একাকী – ১

তামান্না ইসলাম:

শীতকালের সন্ধ্যা ঝুপ করে নামে। সন্ধ্যা না মিলাতেই চট করে রাত গভীর মনে হয়। অথচ ঘড়িতে বাজে মাত্র ছয়টা। এবার শীতও পড়েছে অনেক বেশি। সেজন্যই মনে হয় রাস্তায় তেমন একটা ভিড় নেই। বছরের অন্যান্য সময় বেইলি রোডের এই নাটক পাড়ায় সন্ধ্যার পরে গমগম করে। অথচ এই ভিড়ের মধ্যেই প্রতি সপ্তাহে নিতুর অন্তত একবার আসা চাই-ই চাই। ও যেমন নাটক পাগল, তার চেয়েও বেশি পাগল গণি মিয়ার চটপটির জন্য। তমালের ভাগ্যটা এক দিক দিয়ে ভালই বলতে হবে। ফাস্ট ফুডের গগনচুম্বী বিল দিতে হয় না, সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যার পরে এক প্লেট গনি মিয়ার চটপটি পেলেই নিতু খুশি।

তমাল দুহাতে দুপ্লেট চটপটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা সিগারেটের জন্য ওর প্রাণ আনচান করছে, কিন্তু নিতুর সামনে ধরানো যাবে না । নিতু ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা খবরের কাগজ বের করে যত্ন করে ফুটপাথের উপর বিছিয়ে দিল। ওর ব্যাগে রেডি থাকে সব সময়। পাশাপাশি বসে তমাল নিতুর হাতে অতিরিক্ত ঝাল আর টক দেওয়া প্লেটটা তুলে দিল।
‘আজও তুমি আলাদা করে টক আননি?’ নিতু জানে তমাল সবসময় এই ভুলটা করে। কিন্তু ওর আর তর সইছে না। গরম গরম এক চামচ চটপটি মুখে চালান করে দিয়েই ঝালে উঃ আহ শুরু করেছে। তমালের বরাবরই ওর এই কাণ্ডটা দেখতে মজা লাগে। ঝালে চোখে পানি চলে আসে, তার পরেও থামবে না। নিজের খাওয়া থামিয়ে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তমাল। নিতু হটাত খেয়াল করতেই খাওয়া থামিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকায় ‘এই তুমি খাচ্ছ না কেন? ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো।’
‘আমি অনেক ইম্পরট্যান্ট একটা কাজ করছি।’
‘কি ইম্পরট্যান্ট কাজ শুনি?’
‘আমি তোমাকে দেখছি। তোমার জল টলমল চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে শান্ত দিঘী, আমার সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে। কিংবা, বর্ষার জল ভরা মেঘ, এখনই বৃষ্টি নামবে আর আমাকে ভিজিয়ে দেবে।’
‘থাক আর কাব্য করতে হবে না, খালি পেটে বেশিক্ষণ কাব্য চালাতে পারবে না কবি।’ নিতু লজ্জা পেলেও মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। ও জানে ওর চোখ দুটো আসলেই ভীষণ সুন্দর।
তমাল ওর কপালের উপর থেকে আলগোছে সরিয়ে দেয় কয়েক গাছি চুল।’ তোমার ওই চোখের দিকে তাকিয়ে আমি সারা জীবন কাব্য করতে পারবো, একটুও খিদে লাগবে না।’
নিতুর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় তমাল।
‘চুড়ি পরোনি? মন খারাপ নাকি আজ আমার জান পাখিটার?’ নিতু সব সময় চুড়ি পরে, ওর যে কত চুড়ির কালেকশন।
নিতু সেকথার উত্তর না দিয়ে চটপটি নাড়া চাড়া করছে। ওর মুখটাও কী আজ একটু ম্লান? টিপ ছাড়া কপালটাকে দুঃখী দুঃখী মনে হচ্ছে।

মাথা নিচু করে ছিল এতক্ষণ। কী মনে করে তমালের দিকে সরাসরি তাকায় এবার। ‘বাসায় একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসছে। বাবার কথা তো জানো, যা রাগী। আমি আর কতদিন ঠেকিয়ে রাখবো? মাস্টার্স ও তো শেষ। তোমরা এবার প্রস্তাব নিয়ে না আসলে কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে’। অনেক আশা নিয়ে তমালের দিকে তাকিয়ে আছে নিতু।

