এই দানবে আর মহামানবে একটি গভীর সম্পর্ক আছে

শেখ তাসলিমা মুন:

নারীরা অনেক দাবি-দাওয়া করে ফেলেছে। তারা সেক্সুয়াল স্বাধীনতা ঘোষণা করে ফেলেছে। তাদের রুখতে হবে। তারা পরিবার ভেঙে ফেলছে। নারীরা বাইরে আসলে তাদের পৃথিবী জানা হয়ে যায়। মেয়েরা পথে নামলে পথ তাদের হয়। মেয়েরা উন্মুক্ত মাঠে এসে দাঁড়ালে তারা দিগন্ত ছুঁতে চায়। মেয়েরা আকাশের নিচে দাঁড়ালে আকাশটি তাদের হয়ে যায়।

না, এসব নিয়ে কিছু আজ লিখবো না। তবে যা লিখবো তার সাথে এগুলোর সম্পর্ক পাতানো আছে নিবিড়ভাবে। আমি না চাইলেও সেগুলো লেপ্টে থাকবে। রূপা নামের মেয়েটিকে কয়েকজন হায়েনা খুবলে খুবলে খেয়ে ঘাড় মটকে বাসের জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। মেয়েটির হায়াত ছিল না। সে মারা গেছে।

না, তাতে যুবক সমাজের কোন দায় নাই। পুরুষ সমাজেরও নয়। মেয়েটি রাতে একা বাসে উঠেছিল। সে রাতে বাসে উঠবে আর এটা ঘটবে না সেটা ইতো অস্বাভাবিক! মেয়েটির কোনো দায় ছিল না? দোষ ছিল না? মেয়েদের একা একা চলাই তো একটি দোষ! আর তার জন্য এমন ঘটনাতো ঘটতেই পারে। বাসের চালক শ্রমিক কর্মচারীরা গুলশানের কেউকেটা কেউও নয়। পুলিশদের অন্তত গা ঢাকা দিতে হয়নি। সামনে এনে ফেলেছে। মেয়েটি ‘আত্মহত্যা করেছে’ এটা শুনতে হয়নি জেনে আমি নিজেই তাজ্জব বনে গেছি। মাঝে মাঝে অতি দুর্ভাগারও হঠাৎ হঠাৎ সৌভাগ্য ভর করে। রূপার সৌভাগ্য তেমন। পরম সৌভাগ্য। তার বিষয়ে সত্য বিষয়টি জানার ‘সৌভাগ্যে’ আমরাও কম সৌভাগ্যবান নই।

না, রূপা নারীবাদী বিষয়ে তেমন কোনো বোমা ফাটিয়েছিল বলে কিছু আমরা জানি না। সে একটি স্বপ্ন দেখেছিল। জীবনটা চুলোয় চেলাকাঠ ঠেলে কাটিয়ে দেবে না ঠিক করে বেশ কয়েকটি পাশ দিয়েছিল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরি করেছে। আরও যোগ্য চাকরির জন্য সাহসী পা রেখেছে ঘরের চৌকাঠের বাইরে। অপরাধ এগুলো কম কিছু নয়। ভেবে চিনতে পা রাখেনি, সেটাই কি কম অপরাধ?

যে সময় মেয়েটির উপর একদল রক্তখেকো কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন আমাদের সমাজের শিক্ষিত তরুণেরা নারীর চরিত্র হননে নেমেছিল। নারীরা কোথায় কোন প্লাটফর্মে কী বলবে আর কতোটুকুন বলবে তা নিক্তিতে মেপে দিচ্ছিল তারা। নারীরা সেভাবে চললে সমাজে কোন বিপর্যয় সৃষ্টি হবে না। যখনই মেয়েরা তাদের গোটা জীবনের থরে থরে উপচে পড়া রক্তাক্ত অভিজ্ঞতাকে জড়ো করে কথা বলতে শুরু করেছে, তাদের কণ্ঠস্বর বন্ধ করার জন্য তাদের চরিত্রে যে পরিমাণ কালিমা লেপন করা হয়েছে। এবং তার যে ইমপ্যাক্ট অবশিষ্ট তরুণ সমাজে পড়েছে, আর তার ফলে রূপাদের বাইরে স্বাধীন পা বাড়ানো কোনদিন আর নিরাপদ হয়ে ওঠে না।

না, রূপা বানানী গুলশানে কোনো জন্মদিনে যায়নি। কিন্তু সেজন্যও রূপা রেহাই পায়নি। মেয়েরা কেন ‘রাতে জন্মদিনের পার্টিতে যাবে’র মতো মেয়েরা কেন ‘রাতে বাসে উঠবে’ প্রশ্নটি চরকির মতো ঘুরছে। আমার ধারণা যে পুলিশ ভাইজানরা এই নরপশুদের হাতকড়া পরিয়ে পোজ দিয়েছে তারাও এ কথা প্রকাশ্যেই বলছে, ‘এই মেয়েরা রাতে কেন বাসে ওঠে?’

একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমার রুমমেট ঢাকা থেকে রাতের বাসে ইউনিভার্সিটিতে এসেছে। বাস সাধারণত সকাল ছটায় পৌঁছে। সেদিন কী সৌভাগ্যে বাস রাত তিনটায় ইউনিভার্সিটি গেইটে পৌঁছে গেল। মেয়েটি একা নামলো। এ ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। ক্যাম্পাস বরং কিছুটা নিরাপদ শহরে নামার থেকে। বলা বাহুল্য আমার রুমমেট রিকশার দেখাও পেলো না। সে একাই ব্যাগ নিয়ে একটি মাঠ পাড়ি দিয়ে হলের গেটে পৌঁছুলে তাকে দেড় ঘণ্টার মতো বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। সুপার থেকে শুরু করে নানা জটিল পর্ব শেষ করে মেয়েটি যখন হলের ভেতর ঢুকতে পেলো, তখন তার বিচার বসানো হলো এই মর্মে যে সে কেন এতো রাতে একা এসেছে। সুপার আপা বললো, ‘তুমি কোন পরিবারের মেয়ে? কোন ধরনের মা-বাপ তোমার, একা এই রাতে তোমাকে ছেড়েছে?’ মজার বিষয় এর পরদিন হলের মেয়ে মহলে শুধু এই গসিপ চললো। এত বড় ‘বেলেহাজ’ মেয়ে যার নিজের ‘সতীত্বের’ ভয় নাই! ইত্যাদি। এটি একটি মেয়েদের আবাসিক হলের ঘটনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা সেখানে থাকে।
সমস্যাটা মেয়েদের।

ধনী বা শ্রমিক শ্রেণীর আলাল দুলালদের ‘দণ্ডে’র কোন সমস্যা নেই। ‘দণ্ড’র কাজই খাড়ানো। ‘মাংসের তাল’ সামনে থাকলে জানোয়ার শাহেনশাহরা থাবা বসাবে না? পুরুষের বীর্য যখন মাথায় ওঠে তখন কি পৃথিবীর কিছু কি মাপ পেতে পারে? ছোটবেলায় গ্রামের এক বর্ষীয়ানের জবানবন্দীতে একটি গল্প শুনেছিলাম। বড় হয়ে গল্পটি যতবার মনে পড়েছে ততবার কেঁপে উঠেছি।

তিনি বলছিলেন, সে সময় গ্রামের নদীর কাছে প্রতি বছর একটি মেলা বসতো। সেখানে মেয়েরা প্রয়োজনীয় ঘর গৃহস্থালির জিনিসপত্র কিনতে যায়। একবার এক তরুণীর উপর এক যুবক ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই ভিড়ের ভেতরই। মেয়েটিকে কেউ উদ্ধার করলো না। বরং কেউ এসে তাদেরকে চাটাই দিয়ে ঢেকে দিলো। ছেলেটি কিছুক্ষণের ভেতর কাজ সেরে চাটাই থেকে মাথা বের করে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। অন্যরা মেয়েটিকে ঢেকে-ঢুকে বাড়ি নিয়ে গেল। চাটাই দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল কেন এটা জিজ্ঞেস করতে বর্ষীয়ান বলেছিল, ‘পুরুষের যখন মাথায় উঠে যায় তখন তাদের বন্ধ করে দিলে তারা কইলজা ফাইট্যা মারাও যেতে পারে। তাদের বাঁচানোর জন্য এ ব্যবস্থা।’ আমি আজও জানি না ঘটনাটি আসলেই ঘটেছিল! নাকি ঐ বর্ষীয়ান লোকের যুবক বয়সের পাশবিক ফ্যান্টাসি! কিন্তু তার বর্ণনায় যে ‘বিষয়টি’ উঠে এসেছিল তার সত্যতার প্রকটতা আজও বিদ্যমান।

