পায়েল চক্রবর্ত্তী:
আমি প্রায়শঃই যে কথাটি শুনি সেটি হলো, “তুই বড় লক্ষীছাড়া” মেয়ে! অর্থাৎ আমি বাউন্ডুলে মেয়ে।
হ্যাঁ বাপু, মানছি, আমি বাউণ্ডুলে,আমি অবাধ্য!!
আমি অন্যান্য লক্ষী মেয়েদের মতো ‘বাধ্য’ হয়ে উঠতে পারিনি কোনোকালে। হবার বিশেষ ইচ্ছেও নেই। শুনেছি, লক্ষী নামের চরিত্রটি চঞ্চলা! এক জায়গায় বেশীক্ষণ টিকে থাকেন না; অথচ, আমাদের সমাজে যে মেয়েটি যতো বাধ্য এবং অবশ্যই সহনশীল, যে মেয়েটি একেবারে দুদুভাতু, মানে সহজপাঠের গোপাল বাবুর ফিমেল ভার্সন, সে ততো ‘লক্ষী!!
বিশ্বাস করুন, সেই লক্ষী হবার সাধ আমার নেই।
আচ্ছা, কখনো ভেবে দেখেছেন, আমাদের দেবদেবীগুলি কিন্তু সব সুন্দরী শ্রেষ্ঠা! পাট করে আঁচড়ানো কার্লিং করা চুল.. টিকোলো নাক, পাতলা ঠোঁট ভরাট গলা, সুগঠিত বুক, কোমর, থাই।
মোট কথা, দেবীকে হতে হবে সুন্দরী, সেক্স সিম্বল!! তা না হলে তার “কুচযুগের” বন্দনা হবে কী করে?
যে দেবী বিদ্যাদাত্রী, তার আইডেন্টিফিকেশন হচ্ছে তার বুক! তার বীণা রঞ্জিত হস্ত, পুস্তক-টুস্তক তাকে যতোই দেবীত্ব দিক না কেন, বস, তুমি মেয়ে, তোমার আসল জিনিসই হলো ওইখানা। ওই যত নজর আটকে যায় তোমার বুকে। তোমার সর্বস্ব এসে আটকে আছে জামার উঁচু হয়ে থাকা নারীত্বের নিশানে।
তুমি যতোই শিক্ষিত হও, সুন্দর ক্যারিয়ার থাকুক, দিনের শেষে তোমার বিচার হবে তোমার বুকের গঠন খারাপ কিংবা ভালো, তোমার কোমর পাতলা নাকি পাতলা নয়, তুমি লম্বা না বেঁটে, রোগা না মোটা… এসবের ওপর।
খারাপ লাগে কখন জানেন, যখন দেখি এক মেয়ে এইসব বিষয় নিয়ে অন্য একটি মেয়ের সমালোচনা করছে!
আজো ঋতুমতী মেয়েরা অচ্ছুতের পর্যায়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আজো কোনো সেক্সুয়ালি অ্যাবিউজড মেয়েকে চুপ করে ব্যাপারটা চেপে যেতে হয়, কারণ কি জানেন? আমরা নিজে! হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি এটাই।
আজ যদি আমি প্রতিবাদ করি আমার শ্লীলতাহানি করা হচ্ছে, চারটে আঙুল আমার দিকেও উঠবে, যে আমিই গায়েপরা, আমি উত্তেজক পোষাক পরেছি, ছেলেটার দোষ আছে বটে, আমিও কম যাই না, নিশ্চই আমিই কিছু করেছিলাম যাতে ছেলেটা আমার সাথে এমন করার সাহস পেয়েছে! কই তাদের সাথে তো হচ্ছে না?
আর আঙুল তুলবে কারা? আমার মতই আরো কিছু মেয়ে!! ভাবতেই অবাক লাগে, তাই না!!
আমাদের ভেতরের কালসাপগুলোকে না শেষ করলে, বৃথাই আমাদের এতো প্রচেষ্টা!
আমাদের বরাবর শেখানো হয়েছে পিরিয়ড মানে তুমি ঠাকুরঘরে ঢুকতে পারবে না। সেটা আমরা একটা পর্যায়ে মেনে নিয়েছিলাম, এখন যৌক্তিকতা নেই বলে মানি না। মানি না নয়, কথাটা হবে মানতে চাই না, কিন্তু এমন খুব কম নারী আছেন যিনি সত্যিই কাজটি করেছেন বা করেন। করতে গেলেও মন খচখচ করে। আসলে আমাদের ভেতর এই বীজ বুনে দেওয়া হয়েছিল ছোটোকালে। এখন শেকড়বাকড় ছড়িয়ে গেছে… শেকড় শুদ্ধ উপড়ানো খুব কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়!! এই শেকড় ছাড়ালে তবেই পুরো মুক্তি, তার আগে নয়।
যেদিন একটা মেয়ে অন্য মেয়েকে নিচে হ্যাঁচকা মেরে না নামিয়ে তাকে ওপরে তুলতে সাহায্য করবে,আমাদের জয় হবে সেদিন। সেদিন এই পুরুষশাষিত সমাজ আমাদের দিকে তাকানোর আগে দুবার ভাববে।
সব মেয়েরা তাদের দীপ্তি নিয়ে জ্বলে উঠুক, গর্জে উঠুক তাদের ভেতরের জমি আঁকড়ে বসা ভুল ধারণা গুলোর বিরুদ্ধে! দেখবেন, সেদিন আমাদের অধিকার আমরা নিজেরাই পেয়ে যাবো, তার জন্য সংগ্রাম করতে হবে না আর। সমাজ আমদের চোখে চোখ রাখতে ভয় পাবে।।
সবার আগে নিজেদের প্রশ্ন করুন, আমরা নিজেরা ঠিক কতখানি সঠিক।