তানিয়া মোর্শেদ:
সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মের কুসংস্কারগুলোকে চিহ্নিত, প্রতিবাদ, প্রতিহত করা নারীবাদের অন্যতম বিষয়। পুরুষতান্ত্রিকতা এ’ বিষয়গুলোর মাধ্যমেই হাজার হাজার বৎসর ধরে টিকে আছে শুধু নয়, নারীকে আজও অবরুদ্ধ করে রেখেছে। কোথাও সমাজের নামে, কোথাও সংস্কৃতির নামে, কোথাও ধর্মের নামে শৃঙ্খল আটকে রেখেছে নারীকে। তাই দেখা যায় অনুন্নত সমাজ থেকে শুরু করে উন্নত সমাজে, অশিক্ষিত নারী থেকে সর্ব্বোচ্চ শিক্ষিত নারী, পেশাজীবী থেকে হোম মেইকার (কোন বাংলা শব্দ আছে কি এর?!)নারী সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মের কুসংস্কারের জন্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ!
হাজার বৎসর আগের সমাজ কিন্তু প্রতিনিয়ত বদলে চলেছে। সংস্কৃতিও বহমান বিষয়। ধর্মও কিন্তু বহমান। কিন্তু নারীর অবস্থান পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে খুব ধীরে পরিবর্তিত হয়। অথচ তা যদি পুরুষের অবস্থানের মত একই গতিতে এগোত তাহলে সত্যিকার অর্থেই ব্যক্তিগত-পারিবারিক ভাবেই শুধু নয় রাষ্ট্রীয় ভাবেও এবং সর্বোপরি পুরো পৃথিবী লাভবান হতো। পরিবার থেকে যদি শুরু করি, দু’জনের পরিবারে দু’জনের ভালো থাকা পরিবার আর একজনের মন্দ থাকা দু’জনের পরিবার কোনটি সব দিক দিয়ে সফল? নারীকে মন্দ রেখে পুরুষ কি সত্যি পরিবারে সব দিক থেকে সফল? সমাজের অর্ধেক জনসংখ্যাকে বদ্ধ রেখে সমাজ কতটা উন্নত? রাষ্ট্রই বা কতটা উন্নত? উন্নতি বলতে যদি আর্থিক, কাঠামোগত উন্নতি বোঝেন কেউ, সেখানে আর কোন কথাই নেই।
নারী ব্যক্তিগতভাবে আকাশ ছুঁয়েছেন অনেক আগেই। উন্নত সমাজ আর অনুন্নত সমাজে সংখ্যার তারতম্য আছে, এটুকুই যা পার্থক্য। কিন্তু এই আকাশ ছোঁয়া নারীরও একটি বিশাল সংখ্যা ব্যক্তি জীবনে অবরুদ্ধ নারীর থেকে খুব বেশী মর্যাদা পান না। শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা নারী মুক্তির অন্যতম বিষয় হলেও একমাত্র বিষয় নয়। মানসিক স্বাধীনতা ভীষণ জরুরী একটি বিষয়। মানসিকভাবে স্বাধীন না হবার জন্য আজও দেশে-বিদেশে এখনও অসংখ্য নারী কর্মজীবনে প্রচণ্ড সফল হয়েও পুরুষের অধীন। যে নারীর শিক্ষা, কর্ম, অর্থ, পরিচিতি সব আছে, সে কেন নির্যাতিত হবে বরের কাছে? কেন সে নির্যাতকের সাথেই থেকে যাবে বৎসরে পর বৎসর? সমাজের ভয়ে? সংস্কৃতির ভয়ে? ধর্মের ভয়ে? সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম কি তাকে খাদ্য-বস্ত্র-চিকিৎসা-মানসিক শান্তি দেয়? সন্তান পিতার স্নেহ বঞ্চিত হবে, সে কারণে?
নির্যাতিত নারী যে নীরবে নির্যাতন সয়ে যায়, তার নিজের সন্তানও কিন্তু মাকে বিশেষ সম্মান করে না। নির্যাতন শুধু শারীরিকভাবেই হয় না। মানসিক নির্যাতনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনভাবেই নির্যাতিত মা সন্তানদের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেবার মনোবাসনা থেকে সন্তানেরই ক্ষতি করেন সবচেয়ে বেশী। সমাজ-সংস্কৃতির কুসংস্কার নারী যদিও বা উপেক্ষা করতে পারেন, ধর্মেরটা নয়! ধর্ম মানুষের শেল্টার। তাই অনেক সময়ই দেখা যায় নির্যাতিত নারী ধর্মকে আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরেন। আর ধর্ম কখনই (যে ধর্মই হোক) নারীকে সমান অধিকার দেয়নি। ফলে সেই নির্যাতিত নারী ধর্মকে আরো আঁকড়ে ধরে “স্বামীর” নির্যাতনকে বৈধতা দিচ্ছেন! কারণ ধর্মই সেকথা তাকে শিখিয়েছে!