একটি খুব কমন কথা আছে, সব পুরুষকে দায়ী করা ঠিক না। ভাল কথা, ‘থার্ড ওয়েভ’ ফেমিনিস্টদের একটি বদনাম আছে। ‘তারা সমস্যাটি ‘’সব পুরুষের’’ উপর চাপিয়ে দিয়ে শ্লোগান দেয়’’। না, না দুর্নামের ভয়ে আমরা এ কথাটি ভুলেও বলবো না। তাতে সব পুরুষের মানহানি হবে। সব পুরুষ তো আর বাসে গিয়ে ধর্ষণ করছে না। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পাশ থেকে উঠে গিয়ে সন্তর্পণে বাড়ির গৃহকর্মীর ঘরে প্রবেশ করলে সেটি ধর্ষণ হয় না। এগুলো ঘটতেই পারে। বউয়ের বোন বেড়াতে আসলে শালির সাথে খুনসুটির ফাঁকে শরীর হাতানোও কোন বিষয় না। চাচার সাথে দরকারে অন্য শহরের যাওয়ার সময় হঠাৎ রাত হয়ে যায়, চাচা কিশোরী ভাস্তিকে নিয়ে হোটেলে রুম ভাড়া করে বলে ‘আজ আর কোন বাস ট্রেন নাই সকালে যেতে হবে।’

প্রেমিকার ইচ্ছে হলো কাশবন দেখার। প্রেমিক নিয়ে গেল। কাশবন পেরিয়ে নির্জনতা আরও এক ধাপ এগুলো। মেয়েটি ‘না’ বললো। তার ‘না’ ‘হ্যাঁ’ হিসেবে প্রেমিক ছেলেটি অনুবাদ করে নিলো। ছেলেটি মেয়েটিকে তার আবাসে নিয়ে গেল নিজ হাতে রেঁধে খাওয়ানোর জন্য। বড়ই আধুনিক ফেনোমেনা। মেয়েটি এক্সাইটেড। প্রেমিকের হাতের রান্না খাবে। ছেলেটি রুমমেটদের বিদায় দিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে নির্জন হলো। দোষের কিছু নেই। কিন্তু মেয়েটির আপত্তি ছিল। সে ‘না’ করেছিল। কিন্তু তার ‘না’ কে আরও রোম্যান্টিক অনুবাদ করে নিলো ছেলেটি। মেয়েটি ধর্ষিত হয়ে রুমে ফিরলো। ‘ধর্ষণ’? ন্যাকামি? মেয়েটি প্রেমিক ছেলেটির সাথে ব্যাচেলর বাসায় যেতে পারলো, গেলে কী হবে সে যেন জানে না? তার নাম হবে ‘ধর্ষণ;? নেকি!

না না, এর সাথেও বাসের ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই। বাসের ওরা অশিক্ষিত নিম্নশ্রেণীর। ওরা দানব। সোফায় বসে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যারা ‘নারী কেন ওখানে একা গেল’ বলে ফতোয়া জারি করেন, তারা মহামানব। তবে কী জানেন, এই দানবে আর মহামানবে একটি গভীর সম্পর্ক আছে। এদের একটি গোঁড়া আছে। এদের পশ্চাদ্দেশের গোঁড়াটি এক।
যদি সাহস থাকে মোকাবেলা করুন। দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেন নিজের আচরণের। ঘরের পুত্র সন্তানটিকে মানুষ করেন।

যখন ‘অন্যায়কে অন্যায় বলে স্বীকৃতি দিতে পারবেন সেদিন অপরাধটি বের করে আনতে পারবেন। অন্যায়কে ‘অন্যায়’ হিসেবে স্বীকৃতি যেদিন দিতে পারবেন সেদিন দেশের মাদ্রাসায় মসজিদে একটি শিশু ধর্ষিত হবে না। পুলিশ ধর্ষিতার অভিযোগ নেবে। উকিল লড়বে ধর্ষিতার পক্ষে। বিচারক অটল থাকবে তার রায়ে। দেশের আইন শক্ত হবে ন্যায়ের শক্তিতে।

শেয়ার করুন: