গ্রামীণ নারীদের টেনে তুলুন শহুরে নারীবাদীরা

দিবা খান:

প্রথমেই আমার পরিচয়টা দেই। তাহলে পাঠকের আমার লেখার প্রেক্ষাপট বুঝতে সুবিধা হবে। আমি দিবা, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করছি।। আমি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার একটা গ্রামে থাকি। আমার গ্রামে আমিসহ মাত্র দুজন মেয়ে অনার্স পড়ছি, আর ডিগ্রীতে পড়ছে দুজন মেয়ে। এই আমাদের গ্রামের নারীদের উচ্চশিক্ষার বর্তমান অবস্থা।

যাই হোক…

তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে উইমেন চ্যাপ্টারে সকল নারীবাদীদের লেখা পড়তে পারি। এজন্যই আমার এ লেখা।

এবার মূল কথায় আসি…

এখনকার সমাজে নারীবাদী বলতে আমি যাদের দেখছি তাদের প্রত্যেকই হয় শহরের, নয়তো বাইরের দেশের।

বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের শহরের মেয়েরা গ্রামের মেয়েদের তুলনায় সবদিক থেকে অনেকখানি এগিয়ে, অনেকখানি অধিকার সচেতন এবং সুযোগ সুবিধাভোগকারি। আমাদের দেশে যে নারী সমাজ একদম পিছিয়ে আছে, তারা হচ্ছে গ্রামের। তাই যেখানে নারীবাদীদের বেশি প্রয়োজন সেটা গ্রামীণ সমাজ।

অজ: পাড়াগায়ে পিছিয়ে পড়া নারীদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা, নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তোলার ব্যাপারে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান করার ব্যাপারে গ্রামেগন্জে গিয়ে কাজ করা উচিত নারীবাদীদের।

কিন্তু বর্তমান নারীবাদীদের সেদিকে কোনো সু-নজর আমি দেখছি না।

তাদের নজরে এখন যেটা পড়েছে সেটা হয় তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে শহুরে নারীদের মধ্যে কিভাবে পাশ্চাত্য বা উন্নত বিশ্বের নারীদের চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দেয়া যায়।

সেটার ভালো দিক অবশ্যই আছে। এতে নারীরা নিজেদের স্বনির্ভরশীল করে তোলার ব্যাপারে আরোও এগিয়ে যাচ্ছেন, নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়তে পারার মত মানসিকতা তৈরি হচ্ছে এবং নারীরা সেই লড়াই করছেন।

কিন্তু নারীবাদীরা বুঝে বা না বুঝে একটা কাজ করছেন তা হলো নারীবাদ দেখাতে গিয়ে একদম পুরুষবিদ্বেষী হয়ে উঠছেন। যেখানে তাদের উচিত ছিল, কিভাবে পুরুষের পাশাপাশি চলে একজন নারী কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবেন বা নিজের অধিকার আদায় করবেন সেটা শিখাবেন বা সেই রাস্তা দেখাবেন। কিন্তু তারা সেটা না করে তারা সমস্ত বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেখানে পুরুষ মানেই একজন শোষক, একজন শিকারী, হিংস্রজন্তু-জানোয়ার টাইপের কিছু। যা আমার কাছে আপত্তিকর।

পুরুষদের একবারে বাদ দিয়ে কিছুই ঠিকঠাক মতো চলবে কী? এটার অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের জন্মের জন্য যেমন একজন নারীর দরকার ছিল, তেমন দরকার ছিল একজন পুরুষের। আর একেবারে পুরুষদের বাদ দিয়ে দিলে নারীদের সমকামী হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। যার ফলাফল আমাদের মতো দেশে যে কতোটা ভয়াবহ হবে তা তো চিন্তারই বাইরে মনে হয়!

আর পাশ্চাত্যের কিছু মারাত্মক দিক বা কিছু কিছু নোংরা বিষয়, যেগুলো আমাদের সমাজ ও দেশিয় সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ সেরকম কিছু ব্যাপার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় মত্ত হয়ে পড়েছেন। যেমন: বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরি এবং সেটাকে “আমার শরীর আমার অধিকার” বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এসব ব্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কার সতীত্ব আছে, নাকি নাই সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আমাদের দেশের মতো একটা দেশে এটা একটা বিরাট ব্যাপার।

কারণ এখনও আমাদের মত দেশে সতীত্বের মাপকাঠি যে কী, আমরা সবাই তা জানি। সেখানে এখনও আমাদের দেশের গ্রামীণ সমাজের শতভাগ মানুষ এমনকি শহরের অধিকাংশ মানুষেরই চাহিদাই কুমারী মেয়ে। যেখানে এখনও বাসর রাতে সাদা বিছানার চাদর পেতে দেয়া হয়।

সেখানে এরকম চিন্তা-চেতণা একটা মেয়ের মাথায় ডুকিয়ে দেয়া মানেই তার ভবিষ্যত বা সংসার জীবনকে ধ্বংস করে দেয়ার সামিল। যদি কোন গ্রামীণ মেয়ে (আমার মত) তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে নারীবাদীদের এইসব চিন্তা-চেতনায় মুগ্ধ হয়ে সে পথ ধরে হাঁটে, তবে পরবর্তীতে সে যে সমস্যায় পড়বে সেটার মোকাবিলায় তার পাশে কয়জন নারীবাদী এসে দাঁড়াবেন?