এক্ষেত্রে অশিক্ষিত আর উচ্চ শিক্ষিত, কর্মজীবী আর হোম মেইকার নারীর বিশেষ পার্থক্য নেই! ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। অধিকাংশ মানুষের ধর্মের শেল্টার প্রয়োজন। কিন্তু সমাজ-সংস্কৃতির কুসংস্কারের মতো ধর্মের কুসংস্কার ত্যাগ না করলে অন্য মানুষ-পৃথিবী যে সেই ধর্মকেই গালাগালি করে সেটা কি বুঝতে পারেন না তারা! আর যদি আরও একটু বেশী চিন্তা করেন, তাহলে কি মনে প্রশ্ন জাগে না, কেবলমাত্র লিংগগত পার্থকের কারণেই গড-আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান কেন এতোটা বৈষম্য করেছেন! মনে কি হয় না ধর্মের নিয়ম রীতিগুলো আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবানের পাঠানো নয়, পুরুষের সৃষ্টি?
“ব্যক্তিগত বিশ্বাস (ঈশ্বরে) নিয়ে নারীবাদের পুরোটা ধরা গেলেও, মানে স্পিরিচুয়াল হলে, ধর্ম বিশ্বাস (ধর্ম একটি প্রতিষ্ঠান) নিয়ে, পালন করে নারীবাদের পুরোটা ধরা কীভাবে সম্ভব? যে যে প্রতিষ্ঠান নারীবাদের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক, ধর্ম তার অন্যতম প্রধান। ব্যক্তি জীবনে ধর্মকে মডারনাইজ (নারী বা অন্যান্য সব বিষয়ে) করে পালন করলেই কি ধর্মের (প্রতিষ্ঠানের) সাথে নারীবাদের সাংঘর্ষিক রূপ, আচরণ বন্ধ হয়ে যাবে?
মানুষ ঈশ্বর, ধর্মের আশ্রয় চায়। কেউ কেউ কেবল প্রথমটাকেই আশ্রয় করতে পারে। কেউ কেউ দুটোকেই আশ্রয় করে। ঈশ্বর বিশ্বাস কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছাড়াই হতে পারে। এক্ষেত্রে নারীবাদের পুরোটা ধরা সম্ভব। কিন্তু যখনই ধর্ম (যে কোন ধর্ম) বিশ্বাস ও পালন হবে তখনই নারীবাদের সাথে সংঘর্ষ হবেই। ধর্ম একটি প্রতিষ্ঠান। যা কখনোই (যে ধর্মই হোক) নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেয়নি। কোন উদাহরণ দিচ্ছি না। তালিকা দেবার কোন প্রয়োজন আছে কি?
ধর্ম বিশ্বাস ও পালন করে নারীবাদের কথা যিনি বলেন, তিনি নারী অধিকারের কিছু বিষয় বলছেন। আধুনিক চিন্তা, পড়া ইত্যাদি থেকে তিনি ধর্মে নারীর প্রতি অবমাননার বিষয়গুলো বুঝছেন এবং প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু সমস্যাগুলো ধরতে পারলেও সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না বা চাইছেন না। সেকারণে তার ব্যক্তিগত চিন্তা, প্রতিবাদ বেশ কিছু মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হলেও এক পর্যায়ে আটকে যাবে।
আর সামাজিক রীতিনীতি, রাষ্ট্রের আইন এমনকি পারিবারিক মূল্যবোধও অধিকাংশ সময়ই ধর্ম নামের প্রতিষ্ঠানেরই ছায়া। কোথাও কম, কোথাও বেশী। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সমাজ, আইন, ধর্মও তৈরী করে। ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই করে। কিন্তু যুগের সাথে শিক্ষার সাথে নিজেই আবার সে সব মডিফাই করে। কিন্তু ধর্ম নামের প্রতিষ্ঠানকে মডিফাই করা সবচেয়ে কঠিন। কারণ এটাই সব ক্ষমতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
উন্নত সমাজ ধর্মকে একারণেই ব্যক্তিগত দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে চায়। যা সবার জন্যই মংগলময়। অন্যান্য ধর্মের মডার্ন রূপ দেখা যায় প্রায় সর্বত্রই। কিন্তু ইসলাম এ’বিষয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে। সবচেয়ে পরের ধর্ম বলেই হয়তো! এবং এর সামান্যতম মর্ডানাইজেশন দূরে থাক, কোন প্রশ্ন করা মানেই মৃত্যু!”