হে পুরুষতন্ত্র, তুমি আছো নিউরণে, তুমি আছো জেনেটিক কোডে!

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল:

১.
বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমার বাবা একবার খুব অসুস্থ, পেসমেকার লাগানো হবে। এখন তখন অবস্থা, সাভার থেকে ঢাকায় আনা হলো। মা, আমার বর ও আমি নিরন্তর বাবার পাশে। বেশ কিছুদিন পর চেকআপে আসলেন আবার। তখন আমার একজন আত্মীয় দেখতে এলেন এবং বললেন, ‘চাচাকে আমাদের বাসায় নিয়ে গেলে হতো, জামাই এর বাসায় ওঠার চেয়ে ছেলের বাসায় ওঠা কি ভালো নয়?’ যিনি বলেছিলেন তিনি একইসাথে উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী, তিনিও কিন্তু একজন লড়াকু নারী, বাস্তবতার সাথে লড়াই করে নিজের পরিবারকে, সত্ত্বাকে টিকিয়ে রেখেছেন, কোনো প্রতিকূলতায় হার মানার মানুষ তিনি নন। তাঁকেও পুরুষতন্ত্র এভাবে ভাবাচ্ছে…..।

এখন আমার প্রশ্ন হলো….

আমাদের দুজনের সংসারে আমার শ্বশুর এবং বাবা, দুজনেই কিন্তু বাবা।
আমার শ্বশুরের যেমন ছেলের বাসা, আমার বাবারও তো তেমনই মেয়ের বাসা।
একমাত্র মেয়ে এবং মেয়ে-জামাই এর চেয়ে কীভাবে ভাইয়ের ছেলে এতোটাই আপন হয়ে যেতে পারে?
আমি মেয়ে বলেই কি তবে এই প্রহসন? আমি একজন ছেলে সন্তান হলে নিশ্চয়ই তিনি সেভাবে ভাবতেন না?

মেয়ে আর মেয়ে-জামাই যখন সবকিছু বাদ দিয়ে বাবার শয্যার পাশে বসে ছিল, সেই ভালবাসা, সেই দায়িত্ব-পরায়ণতা মুহূর্তেই পুরুষতন্ত্রের হাতে বলী হয়ে যায়!
সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, ইশ্ একটা ছেলে থাকলে দৌড়ে গিয়ে কাজগুলো করতে পারতো। স্বামী থাকায় তাও একটু ভরসা!

আমি কীভাবে তাদের বোঝাই যে, আমার এবং আমার বরের পরিবারে আমাদের মায়েরাই বটবৃক্ষ? কী করে বোঝাই যে, লাইনে দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করে আমিও ওষুধ আনতে পারি, বিলটা ঠিকমতো দিয়েছে কিনা এটাও অন্য অনেকের চেয়ে ভালো বুঝতে পারি? কী করে বোঝাই যে, আমার মায়ের ক্যান্সারের সময়ে আমি আমার বাবার সাথে একা লড়েছিলাম?একটাও সুধীজন তখন আমাদের পাশে ছিলেন না। এরকম জটিল মুহূর্তে কিন্তু আমার মা-বাবার একটি ছেলে কেন নেই এজন্য আফসোস হয় না, কিন্তু সমাজের অন্য দশজনের হয়। ছেলে ছেলে করে সমাজ এতোটাই ব্যতিব্যস্ত, আমার তো মনে হয় এখন যে, ছেলে থাকলে হয়তো মায়ের ক্যান্সারও বুঝি হতো না! অথবা ক্যান্সার হলেও একটা ছেলে থাকলে বোধ হয় সারিয়ে দিতো!

২.
আসুন অন্য গল্প শুনি,
ফাতেমা বেগম একজন চাকরিজীবী মা, তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। এক মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দিয়ে তিনি নানাভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন। দৃশ্যত খুবই সুখের সংসার। আসুন ভেতরে একটু ঘুরে আসি….

ফাতেমা বেগম যখন শাশুড়ি তখন-
তিনি অাশা করেন ছেলের বউ সকালে তাদের সবার জন্য নাস্তা তৈরি করে টেবিল সাজিয়ে রাখবে, সে বউ চাকরিজীবী হোক কিংবা না হোক। অথবা ছুটির দিনেও তার অবসর মেলার কী যে আছে সেটা তিনি বোঝেনই না!ছেলের এতো ফোন দেয়ারই বা কী অাছে ঘন্টায় ঘন্টায়, স্বামী তো তাঁরও ছিল, কই এতো গায়ে পরা তো ছিল না! পুরুষমানুষ এতো গায়ে পরা ভ্যাবদা হলে চলে নাকি রে বাবা!

বাসায় রান্না হয়, কিন্তু ছেলে আর বউ মাঝে মাঝেই বাইরে খায়। বাসায় রান্না ফেলে এতো বাইরে খাওয়ার, সিনেমা দেখার কী অাছে!! নিশ্চয়ই ছেলের বউ জোর করে। আহারে ছেলেটা বউ এর জন্য খামোখা টাকা নষ্ট করতে হয়। কাজের লোক আসেনি বলে ছেলের কাপড় ধোয়া হয়নি, ও আল্লাহ গো, ছেলের বউটা একটা লক্ষ্মীছাড়া বই আর কিছু নয়। ছেলে তার বউকে নিয়ে আলাদা নিজের একটা সংসার পেতে চায়, সংসার জ্বালানী বউ এতো খরচা করে অানছে, কেমন ‘মেয়েমানুষ’ সবার সাথে মিলায় থাকতে পারে না!

তিনি আবার নিজেও খুবই প্রগতিশীল, মেয়ে-জামাই তাদের সাথে থাকবেন এটি তাকে আহ্লাদিত করে। আবার ছেলে শ্বশুরবাড়িতে এতো যাওয়ার কী আছে, সেটি তিনি বুঝতে পারেন না! মেয়ে জামাই তার সাথে থাকাকে তিনি সংস্কারকে ভেঙ্গে ফেলা বলে বিশ্বাস করলেও যদি কেউ কখনও তাঁকে বলেন যে, কী মেয়ে জামাই এর সাথে থাকেন, সেটি আবার তাঁর ‘সংস্কারবিহীন’ মানসিকতা মেনে নিতে পারে না! মেয়ে জামাই এর বাসায় থাকবো, সে আবার হয় নাকি? মানুষ বলবে – জামাই বাড়িতে থাকে, কী ‘লজ্জা’!

২.১
এই ফাতেমা বেগমই যখন মা, তখনকার চিত্র খানিকটা ভিন্ন-
সকালে অফিসে যাবার সময় ঘুমন্ত মেয়ের কাছ থেকে সাধারণত তিনি নাস্তা বানিয়ে রাখা আশা করেন না। ‘আহারে মেয়েটা আমারে এতো আরাম করে ঘুমাচ্ছে.. ’ । তাও বা মেয়ের নাস্তা বানানোর বিষয় গ্রহণযোগ্য হলেও ছেলে সকালে নাস্তা বানাবে এটা কেমন কথা, ছেলেটা সারাদিন এতো খাটে!! আর ছেলে যাবে রান্নাঘরে? রান্নাঘর কি পুরুষ মানুষের জায়গা নাকি? আর মেয়ের জামাইটা যা ভালো হয়েছে না, কী যে বলবো! মেয়ের খুব কেয়ার করে। মেয়েটার সুখের সংসার, নিজের হাতে দু’জনের ছোট্ট সংসার সাজানো। সকালে দুজনে অফিসে যাবার আগে জামাইও মেয়েকে নাস্তা বানাতে সাহায্য করে। খুবই আধুনিক অার প্রগতিশীল মেয়ে জামাই হয়েছে। হাজারে একজন এরকম, ছেলে-মেয়েতে আবার আজকাল কেউ পার্থক্য করে নাকি, সবাই সব কাজ করতে পারে। আরে বিদেশে দেখেন না, জামাই-বউ মিলে সবাই ঘরের সব কাজ করে। ওরা আবার মাঝে মাঝে বাইরেও খেতে যায়, এতো ভালোই, এতো ব্যস্ত জীবনে তো রিফ্রেশমেন্টেরও তো প্রয়োজন আছে! আমার স্বামী তো এতো বেরসিক ছিল আর আমার যে শাশুড়ি ছিল, এগুলো কি করার উপায় ছিল? মেয়ে জামাই তো নিজের কাজ নিজেই করে, কত যে স্বাবলম্বী মেয়ের জামাই। ছুটির দিনে তো মেয়েকে কিছুই করতে হয় না, বিশ্রাম নেয় দুজনে, পরে কিছু একটা রান্না করে খেয়ে ফেলে। সুখে থাকুক মেয়ে আর জামাই…..

