ফারজানা আকসা জহুরা:
খুব ছোট সময়ে যখন বেনাপোল দিয়ে নানীর বাড়ি যেতাম, তখন রানাঘাট এলেই আম্মু ব্যাগে রাখা সিঁদুরের কৌটা খুলে কপালে দিয়ে নিত, আর সাথে রাখা শাঁখাগুলি দুই হাতে পরতো। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, নানার বাড়ি গেলে মনে হয় এইগুলি পরতে হয়!
আমার খালাদের বিয়ের সময় সবাইকে একটা করে সিঁদুরের কৌটা দেয়া হতো। এটা হলো ছিল তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা…..সিঁদুর দিলে কেউ আক্রমণ করবে না তাই।
আমি যখন আরেকটু বড়, তখন দর্শনা দিয়ে নানার বাড়ি যেতাম। কখনো গেদে হয়ে নবদ্বীপ বা কলকাতা। ট্রেনে উঠলেই সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, আমরা কি মোহামেডান? আমি বলতাম, না না, আমরা তো আবাহনী! আমি তখন বুঝতাম না, ওটা কোনো ফুটবল টিমের নাম ছিল না, ওটা ছিল মুসলমানদের নাম।
ছোটো থেকে দেখেছি আমার নানার গ্রামে আজান দেয় না, বরং ঘন্টা বাজে। ওদেশে বাঙ্গালী মুসলিমরা তেমন একটা বোরখা/পর্দা করে না। তাই অনেকে আমার মাথার কাপড় দেখে ভাবতো, আমি বিহারি। পরে ভাষা শুনে অবাক হতো। বলতো, তুমি বাঙালি?
১৯৯৮ সালে একবার কাটোয়া থেকে কলকাতার ট্রেন ধরেছি। এক বয়্স্ক (৬০+হবে) নারী আমার সামনের সিটে বসেছিলেন। পুরো রাস্তা তিনি আমার মাথার কাপড় নিয়ে কথা শোনালেন। ট্রেন থেকে নেমে আমি যখন আমার আত্মীয়দের ঘটনাটা বললাম, তখন তারা খুব বেশী অবাক হলেন না। এই সবে তারা অভ্যস্ত।
এই হলো সাম্প্রদায়িকতা, যা আমরা অনেকেই অনুভব করে থাকি। কিন্তু তার মানে এই না যে ওদের মধ্যে কোনো সম্প্রীতি নেই। আছে, ও দেশে সম্প্রীতি আছে। আর আছে বলেই তো যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা “হিন্দু—মুসলমান” একই বাড়িতে, একই গ্রামে, একই শহরে, দেশে মিলেমিশে বসবাস করতে পারে।
১৯৯৩/৯৪ সালের ঘটনা। বাবরি মসজিদ নিয়ে তখন খুব উত্তেজনা। প্রচণ্ড ভিড় ট্রেনে, সবাই জানতে চাইছিল যে আমরা হিন্দু না মুসলমান! তখন কলিজাটা শুকিয়ে মুখে চলে এসেছে। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে, গরমে আমার বাবা হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আমরা তখন তিন বোন বড় বড়, আর বাকি দুটো খুবই ছোটো। সাথে থাকা বড় বড় ল্যাগেজ ..টাকা-পয়সা.. পরনের গহনা। এই সবকিছু নিয়ে আমার মা একেবারেই দিশেহারা। এখন কী হবে?
অথচ ওই ট্রেনে কিছু হিন্দু ছিলো (হ্যাঁ, আমি হিন্দুই বললাম …) যারা আমাদের বসতে দিলো, পুরো সিট খালি করে তারা আমার বাবাকে শোয়ালো, পানি না বরং তাদের কাছে রাখা জলই খাওয়ালো। পুরো রাস্তা তারা আমার বাবাকে বাতাস করলো। স্টেশন আসা পর্যন্ত তারা আমাদের সাথেই থাকলো। এমনকি স্টেশনে নেমে তারা বাবাকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে, ট্যাক্সি করে আমাদের ঠাকুরপুকুর খালার বাড়িতে দিয়ে আসলো। অথচ তারা একটি টাকাও আমাদের কাছ থেকে নিল না।
আবার আমার নানীর বাড়ি গেলেই আশেপাশে বাঙাল বাড়ির মাসীরা আমাদের দেখতে আসতো। কখনও জোর করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতো। কারণ একটাই আমরা বাংলাদেশী! তাদের ফেলে আসা দেশী মানুষ! আমাদের বাঙাল ভাষা আর সুরে তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া দেশ খুঁজে পেতো।
আমার ছোট নানা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল এক হিন্দু নারীকে। সারাটা জীবন তিনি সেই হিন্দু বৌকে নিয়ে সংসার করলেন। আর ঐ ঘরের মামা আর খালারাও যে যার ধর্ম খুঁজে নিয়েছে। আর এই সবই আচার আচরণই তো অসাম্প্রদায়িকতা, তাই নয় কি? আবার ওপারের মতো এপারেও তো অসাম্প্রদায়িক মানুষ আছে।
আপাদমস্তক বোরখা পরা আমার কলেজের বান্ধবীর নাম ছিল লিপি। যার সাথে আমি ক্যান্টিনের সিঙ্গারা, চটপটিও ভাগাভাগি করে খেতাম। ঝালে যখন আমার হেঁচকি আসতো তখন লিপির ব্যাগে রাখা জলই আমাকে দিত। শুধু কি তাই, মিরপুর থেকে বকশী বাজার পর্যন্ত ৯নং বাসে একটি সিট আমরা দুইজন ভাগাভাগি করে বসতাম। অথচ আমাদের দুইজনের ধর্ম আর পোশাক কিন্তু আলাদা ছিল।
চাকরির সুবাদে যখন ২০০৯ এ মানিকগঞ্জে আমার পোস্টিং হলো, তখন নিরাপত্তার জন্য এক বড় আপুর সাথে তার পূজার রুমে থাকতে হয়েছিল। “প্রভা দিদি” ছিলেন খুব ধার্মিক একজন মানুষ। ঘরের মধ্যে খুব সুন্দর করে সাজানো ছিল তার পূজার আসন। প্রতিদিন তিনি নিয়ম করে দুই বেলা পূজা করতেন। আর আমার ছোটবেলার অভ্যাস নামাজ পড়া। নামাজ না পড়ে আমি থাকতে পারি না। অথচ ঐ রুমে তো নামাজ হবে না। কিন্তু তাতে কী? আমি যে কয়েক দিন ঐ রুমে ছিলাম, সেই কয়েক দিন পাশের বারান্দায় নামাজ পড়েছি। এতে আমার নামাজও ঠিক ছিল, আর প্রভা দিদির পূজাও।
ঐ অফিসে যতদিন ছিলাম, দিদির সাথে কখনো কোনো ঝগড়া হয়নি, বরং বন্ধুত্ব হয়েছে। আমাকে তিনি মানিকগঞ্জে ঘুরে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন সাটুরিয়ার জমিদার বাড়ি। চাকরি ছাড়ার পরেও প্রভা দিদি আমাকে ফোন দিতেন। আমার খোঁজ নিতেন। প্রভা দিদির গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল আমার মোবাইলে রিং টোন। আমরা দুইজনই কিন্তু ধার্মিক ছিলাম , কিন্তু অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের জন্য আমাদের ধর্ম ত্যাগ করতে হয়নি।
আমরা এই দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, আমরা অতি সাধারণ। ধর্মের ওপর আছে আমাদের অগাধ বিশ্বাস। আমরা যার যার ধর্ম ত্যাগ না করেই একে অপরের সাথে মেলামেশা করি। আমরা যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী, একই বাড়ি, একই গ্রাম, একই শহর ও দেশে একত্রে বসবাস করি। আমরা একে অপরের সাথে আত্মার আত্মীয়তা গড়ি। অসাম্প্রদায়িকতা প্রমাণের জন্য এই সম্পর্কের বন্ধনই যথেষ্ট। “প্লিজ আমাদের ধর্ম ত্যাগ করে ভণ্ডামি করতে বলবেন না।”
আমাদের এই পাতানো “হিন্দু—মুসলিম” সম্পর্কের উপর বিভিন্ন সময় আপনারা আঘাত করেছেন। কখনও ধর্মের নামে দুই বাংলা ভেঙে দুই টুকরা করেছেন। এপারের লোক ওপারে গিয়ে বাঙাল হয়েছে। ওপারের লোক এপারে এসে ঘটি হয়েছে। এই বাঙাল আর ঘটিদের কষ্ট ৭০ বছরেও মেটাতে পারেননি আপনারা।
এই আপনারা কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো লুটপাটের চিন্তায়,কখনো বা নারীদের প্রতি লোভে একে অপরের উপরে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করেন। আর আমাদের সাম্প্রতিকতার পাঠ পড়ান। আমরাও মাঝে মধ্যে পড়ি, কিন্তু আবার ভুলে যাই। আপনারা আবার নিজেদের প্রয়োজনে নতুনভাবে পাঠ তৈরি করেন, আমাদের পড়ান। আমরা আবার পড়ি, কিন্তু দুঃখ যে, আমরা মুখস্ত করতে পারি না। কারণ আমরা মানুষ, মনুষ্যত্ব যে আমাদের বড় পরিচয়।