তমাল আর পারলো না। নিতুর কথা ভুলে গিয়ে ফস করে সিগারেট ধরিয়ে বসল। ধোয়া ছাড়া এখন মাথা খুলবে না। আগামীকাল ওর বন্ধুদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরতে যাওয়ার কথা। কতদিনের স্বপ্ন আর পরিকল্পনা। নিতু এর মধ্যে এসব কী শুরু করলো? এই এক কথা গত তিন মাস ধরে শুনে আসছে।
এক মুখ ধোয়া ছেড়ে এক হাতে নিতুর গাল টিপে দেয় তমাল। ‘এতো দিন অপেক্ষা করেছ, আর কটা দিন অপেক্ষা করতে পারবে না? কাল যে আমরা খাগড়াছড়ি যাচ্ছি সোনা। ঘুরে আসি, তারপরে অবস্থা বুঝে মাকে দিয়ে বাবাকে বলাতে হবে।’

তমালের কথার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে নিতু বুঝে নিয়েছিল ওর মাথায় এখন ঘুরতে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নেই। ব্যাপারটা ও একদমই সিরিয়াসলি নেয় নি। অথচ এবারের ঘটনাটা ভীষণ সিরিয়াস। গতকাল রাতেও ওর বিয়ে নিয়ে মা আর বাবার মধ্যে ভীষণ ঝগড়া হয়েছে। সেই থেকে বাবার প্রেশার হাই। নিতুর কেন যেন ভীষণ অভিমান হয়। তমালের কাছে ওর বেড়ানো, ওর বন্ধু এগুলোই বড় হল। তমালের কী তবে ওকে হারানোর কোন ভয় নেই? বাকিটা সময় নিতু চুপ করে বসে ছিল। চটপটি শেষ না করেই তাড়াহুড়া করে ফিরে গেলো সে। আগামীকাল ভোরে জার্নি শুরু, তমাল সেটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত। ও বুঝতেই পারলো না কতটা কষ্ট পেয়ে নিতু ফিরে গেলো।

রিকশা ভাড়া করার সময় নিতু যখন বলল সে একাই যাবে, তমাল তখনো ভাবছে, ‘যাক, শেষ মুহূর্তের কিছু টুকি টাকি কেনাকাটা আছে, সেগুলো সেরে ফেলা যাবে।’ তমাল শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল। রাতের আঁধারে রিক্সায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নিতু। বাড়ি ফিরে কেউকে কিছু না বলে মাথা ধরার অজুহাতে শুয়ে পরল। শুয়ে শুয়েই শুনতে পেলো বাবার চিৎকার। আজও মাকে বকে যাচ্ছে,’তোমার আস্কারা পেয়ে মেয়েটা মাথায় উঠেছে। প্রতিদিন রাত করে বাড়ি ফেরা। পড়ালেখার অজুহাতে এতদিন বিয়ে করবে না বলে বসে আছে। এখন আর কী অজুহাত শুনি? ব্যবসার লোকসান যেভাবে বাড়ছে এরপরে আর চাইলেও মেয়ে বিয়ে দিতে পারবে না। আজকাল বিয়ের খরচ জানো? জানো তো শুধু এক রান্নাঘর আর দিন রাত তর্ক। আমার একটা কিছু হলে সবাই মিলে পথে বসবে।’ মা বোধ হয় তর্ক করে ক্লান্ত, আর তর্ক করারই বা কী যুক্তি আছে তার। তাই নিঃশব্দে কাঁদছেন, মাঝে মাঝে হেঁচকির মতো আওয়াজ আসছে। মার জন্য খুব কষ্ট হয় নিতুর। এই মানুষটাকে তারা সবাই মিলে আর কত কষ্ট দেবে?

নিতুর গায়ের রঙ কালো। বাবার অবস্থাও যে খুব আহামরি কিছু তা নয়। ছোটখাট ব্যাবসা করেন, কোনটাতেই সুবিধা করতে পারেন না। বিয়ের বাজারে নিতুর মত মেয়েদের চাহিদা খুব বেশি নেই। বিয়ে নিয়ে এতদিন সে অবশ্য খুব একটা মাথাও ঘামাত না। তমালকে ভালোবাসে, ওর সাথেই বিয়ে হবে মনে মনে এরকমই ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তমালের এ ব্যাপারে উদাসীনতা ওকে ভাবিয়ে তুলছে। বিশেষ করে এবার যেন ও পাত্তাই দিল না, নিজেকে নিয়েই বিভোর হয়ে আছে। আজ প্রায় সাত দিন হতে চলল, ওর কোন খবর নেই। কে জানে, হয়তো ফোনের সুযোগ পায় নি অথবা আনন্দের আতিশয্যে ভুলেই গেছে নিতুর কথা।

এই সাতদিন মা, বাবা কেউই ওর সাথে কোন কথা বলছে না। কারণ একটাই, কুয়েতে থাকা ছেলেটাকে বিয়ে করতে ও রাজি হচ্ছে না। ছেলেটা নাকি সব দিকেই ভালো। মাস্টার্স পাস। কুয়েতে আছে বেশ কয়েক বছর। সংসারের বোঝাও নেই খুব বেশি, এক মা ছাড়া। সেও গ্রামে থাকে। নিতু এখন পর্যন্ত ছবি দেখতেও আগ্রহ দেখায় নি কোন, বিয়ে তো দুরের কথা।

নিজের রুমে বিছানায় উপুড় হয়ে একটা বই পড়ছিল নিতু, ওর শেষ অবলম্বন, সব কিছু ভুলে থাকার। পর্দা সরিয়ে মা ঢুকলেন, হাতে বালিশ। নিতু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে।

‘সর, তোর সাথে ঘুমাব আজ।’ মায়ের চোখ লাল, ফোলা। দেখেই বোঝা যায়, অনেক কেঁদেছে। পরনের শাড়িটা এলোমেলো। মায়ের যেন অনেক বয়স বেড়ে গেছে হটাত করেই। নিতুর বুকটা মুচড়ে ওঠে।

‘কী হয়েছে মা?’
‘কিছু হয় নি। হয় তুই বাবার আনা ছেলেটার সাথে কথা বল, না হয় তোর পছন্দের কেউ থাকলে নিয়ে আয়। তোর বিয়ে নিয়ে দিন রাত কথা শুনতে আমার আর ভালো লাগে না। ব্যাবসার চিন্তায় তোর বাবার মাথা খারাপ হয়ে আছে। আমার সাথে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করছে। আজ বলছে আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবে না।’ নিতু মাকে চেনে। বাবাকে নিয়ে কখনো কোন অভিযোগ মায়ের মুখে শোনেনি সে। সেই মাই আজ ভেঙ্গে পরেছে। সারা রাত ঘুমাতে পারলো না সে। মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলো। মাও ঘুমের মধ্যে ছটফট করছে।

ভোরের সূর্য যখন একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে, নিতুর মনেও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত উঁকি দিল। অনেক হয়েছে, তমালের জন্য মা, বাবাকে কষ্ট দেওয়া। আর নয়। বাবার অতি আদরের মেয়ে নিতু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো বাবার পছন্দের ছেলেটাকেই সে বিয়ে করবে। কুয়েত প্রবাসী সোহেল আসছে আগামী পরশু। এক সপ্তাহের ছুটিতে। তার নাকি ছবি দেখেই নিতুকে পছন্দ হয়ে গেছে। গায়ের রঙ কালো হলেও কোন সমস্যা নেই। দাবী দাওয়াও খুব বেশি না। এমন পাত্র হাত ছাড়া করাটা জামান সাহেবের জন্য বড্ড বোকামি হয়ে যাবে।

সকালের নাস্তার টেবিলে বাবার মুখোমুখি বসেছে নিতু। মা শুয়ে আছে এখনো, মনে হয় বাবার সামনে পড়তে চাচ্ছে না গত রাতের ঘটনার পর। নিতুর ছোট ভাই জাহিদ নাস্তা খেয়ে ইউনিভার্সিটি চলে গেছে। বাবা, মেয়ে দুজনেই অসস্থি নিয়ে বসে আছে। জামান সাহেব গম্ভীর মুখে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন। তার প্লেটে দুটো রুটি আর ভাজি তুলে দিল নিতু। চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে নির্বিকার গলায় বলল ‘বাবা সোহেল সাহেবের চাচাকে জানিয়ে দাও, বিয়ের আয়োজন করতে। যত শীঘ্র সম্ভব।’

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন জামান সাহেব। ‘কিন্তু তুই তো ওর সাথে কথা বলিস নি। ছবিও দেখিস নি।’
‘তুমি তো দেখেছো। ফোনে কথাও বলেছ। তাতেই হবে।’
চায়ের কাপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় নিতুর বাষ্প ভরা চোখদুটো।
চলবে ……..

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.