৩.
ফাতেমা বেগমের কন্যাটি আবার তার যে ভাই আলাদা বাসা নিয়ে থাকছেন, সেই ভাবীর ছোট্ট এক টুকরো সংসারকে নিজের বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস ও দাবি করে। কিন্তু বোনের সংসারটিকে কেন সে নিজের বলে দাবি কখনই করতে পারে না সেটি তার বোধগম্য হয় না! ভাইয়ের সব কিছুতেই তার অধিকার আছে বলে রীতিমতো অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে ওঠে সময়ে সময়ে, কিন্তু বোনের সংসারে সে নিজেকে অতিথি বলে মেনেই নেয়! ভাইয়ের সংসারে সে নিজেকে খুবই দাপুটে কেউ একজন বলে, বোনের বাসায় বেশিদিন বেড়াতেও তার কিছুটা অস্বস্তি হয়, কেন যে! ভাই-ভাবীর ভালবাসা দেখলে কেমন বিরক্তি আসে, নিজের গুরুত্ব নিয়ে কিছুটা ভীতও হয়, ভাবী তার ভাইকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বলে তার রাগে সারা শরীর জ্বলে যায়!! অন্যদিকে নিজের বোন-দুলাভাই এর ভালবাসা, বোঝাপড়া দেখলে আনন্দ পায়, নিজের জীবনও যেন এমনটি হয় সেটা প্রার্থনা করে।

অাবার এই ননদটিও যখন ভাবী, তখন সে একটা নিজের আলাদা সংসার দাবি করে যেখানে তার ননদ অতিথি মাত্র। সে ভাবী হিসেবে হয়তো নিজস্ব পরিধি আশা করে। সেও কিন্তু পরিবার হিসেবে তার স্বামী-সন্তানকে গুরুত্ব দেয়।

৪.
এরকম আসলে প্রতিটি বাইনারি মনস্তাত্ত্বিক চরিত্র….. অামাদের আশেপাশের সব চরিত্র। প্রিয় পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র। সবসময় আমরা শুধু চরিত্রগুলোর দোষ ধরি, কতোই না সমালোচনা। কিন্তু এগুলো শুধুই পুরুষতান্ত্রিক চর্চা বৈ তো আর কিছু নয়! একজন বউ যা পায়নি, তিনি তার প্রয়োগ করেন তার ছেলের বউ এর ওপর, আবার মা হিসেবে তিনি চান তার মেয়েটি যেন তার মতো কষ্ট না পায়। আবার বোনের চিন্তাধারা- যুগে যুগে বাবার পর ছেলে পরিবারের প্রধান হয়ে আসছে, বাবার বাড়িতেই বউ নিয়ে উঠছে, তো বাবার বাড়ি তো তার বোনেরও বাড়ি, বাবার পর সেটা যখন ভাইয়ের সংসার হয়, তো সেটা তখনও তার নিজেরই থাকে। তাই ভাই সেই বাড়িতে থাকুক কী না থাকুক বা পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন বোনের সেই চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া খানিকটা কঠিনই! আবার ভাইকে এই পুরুষতন্ত্রই বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে যে, বোন তো বিয়ের পরেই ‘পর’ হয়ে যায়!

কী জটিল এই কাঠামোগত চর্চা, চাইলে আমি আপনি বের হয়ে আসতে পারি না! যারা চায় তারা কারও না কারও কাছে তো অবশ্যই’দাগী আসামী’ হয়ে ওঠে। এটি একভাবে মনস্তত্ত্বের জটিল বাইনারী কাঠামো, হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে এটি বিস্তার লাভ করেছে। জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে যুগে যুগে চর্চিত হয়েছে, হয়তো হবেও।

এখানে দেরিদার চিন্তার কেন্দ্রে হাইয়ার্কি বা চেইন অব কমান্ড বা শ্রেণি কাঠামো বা আদেশ নিষেধের কাঠামো এর ব্যাপারটিও মুখ্য। নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, উপস্থিত-অনুপস্থিত, ইত্যাকার দ্বৈত বিরোধগুলোতে প্রতি দ্বৈত ইউনিটে একটি আরেকটির উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিধৃত। নারীর উপর পুরুষের,দুর্বল নারীর ওপর সবল নারীর, কালোর উপর সাদার, অনুপস্থিতের উপর উপস্থিতের খবরদারির ব্যাপারটি উঠে এসেছে। এখানে মূলত ‘অর্ডার’কেই সমীহ করে এবং ডিজঅর্ডারকে দাবাতে চায়, পিটাইতে চায়, থাপ্পর মারতে চায়, বন্দী করতে চায়, ঠেঙ্গাতে চায় এবং কনুই মারতে চায়!’ভালোত্ব’ আর ‘খারাপত্ব’র কি নিরংকুশ অবস্থান আছে? স্থান-কাল-পাত্র ভেদে যা ভালো তা-ই মন্দ আবার যা মন্দ তা-ই ভালো নয় কি?

‘অ্যাবসট্রাকট অবজেকটিভিজম’ দেখিয়েছে, চিহ্নের বাস্তব উপাদান থেকে আদর্শ বা মতবাদকে আলাদা করা যায় না। পারস্পরিক সামাজিক আদান-প্রদানের বাস্তব রূপ থেকে চিহ্নকে পৃথক করা যায় না। সমাজের সংগঠিত পারস্পরিক আদান-প্রদানের অংশ হিসাবে চিহ্নকে আমরা দেখতে পাই। এর বাইরে তা অবস্থান করে না। মানুষে মানুষে যোগাযোগ এবং যোগাযোগের নানা ক্রিয়াকৌশল বাস্তব ভিত্তি ছাড়া ঘটে না। সামাজিকভাবে যে চেতনা গড়ে ওঠে তার দ্বারাই মানুষের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ভিত্তিতে ভাষাক্রিয়া গড়ে ওঠে। এখন তো বোঝা গেলো কিভাবে ধীরে ধীরে পুরুষতন্ত্র খুঁটি গেড়েছে?মানুষ যা বলে, কাঠামোগুলোই তার মাধ্যমে তা বলিয়ে নেয়; সেগুলোর উদ্ভব তার নিজের মধ্যে ঘটেনি।

৫.

পোস্ট-মডার্নিজম-এ নারীবাদের পৃষ্ঠভূমি আধুনিকতাকে দেখা হয়েছে পুরুষের চিন্তায়, পুরুষের জন্য, পুরুষের তৈরি। নারী ও পুরুষ উভয়ের চিন্তাভাবনাই নারীবাদ হতে পারে। কে ভাবছে এটা বিচার্য নয়। কী ভাবছে সেটাই মূল আলোচ্য। নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, লেসবিয়ানিজম, নারীর মূল্য, নারীর অধিকার কথাগুলি ‘নারী’ যুক্ত আছে বলেই তা ‘নারীবাদ’ নয়। ‘নারী’কে যুক্ত করে এইসব কনসেপ্ট পুরুষরাই তৈরি করেছে তাদের প্রয়োজনেই। তাই উত্তর আধুনিকতায় নারীবাদ এইসব কনসেপ্ট-এর বিনির্মাণের কথা বলেছে। আমিও বলি পারিবারিক চরিত্রের মনস্তত্ত্বেরও বিনির্মাণ প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক এইসব চিন্তা ও ক্ষমতার কেন্দ্রকে তাই আক্রমণ করতে হবে। এই কেন্দ্রকে বলে পিতৃতান্ত্রিক। বুর্জোয়া তথা পুঁজিবাদী আধুনিকতার মতবাদ যেখানে পুরুষ থাকবে ক্ষমতার কেন্দ্রে, ভাষা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, চিন্তাধারা, দৈনন্দিন চর্চা সবই ক্ষমতার বেষ্টনীতে চাপা পড়ে আছে।

নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক
জার্মানী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.