এ প্রশ্নের উত্তর আমায় কে দিবে?!

আমাদের দেশে এরকম চিন্তা-চেতনার প্রসার সামাজিক মূল্যবোধের ধ্বংস বৈকি আর কিছুই করবে না। যদি নারীবাদীরা নারীদের এ পথ না দেখিয়ে পুরুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন যে একজন নারীর সতীত্বের মাপকাঠি এটা না। বা কী দরকার এই মাপকাঠিরই!

পুরুষদের মতই তো নারীদের শারীরিক চাহিদা রয়েছে এবং এটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করাই পৌরুষ। তাহলে হয়তো চিত্রটা ভিন্ন হতে পারে।

এদেশের পুরুষজাতি যখন কুমারী মেয়ে খোঁজা বন্ধ করবে আর সতীত্বের ছাপ রক্তবিন্দুতে দেখতে চাইবে না, তখন “আমার শরীর, আমার অধিকার” না বলেও একজন নারী শারীরিক ব্যাপারে স্বাধীনতা পেয়ে যাবে। সুতরাং এজন্য পরিবর্তনটা আসতে হবে পুরুষজাতির দৃষ্টিভঙ্গিতে।

তাছাড়া বর্তমানে আরেকটি ব্যাপার নিয়ে খুব মাতামাতি হলো, তা হলো পরকীয়া নাকি স্বকীয়া! আমি বুঝিনি শুধুমাত্র নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে একটা ধ্বংসাত্মক ব্যাপার কিভাবে স্বাভাবিক কিছুতে পরিণত হয়ে যাবে!

যেখানে সবাই জানে একটি পরকীয়ার সম্পর্কের ফলে সৃষ্ট সমস্যা যে পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক পর্যায়ে কতটা ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। সেখানে তারা এসব দিক চিন্তা না করে নাম পরিবর্তনের দিকে গেলেন!

যেন “মদের নাম পরিবর্তন করে পানীয়” বললেই সেটা হালাল হয়ে যাবে এবং এটা সেটা পানযোগ্য বলে ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা করলেন সেটা আমার বোধগম্য হয়নি।

এর জন্য যে তীব্র সমালোচনার মুখে নারীবাদীরা পড়লেন এতেও তো ক্ষতি হলো! এসবে নারীবাদীদের গ্রহণযোগ্যতা একটু হলেও পিছিয়ে পড়লো না?

আমি নারীবাদীদের আহবান করব পাশ্চাত্যের এরকম মারাত্মক চিন্তা-চেতণা আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস না করে গ্রামে আসেন।

গ্রামীণ মেয়েদের জীবনযাত্রার মান দেখে যান। দেখে যান কিভাবে গ্রামীণ কিশোরীদের অনেককেই ঘরের আনাচে-কানাচে আত্মীয়-পাড়াপ্রতিবেশি দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়।

তাদের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনে- এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় দেখিয়ে দেন। গ্রামীণ পরিবারের সবাইকে এসব ব্যাপারে সচেতন করার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলুন।

গ্রামে এসে দেখেন কেন এখনও একটা ১৫-১৬ বছরের কিশোরীকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ৪০ পার করা বিলেতি পুরুষকে বিয়ে করতে হয়। এসব থেকে তাদের পরিত্রাণের পথ দেখান। তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নেয়ার কাজ করেন। স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখান। নারীবাদী আর নারীবাদের নামে পাশ্চাত্যের যেসব দিক আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে তা ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন।

নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করুন আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে। নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করুন গ্রামীণ সমাজে। যেখানে নারীবাদীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

শহুরে নারীদের যে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সে পথ দেখিয়ে গ্রামীণ নারীদের টেনে তুলুন। তাদেরকে আলোর পথ দেখান, উন্নতির শেখরে আরেহণ করার পথ দেখান, স্বনির্ভর করার জন্য যেভাবে পারেন পাশে দাঁড়ান।

তবে কোনো সামাজিক অবক্ষয় ডেকে না এনে।

শেয়ার করুন: