ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রশ্নে আমাদের নারীবাদ

অনুপম সেন অমি:

ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে নারীবাদী ভাবনা কীভাবে দেখতে চায়, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে ক্ষমতাকে “পুরুষতন্ত্র” নামে চিহ্নিত করি, তা সমাজের কোনো স্তরেই সরলরৈখিক নয়। আবার এর মধ্যে আছে অথরিটিরও প্রশ্ন। এখন আমাদের অঞ্চলে যে ক্ষমতাকে সচরাচর নারীবাদীরা/নারীবাদী ভাবনায় (আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কথা বলছি) আঘাত করতে চায়, সে ক্ষমতার বিকাশ এবং অবয়ব পুরোদস্তুর উপরে উপরেই আমরা দেখি। কিন্তু যে ক্ষমতা ভেতরে রয়ে যায়, যা সহজ আলাপে বা খালি চোখে দেখি না তার কী হবে? অর্থাৎ গভীরে আছে যে ক্ষমতার আঁকর, তাকে নির্ধারণ করতে পারাটাই বড় কথা।

ধরেন, কোন স্বামীর স্ত্রী নির্যাতন নিয়ে আমরা যতটা কথা বলি/সোচ্চার হই, সমগ্র বিয়ে-ব্যবস্থার কন্সট্রাকশন নিয়ে ততোটা কথা বলি না আর। এখন এটাও তো ভাবা দরকার যে, ইতিহাস কী এটা দেখার চেয়ে ইতিহাস কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা আজ এই সময়ে দেখা খুব প্রয়োজন। ক্ষমতার ছাপ থাকতে পারে সবখানেই। খালি চোখে যা সবাই দেখি, তা হচ্ছে এর মূর্ত প্রকাশ, কিন্তু প্রোথিত আছে যা তাকে খুঁজে বের না করলে “পুরুষতন্ত্র” (পড়ুন ক্ষমতা) এর বিন্যাস বোঝা সম্ভব নয় আমাদের নারীবাদীদের (?) দ্বারা।

আবার এর মধ্যে আছে, অথরিটির প্রশ্ন। লক্ষ করবার বিষয়, উইমেন চ্যাপ্টারের অধিকাংশ লেখাতেও লেখক যে সমাজে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিতে বসে আছেন সেটা বেশ আঁচ করা যায়। বিষয়টা এমন না যে, কেউ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিতে অবস্থান করলেই সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে লিখতে পারবেন না। কিন্তু যখন কারও লেখা/ভাবনার মধ্যে নিজের অথরটি এবং সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থানের প্রকাশ পায়, তখন যাদের (যারা এই সুবিধা অঞ্চলের বাইরে থাকে) উদ্দেশ্যে এই লেখা, তারা তো আপনা-আপনিই “অপর” হয়ে পড়ে।

আপনি/আমরা যখন কোন গোষ্ঠী/ ব্যক্তি/ শ্রেণিকে নিয়ে সচেতনতামূলক লেখা লিখেও নিজের অজান্তে তাদের “অপর” করে ফেলি, সেটা কোনো সুফল বয়ে আনে না।
পরিষ্কার করা দরকার যে, সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থান বলতে আমি কী বুঝাতে চাইছি! ধরেন, সামাজিক, শ্রেণিগত ও অর্থনৈতিকভাবে যার অবস্থান সুনিশ্চিত অর্থাৎ যার অবস্থান প্রান্তে না, সেই রকম একটা সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিতে থেকে যখন কোনো কথা বলা হয়, তখন এইটা ভাবা খুব দরকার যে সেই বক্তব্যে ব্যক্তি লেখকের শ্রেণিগত সুবিধাভোগী অবস্থানের রিপ্রেজেন্টশন কতোটা।

আপনি যখন আপনার অবস্থান থেকে খুব সহজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পারছেন, এবং বলে দিতে পারেন যে, “ওড়না ফেলে দাও নারী”, অথবা “পরকীয়া ভালো” (কোন বিশেষ লেখাকে এখানে উদ্ধৃত করা হয়নি), তখন যাদের জন্য এই কথা বলা হচ্ছে তাদের শ্রেণিটা কি আপনি বিবেচনায় নিয়েছেন? আপনার অবস্থান থেকে যেটা ভালো/সুবিধাজনক মনে হচ্ছে/হচ্ছে না, অন্যের অবস্থান থেকে এই সিদ্ধান্ত খুব কঠিন/বাঁকা মনে হতেও পারে। আপনি যে বাধা পেরিয়ে আসতে পেরেছেন, অন্যজনকে এতো সহজ বয়ান দিয়ে সেটা পেরিয়ে আসতে বলার ভেতর দিয়েই আপনি যাদের উদ্দেশে এই বয়ান দিচ্ছেন, তাদের “অপর” করে দেন। “অপর” করে ফেলেন, কেননা এই কর্তৃত্বপরায়ণ বয়ান তাদের সামনে আপনার সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থানকেই রিপ্রেজেন্ট করে। এই অপর হয়ে পড়া গোষ্ঠী তখন ভেবে নিতে পারে যে, আপনার সুবিধাজনক অবস্থানের কারণেই আপনার পক্ষে এসব বলা সম্ভব এবং এই বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থান যেহেতু তাদের নাই, তখন আপনার ভাবনার সাথে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। এই দূরত্ব তাদের ব্যক্তিক ও সামাজিক অবস্থানকে প্রান্তিক ও সুবিধাহীন বলে চিনতে শিখায়। এটা মোটেও আশার কথা নয়। এ যেন অধিকারের কথা বলতে এসে, আপনি/আমি অ/সচেতনভাবেই অন্যের অধিকার হরণ করে বসে আছি।

এর চেয়েও বড় একটা প্রশ্ন হলো, আপনার এই কর্তৃত্বপরায়ণ বয়ানের সাথে অন্য যেকোনো ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর বয়ানের সীমারেখা কোথায়? তারাও তো মেয়েদের পোশাকে ঢেকে রাখার কথা বলে, এবং বেশ কর্তৃত্ব নিয়েই বলে। বিষয়টা যেন এমন যে, যাদের উদ্দেশে এই বয়ান দেওয়া হচ্ছে তারা ভাষাহীন এবং ইতিহাস ও রাজনীতি বিচ্যুত কোন “অবজেক্ট”।

দ্বিতীয় পক্ষের কর্তৃত্ব খাটানোকে এখন আমরা যদি সমালোচনার চোখে দেখি, তবে প্রথম পক্ষেরটা দেখা যাবে/হবে না কেন? দুই পক্ষই তো “নারীদের” নিজেদের মতো ভাবতে এবং দেখতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে সেই সকল নারীদের (যাদের জন্য এই কর্তৃত্বপূর্ণ বয়ান জারি করা হচ্ছে) স্বকীয়তা তৈরি হওয়ার স্বাধীনতাও কি লুপ্ত হচ্ছে না যখন দুইপক্ষই অন্যের ভাষা/ভাবনাকে নিজেদের বয়ানে প্রতিস্থাপন করতে চান?

আপনার উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু ক্ষমতার প্রশ্নে আপনিও কেন্দ্রে বাস করেন এক্ষেত্রে। এইরকম র‍্যাডিকাল ফেমিনিজমের চর্চা আমাদের অঞ্চলে সচরাচর দেখি। এই চর্চাতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু এই অনুশীলনের মধ্যে থেকেই আমাদের এই অঞ্চলে “এথনোসেন্ট্রিক” বয়ান উৎপাদিত হতে থাকে। নিজের অবস্থান থেকেই অন্যকে দেখার চেষ্টা এবং বিচার করার নামই এথনোসেন্ট্রিজম। যাচাই-বাছাই/ গবেষণা না করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে সবাই। তাও তো তসলিমা নাসরিনের একটা কারণ থাকতে পারে এই ধরনের নারীবাদ চর্চার, কিন্তু উনার লিগ্যাসি বহন করে বাকিরাও যে এই অনুশীলনে আগ্রহী, তা আমাদের এই উত্তর-উপনিবেশিক সমাজে খুব আশার আলো জাগাবে কি?

উদাহরণ হিসেবেই বলি, বর্তমানে নারীবাদীরা যে ‘হিজাব’কে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের শোষণ হিসেবে দেখেন, এই সিদ্ধান্তও বেশ একপেশে। কারণ আমরা তো জানি না, এর কতোটা চাপিয়ে দেওয়া আর কতোটা ব্যক্তিগত ও অন্যান্য সামাজিক কারণে ঘটেছে/ঘটতে পারে। যেমন আলজেরিয়াতে ফরাসি উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করেই সাধারণ নারীরা ইউরোপীয় পোশাক বর্জন করে বোরকা পরেছিলেন একসময়। আবার ইরানেও বিপ্লবের পরে নারীরা স্বেচ্ছায় নিজেদের পোশাক বদলিয়েছিলেন। এই দুটা উদাহরণই হচ্ছে উপনিবেশের বিরুদ্ধে নারীর ক্ষমতার প্রকাশ।
তাই সবক্ষেত্রেই যে “হিজাব” পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া কোন বিষয় হবে, এমন বলাটা বক্তব্যের অতিসাধারণীকরণ। এটার অন্যান্য দায়কে অস্বীকার করতে চাওয়া এবং শুধু ধর্মকেই প্রতিপক্ষ করে ফেলা।

নারীবাদ কেবল “পুরুষতন্ত্রই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু” এটা মনে করলেও সীমাবদ্ধতার সূত্রে আটকে পড়বে। মিশেল ফুকো বলেছেন, “ক্ষমতার” বিপরীতে যা কিছু, তার মধ্যেও আছে “ক্ষমতা”। তাই ক্ষমতা যে অন্য পাশেও থাকতে পারে সেই সম্ভাবনাকে নাকচ করা আর ইতিহাসকে একরৈখিক পাঠ করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি এজন্য নারীর ক্ষমতাকেও বোধে আনতে হবে।

মোদ্দা কথা হলো, পুরুষতান্ত্রিক অথরিটির বিরুদ্ধে বলতে এসে, নিজেই একটা কর্তৃত্ব তৈরি করে নিলে এর মাধ্যমে কেন্দ্র ও পরিধির যে দূরত্ব তা কমানো যাবে না। বরং যে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই তার পাশেই আরও ছোট বড় ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে উঠবে অনায়াসে। “এথনোসেন্ট্রিক” বয়ান তৈরি হতে থাকবে একের পর এক। আমি বলছি না, কেউ এই বোধ নিয়ে/চিন্তা থেকেই আসলে লিখছেন। কিন্তু এটা হচ্ছে ভাষা/ভাবনার প্রবণতা যার ভেতরকার রাজনীতি না বুঝলে বাইরের রাজনীতি অধরাই হয়তো থেকে যায়।

শেয়ার করুন: