মেয়ের কেউ একজন খারাপ। দু’জন ভালো মানুষেরও ডিভোর্স হতে পারে অতএব…..!
চিন্তার কিছু নেই? আসলেই কি তাই?
প্রতিটি ডিভোর্সেরই কি এক বা একাধিক কাহিনী থাকে না?
অন্য কথায়, ঘটনা?
থাকে না কিছু অলিখিত শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ?
কখনও বা তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু?
অথবা যৌন জীবনের অনুপস্হিতি যখন হয়তো কিছুই আর বিনিময়ের থাকে না অপর সাথীটির? যাকে বলে ‘নো সেক্স ম্যারেজ’– দিন দিন রাগ জ্যামিতিক হারে পুঞ্জীভূত হয়?
এমনকি কখনও জীবননাশের আশঙ্কাও যখন ডিভোর্সই একমাত্র বাঁচার উপায় হিসেবে পরিগণিত হয়?
শারীরিক মানসিক নির্যাতন তো বলতে গেলে টিকে যাওয়া প্রতিটি বিয়েতেই কমবেশি দেখা যায়, পার্থক্য থাকে শুধু সময়ের–কারও দু’দিন আগে, কারও বা দু’দিন পরে। কেউ হয়তো শুরুতেই দুই কিল বসিয়ে দেয়, কেউবা বিয়ের দশ/পনের বছর পর শুরু করে। ততদিনে আবেগ অনুভূতিগুলোও হয়তো অনেকটাই সক্রিয়তা হারায়, টিকে যায় বিয়ে।
যৌতুকের চাপও কি কম থাকে বিয়েতে?
কখনও বা কন্যা সন্তানের জন্মদান?
কখনও তো শুধুই বাবা-মাকে খুশি করতেই ডিভোর্স হয়, যেমন হয়েছিল তারানা হালিমের!
সব সময়ই ডিভোর্সে কারণ তো কিছু থাকেই–কোনটা হয়তো ভয়াবহ, কোনটা ঠিক আছে ধরনের, এবারের মতো না হয়…. ম্যানেজেবল। তবে ভদ্র সমাজ ডিভোর্সের কারণ নিয়ে টানাটানি করতে পছন্দ করে না, বিশেষ করে ছেলেদের বিষয়টিতে। এতে আরেকজন মেয়ের আগমনের পথ সুগম থাকে। অতঃপর তাকেও গুনতে হয়, কত ধানে কত চাল!
ডিভোর্স মানেই একটি ভুল বিয়ের পরিসমাপ্তি, সেখানে আদর্শ বা পূজনীয় কোনো বিষয় নেই। আছে শুধুই ক্ষতির হিসেবনিকেষ। জীবনের কিছু মূল্যবান সময় নষ্ট, আর ভুলের মাশুল দেয়া-নেয়া। তবুও অনেক বিয়েতেই ডিভোর্স প্রয়োজনীয়, যদিও সমাজ বিষয়টিকে এখনও সঠিক দৃষ্টিতে দেখতে এবং হ্যান্ডেল করতে শেখায়নি। এমনকি এখনও বলতে গেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে ডিভোর্সকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়। চরিত্রহীন অথবা বরকে ম্যানেজ করতে অক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। কখনও বা হাসিঠাট্টার পাত্রও হয় সে। সমাজ এবং ধর্ম ডিভোর্সের অনুমতি দিলেও এখনও ডিভোর্সে নারীর সম্মান নিশ্চিত করতে পারেনি। যদিও সমাজে ডিভোর্সের অধিকার পুরুষের একচেটিয়া তবুও ডিভোর্স হলে টার্গেট করা হয় নারীকে।
প্রশ্ন তোলা হয়, ডিভোর্স হলো কেন? এমনি এমনি কি আর ডিভোর্স হয়?
ঠেকাতে পারলো না –অবশ্যই খারাপ কিছু। টার্গেট, নারী।
আবার ডিভোর্সের পরে কোনো মেয়ে বিয়ে করলেও লোকে বলে, বিয়ে করলো কেন? অপি করিমকে কোনো আইন ভঙ্গ না করেও লক্ষ কথা শুনতে হয়েছে বিয়ে এবং ডিভোর্সের কারণে। অথচ শুধু তিনিই জানেন কেমন জীবন পার করেছিলেন তিনি। তথাপি অনেকেই কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। তাইতো আমাদের সমাজের মেয়েরা ভয় পায় ডিভোর্সকে।
কিন্তু দেশের এবং ধর্মীয় দু’টো আইনই ডিভোর্সকে অনুমোদন করে সমাজ এবং মেয়েদেরকে তার উপযুক্ত করে তৈরি না করেই। তাইতো তুফান সরকারের মতো লোকের বউরাও ছয় বার তালাক হলেও ছয়বারই ঐ একই বরের সাথে কবুল পড়ে নিজেও অত্যাচারী হয়ে ওঠে– ন্যায় বিচারের জন্যে না যায় আদালতে, না মেনে নেয় ধর্মীয় ডিভোর্সকে। ভঙ্গ হয় সব আইনই। জীবন থেকে হারিয়ে যায় মানবিকতাও, কেননা কোন আত্মসম্মান বোধই আর অবশিষ্ট থাকে না।
সম্প্রতি ভারতে তিন তালাক নিয়ে হৈচৈ বেঁধে গিয়েছে–তিন তালাক কেন থাকবে ভারতের মাটিতে? একই সিটিংয়ে মিনিটের ভেতরে কী করে হয়ে যায় মানুষের তালাক? এতোদিনের একটি বিয়ের পরিসমাপ্তি? ওখানকার হিন্দু সমাজের অনেকেই ভাবছেন, খুবই ভয়াবহ ঘটনা এটি, কেননা তাদের মাঝে তালাকের বিধান নেই, বিয়ে জনম জনমের বন্ধন।ওখানে ৯২ % মুসলিম নারীদেরও ঐ একই মত, ধর্ম মানলেও ঐ ওয়ানগোতে তিন তালাক তারা মানবেন না, যেহেতু কোরআনে নেই। হযরত ওমর (রাঃ) তার আমলে এই তালাককে জাস্টিফাই করায় মুসলিম পুরুষরা বলছেন, এতেও তালাক হয়ে যায়, তবে না করাই উত্তম।
ভারত দ্বিধাগ্রস্ত–তারা দেশীয় আইন দিয়ে ধর্মীয় আইনকে রোধ করার যৌক্তিকতা দেখছেন। আর মুসলিম রমণীরা আশায় বুক বেঁধে তাকিয়ে আছেন সেই দিকে। অবাক হলাম মাত্র আটাশ বছরের একটি মেয়ে বুভুক্ষ চিত্তে সুবিচার পাবার আশায় সুপ্রীম কোর্টের দিকে বুক বেঁধে তাকিয়ে আছেন দেখে। মাত্র দু’বছরের বিয়ের মাথায় তার তালাক হয়েছে। এখনও কোনো সন্তান নেই। অথচ ডুগডুগি বাজিয়ে খোদা হাফেজের পরিবর্তে মারগুঁতা খেয়েও আমাকে কেন তালাক দিল মতবাদকে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন।
বিশ্বের বাইশটি মুসলিম দেশে যেহেতু তিন তালাক নেই, সেহেতু মুসলিম মহিলা সম্প্রদায় চান ভারত থেকেও তিন তালাক উঠে যাক। এটাই তাঁদের প্রাণের দাবি, কিন্তু কেন?
তাঁরা যদি বলতেন, ছেলেরা যদি তিন তালাক দিতে পারে, মেয়েদেরকেও তিনি তালাকের অধিকার দিতে হবে, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে নারীপুরুষের মাঝে অনেকটা সমতা আসতো নারীপুরুষের বিবাহিত জীবনে। পুরুষও হয়তো উঠতে বসতে যখন তখন তালাক তালাক তালাক বলতে ভয় পেতো। আবার নারীও আজীবন পরনির্ভরশীল থাকার পাঁয়তারা করতে পারতো না। সবাই জীবনে কর্মে বিশ্বাসী হয়ে আত্মনির্ভরশীলতার পথ খুঁজতো।
সুপ্রীম কোর্ট যদি তিন তালাকের প্রথা বাতিলও করে দেয় তাহলে তেমন বিয়ে থেকে একজন নারীর পাবার কী থাকে? আদালত তো আর বিবাহিত জীবনের আদর, কদর, সন্মান, কেয়ার নিশ্চিত করতে পারবে না। বরং তিন তালাক চালু থাকলে এবং মেয়েদের জন্যেও চালু করা হলে সমাজে নারীপুরুষের মাঝে গতিশীলতা বাড়বে। পুরুষ প্রথম তালাকটি বলতেই বাকি দুই তালাক সম্পন্ন করবে নারী। আবার নিজের দায়ও নিজের কাঁধে বহন করতে শিখবে। যে বর ভালোবাসে না, ক্ষণে ক্ষণে বৈবাহিক সম্পর্কটি থেকে মুক্তি পেতে চায়, কোনো নারী কী আসলেই ঐ সম্পর্কটিতে থাকতে চায়? নাকি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়ে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় ভেঙে যাওয়া সম্পর্কটিকে? অথচ তালাক নারীর পথটিকেও উন্মুক্ত করে। একজন নারী যদি স্বামীর মৃত্যুকে হ্যান্ডেল করতে পারেন, তাহলে যে বর আর ভালোবাসে না তার সাথে বিচ্ছেদ কেন মানতে পারবেন না?
যাই হোক, আমরা জানি না মিথিলা-তাহসানের ডিভোর্স কাহিনী। সুবর্ণাও বলেননি তাঁদের কেন ডিভোর্স হলো। অনেকেই বলেন না কারণ। তবে তালাকের বাস্তবতা কঠিন। বিশেষ করে সন্তানসহ ডিভোর্সে জটিল কোন কারণ না থাকলে বিয়ে ভেঙে গেলেও বর-বউ বার বার মিলিত হোন, এমনকি তাঁদের একজনের বিয়ে হয়ে যাবার পরও। আর কঠিন কারণ থাকলে যদি লোকে না জানে, আর বর যদি তুফান সরকারের মতো অতোটা ভয়াবহ হয়, তাহলে তালাকের পর আরেকটি মেয়ের ভোগার পথ প্রশস্ত হয়।
বাস্তবে নো ফল্ট ডিভোর্সও নো ফল্ট নয়। ডিভোর্সে কারণ প্রকাশিত না হলেও কারণ বিদ্যমান। তথাপি ডিভোর্সের সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত, আবেগিক, সেক্সচ্যুয়াল ডিসফাংশনালিটি, সময়, চেহারা নষ্ট, স্বপ্নভঙ্গ, অনিশ্চিত ভবিষ্যত ইত্যাদি নানা অনিশ্চয়তার সাইডএফেক্ট জড়িত। তবুও জীবনের যে কোন ধাপেই দম্পতিদের ডিভোর্স হতে পারে যেহেতু বিয়ে একটি ভঙ্গুরযোগ্য চুক্তি এবং জোর করে বিয়ে ধরে রাখার কোন ফজিলত নেই।
যেহেতু দুনিয়ার কোন আদলতই স্বামী-স্ত্রীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে অপারগ, তাই পুরুষের কাঁধে ভর দিয়ে নারীর জীবন চলার ছকটি না এঁকে নারীর নিজের দায় নিজে কাঁধে বহন করার পরিকল্পনার মধ্যেই মূলত নিহিত থাকে বিবাহিত জীবনের সমতা, ছন্দ এবং নারীর মুক্তি। ডিভোর্স যদি হয়ই, সেটি যতো বেশি সহজ হয় ততই ভালো। শুধু দরকার দু-পক্ষেরই সমঅধিকার এবং সমতার বিধান। নারীও সেই অধিকারের হকদার। তিন তালাক পরোক্ষভাবে নারীকে বলে ডায়নামিক হতে যদিও নারীকে সেই অধিকারটি দেয়া হয়নি। উচিত ছিল।
ভারতে বিবাহিত জীবনে অবিরত মার খেয়ে এবং তিন তালাকের পরও যারা বিয়েকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছেন, তারা মূলত পরনির্ভরশীল, অসহায়, এবং অনগ্রসর। বিধবা হয়ে মেয়েরা বাঁচতে পারলে তালাক হলেও বাঁচা সম্ভব। পৃথিবীতে কারও জন্যেই কারও জীবন আটকে থাকে না।
তালাকে নারীর ভীতি তার মানসিক এবং অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা, জীবনের অনিশ্চয়তা। তাই জীবনের শুরুতে তার স্বনির্ভরতার ভিতটি মজবুত করে গড়ে তোলাই তার ভবিষ্যত জীবনের প্রস্তুতি, সত্যিকারের মুক্তি।