কিছু মাইল দূরের ধর্ষণ

রাজিউল হোদা দীপ্ত:

জাফর ইকবাল স্যার এর একটা লেখা পড়েছিলাম একবার। তিনি বলেছিলেন, কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে নাকি তিনি নিজেকে সেখানে দেখেন। সেই ভুক্তভোগীদের ব্যথা বুঝতে পারেন। ধরুন, কোথাও একটা লঞ্চ ডুবে গিয়েছে। তিনি ভাবেন যদি তিনি নিজে ডুবে যেতেন?

এই কথাটা শোনার পর, অনেক বেশি আশ্চর্য হয়ে যাই আমি। স্যার এর সাথে আমার অনেকবার কথা হয়েছে। কিন্তু উনাকে এই ব্যাপারে কখনো সেভাবে বলা হয়নি। সত্যি বলতে একই জিনিসটা আমার হয়। কোথাও মানুষ বাস থেকে খাদে পড়ে মারা গেলে আমি ভাবি, যদি সেখানে আমি থাকতাম। একটা বিশাল বড় বাস, আমি যেদিকটায় বসে আছি সেইদিকে ভর দিয়ে খাদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ইসস! কেমন লেগেছে পড়ার আগের মুহূর্তে সেই মানুষটার।

সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি আর ঠিকভাবে বলতে গেলে ট্রমার মধ্যে ফেলে দেয় আমাকে, ধর্ষণের খবর। সবচেয়ে বেশি চিন্তায় আসে আর খারাপ লাগে, ধরুন একটা অপরিচিত মেয়ের কাছে আমি যাবো কাজের জন্য কথা বলতে, কিংবা সেই মেয়েটা যখন আমার কাছে আসবে কথা বলবার জন্য, তখন ইন্টেনশনালি বা আনইনটেনশনালি সে এইটা নিশ্চয়ই মেন্টালি ফিক্সড হয়ে আসে যে তার সামনে দাঁড়ানো এই ‘পুরুষ’ নামের অবজেক্টটা তার জন্য আশংকাজনক কোনো বস্তু হতে পারে। তাই আমাকে এর থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

মেয়েদের এই মনোভাবের জন্য তাদেরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এইটা নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থেই তাকে চিন্তা করতে হয়। শুধু অপরিচিত ছেলে না, কোনো পরিবারের পুরুষ সদস্যও সেইটা মাঝে-মধ্যে হয়ে থাকে, কিংবা হয়ে থাকে কোনো কাছের বন্ধু বা আরো কাছের কেউ। হ্যাঁ, মেয়েদের সবসময় খারাপ পরিণতিটা ভেবে চলতে হয়। কিন্তু কেনো? এর থেকে আর কী খারাপ হতে পারে?

এরপর যে চিন্তাটা মাথায় আসে, তা হলো, আচ্ছা আমার খুব কাছের কোনো মানুষ যদি আজ ধর্ষণের শিকার হতো? কী হতো? কী করতাম? কী যাচ্ছে, সেই মেয়েটার কাছের মানুষগুলোর উপর দিয়ে যে মেয়েটার পা কেঁপে উঠেছিলো বাসের সিটে শুয়ে থেকে। কাছে যখন একেকটা দানবের নিশ্বাস পড়ছিলো, সে কি আবছা দেখছিলো? একটু আগে পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলো সে, পরীক্ষা হলের টেনশন বা মাথার উপরের ফ্যানটা বন্ধ থাকার গরমটা কি সে তখনও অনুভব করছিলো? কলমের কথা মনে পড়ছিলো? বা, বন্ধুদের কথা? বাসার কথা? বাসার আরামের বিছানাটার কথা? আমি জানতে চাই না, কী মনে পড়েছিলো তার। আমি শুধু নিজেকে, তার জায়গায় দেখতে পাই। ঘাড় মটকানোর ব্যথা কেনো লাগে আমার? ইসস! আমি বাঁচাতে পারলাম না। আমরা বাঁচাতে পারলাম না।

আরো একটা বিষয় নিয়ে ট্রমার মধ্যে থাকি আমি। কেনো, সেই বাসের লাস্ট প্যাসেঞ্জারটা আমি হলাম না। এমন কিছু হয়তো হতো না। হতে গেলে আমি হয়তো বা তাকে নিজের সবটুকু দিয়ে রক্ষা করতে পারতাম সেদিন। বা, আমি যদি বাসের চালকটা হতাম? বা সুপারভাইজার হতাম, আমি। ইসস! মেয়েটা বেঁচে থাকতো।

হ্যাঁ, সেখানে আমি থাকলেও মেয়েটার পা ভয়ে দুরুদুরু কাঁপতো নিশ্চয়ই। কারণ, ওইযে সে ভাবতো ‘পুরুষ’ একটি অনিরাপদ বস্তু। বাসায় নিরাপদে গিয়ে, সে শান্তি পেতো হয়তো। হোক, ভাবতো নাহয় খারাপ। কিন্তু সে বেঁচে থাকতো, তাই না! কেনো হলো না, এমনটা সেদিন?

একটি ধর্ষণ ঘটে যায়, কিছুদিন চলে যায়। হ্যাঁ, হয়তো জেল হয়। রায় হয়। কী হয়? ফাঁসি হয়? হয়তোবা হয়! কিন্তু মেয়েটার নিরব কান্নাটার দাম কি সেই আসামী পরিশোধ করে যায়? নাকি, আদালত পরিশোধ করে? না কি, আমরা করি? আমাদের কথা না বলি। এই যে পড়ছেন লিখাটা। হয়তো পড়ে খারাপ লাগবে বা শেয়ার দিবেন বা সর্বোচ্চ ক্যাপশন দিবেন দু:খভরা কিছু একটা।

কিন্তু, এই মুহূর্তে ঠিক এই মুহূর্তে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেলো আপনার থেকে কয়েক মাইল দূরে পারলেন কি সেইটা আটকাতে? আমি ট্রমাতেই ভালো আছি।

শেয়ার করুন: