নারীবাদ ‘হাইড এন্ড সিক’ খেলা না, সুস্পষ্ট যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত

চৈতী আহমেদ:

সমাজের সব মানুষ রাজমিস্ত্রী নয়, কিছু মানুষ রাজমিস্ত্রী, তারা বিল্ডিং তৈরি করে। বিল্ডিং এর সুফল সমাজের সবাই ভোগ করে। তেমনি সমাজের সব নারীকে নারীবাদী হতেই হবে এমন কিছু ঠিক করে দেয়া নেই। কিছু নারী নারীবাদী হবে তারা সমাজটাকে ভেঙেচুরে গড়বে, যার ফল ভোগ করবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষ।

এই কিছু নারীবাদীকেই কিন্তু হতে হবে বিশুদ্ধ নারীবাদী। সকল সংস্কার আর অন্ধকার থেকে মুক্ত। কেউ নারীবাদ বুঝতে চাইলে এই নারীবাদী তাকে ভুল বোঝাবে না। এই নারীবাদী বলবে না ধর্মের সাথে নারীবাদের কোনো ক্লেশ নেই, ঝগড়া নেই। এই নারীবাদী বলবে, ধর্ম আছে বলেই আমরা নারীবাদী! আমাদের লড়াই বা নির্মাণ সরাসরি আল্লাহ, ভগবান, ইশ্বর ইত্যাদিকে বাতিল করে দিয়েই।

অনেকে এই ধরনের নারীবাদকে উগ্র নারীবাদ বলে এক পাশে ফেলে দেবার চেষ্টা করেন। নারীবাদের লড়াইটা আসলে কার বিরুদ্ধে? পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তো? পুরুষতন্ত্রের প্রধান অস্ত্রই হলো ধর্ম। তাহলে আপনি কীভাবে আশা করেন এই প্রধান অস্ত্রকে ওভারলুক করে যুদ্ধে জেতার? অবশ্য আপনি যদি যুদ্ধে জিততে চান তো!

আরো একটা বিষয় অনেকেই বলেন -সমাজের তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের যদি বলা হয়, নারীবাদের যুদ্ধটা কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে, তাহলে কি তারা নারীবাদী হতে চাইবে বা নারীবাদীদের কথা শুনবে? উত্তর হলো না, সবাই চাইবে না। সবাই শুনতে চাইবে না। বেশিরভাগই শুনতে চাইবে না। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একজন মানুষের জন্মের আগে-পরে মানুষের শরীর ও মনে এমনভাবে ধর্মের জং ধরিয়ে দেয়, যা থেকে তাকে মুক্ত করতে গেলে হয়তো মানুষটারই মৃত্যু হয়। কেউ কেউ ধর্মের সেই জং আঁকড়ে ধরেই চলে যায় অলীক আল্লাহর কাছে। সব জং এর উপর শিক্ষা বা যুক্তির আরক কাজ করে না। আসলে পুরু জংয়ের মধ্যে শিক্ষা বা যুক্তির আরক ঢুকতেই পারে না।

এখন প্রশ্ন, কীভাবে তবে এই তৃণমূলের নারীরা নারীবাদী আন্দোলনে যুক্ত হবে? নারীবাদ এমন কোনো বাদ নয় যে একটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাতারাতি সব বদলে দেয়ার ডাক দেয়া হলো, আর দলে দলে নারীরা তাদের এতো দিনের নিষ্পেষণের শিকল ছিঁড়ে এসে নারীবাদের লাল পতাকার নিচে এসে নাম এন্ট্রি করে যাবে?

না যাবে না। এটা সম্ভবও নয়। নিষ্পেষণও সহ্য করতে করতে এক সময় আসক্তিতে পরিণত হয়। এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাহলে কি নারীবাদীরা এদের পতাকার নিচে নিয়ে আসার জন্য এই তৃণমূলের নারীদের গিয়ে বলবে যে-

“ দেখো তোমরা যা জানো ভুল জানো, এই দেখো আমাকে দেখো, আমি কতো ধার্মিক, নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, আগামী বছর হজেও যাবো ইনশাল্লাহ। নারীবাদ আর ধর্মের মধ্যে না আসলেই কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তোমার স্বামী তোমাকে মারধর করে? তুমি জাস্ট সেইটা সহ্য করবা না। তোমার শাশুড়ি তোমার চাকরি করা পছন্দ করে না? তুমি জাস্ট সেইটা মানবা না। এতে তোমার বড় গুনাহ হবে না, অল্প গুনাহ করলে কিছু হয় না।

-কিন্তু কোরআনে তো স্বামীর আদেশ মান্য করতে বলেছে। বলেছে নারীদের বাইরে গিয়ে চাকরি করা জায়েজ না?
-আরে ঐসব তো কোরআন এর ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোরআনে আসলে কথাটা ঠিক ঐভাবে বলে নাই…….এই দেখো না, আমি তো চাকরি করি, আমার স্বামী না করছিলো আমি দিছি শুনাইয়া, এম এ পাশ করছি কি ঘরে বইসা থাকার জন্য? লাগে আমি রাত জাইগা তোমার গুষ্টির জন্য রান্নাবান্না করবো, তারপরও অফিস কিন্তু ছাড়বো না। হুম….

-মানুষ যে বলে নারীবাদীরা নাস্তিকতা করে?
-আর বইলো না, ঐগুলি হইলো উগ্র নারীবাদী, ঐগুলির জন্যই পুরুষরা আজ নারীদের চরিত্র নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়।”

নারীবাদ অবশ্যই রকম হাইড এন্ড সিক খেলা না। নারীবাদ সুক্ষ্ন যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি মতবাদ। ধর্মের নারী নক্ষত্র খুলে খুলে এর অকার্যকারিতা অনুধাবন না করতে পারলে আপনার হাতে নারীবাদের ঝাণ্ডা আপনার অসাধুতাই প্রচার করবে। এতে করে নারীর প্রকৃতই কোনো উন্নয়ন হবে না। ধর্মকে উহ্য রেখে আপনি বড় জোর এনজিওবাদী হতে পারেন, নারীবাদী কিছুতেই না। এনজিওগুলো নারীর উন্নয়নে কতটা করছে আর নিজেদের পকেট কতোটা ভারী করছে সেটা আজকের পৃথিবীর কাছে আর দুর্বোধ্য নয়।

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে- পৃথিবীর যে সব দেশে নারীবাদ প্রায় স্টাব্লিশড, সেই সব দেশে ধর্ম কোনো প্রধান বিষয় নয়। এই দেশগুলোতে ধর্ম একটি অপশনাল বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলেই নারীবাদ স্টাব্লিশড হতে পেরেছে। ধর্মীয় আচরণকে প্রধান করে রেখে নারীবাদ আন্দোলনের সুফল প্রত্যাশা করা শুধু কঠিনই নয় অসম্ভব।

নারীর নির্যাতিত, শৃঙ্খলিত, ধর্মীয় কুসংস্কারের বদ্ধ কুঠরীতে শিক্ষা আর যুক্তির আলো পৌঁছে দেয়া গেলেই শুধু নারীবাদ তার প্রাথমিক সাফল্য দাবি করতে পারবে, অন্যথায় নয়।

শেয়ার করুন: