দিনা ফেরদৌস:
আমরা জানি, কাউকে কিছু দিলে সে যদি তা গ্রহণ না করে; তবে জিনিসটি নিজের কাছেই থেকে যায়। যেমন গালাগালির চর্চা চলছে তো চলছেই। কার গালি কে গায়ে মাখে! ভাবনার সাথে না মিললেই গালি। নিজের ভাবনার সাথে সবার ভাবনার মিল থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। যারা ইতিমধ্যে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেছেন, তারা জানেন কিছু লোকের সংস্কৃতিই হচ্ছে গালাগালি। কেউ লিখা পড়ে গালি দেন, কেউ ‘শিরোনাম’ দেখেই।
একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে যেখানে গালি, সেখানে কেন গালাগালি হচ্ছে,তা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। কেউ যদি গালাগালির পরিবেশে বেড়ে উঠেন, তো তার সাধারণ মুখের ভাষাই হবে গালি, এতে তার দোষের কিছু নেই। কিন্তু গালিগালাজ যখন বর্ণবাদী রূপ ধারণ করে, মানবাধিকারে আঘাত করে, তখন সেটা অন্যায়। আর সুস্থ মস্তিষ্কে এসবের প্রতিবাদ না করা, মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া। যার জন্য আমার এই লিখা।
যেমন, যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে পারে না, সে হয়ে উঠে নারীবাদী, নয় হিজড়া। নতুন আরেক বিষয় চালু হয়েছে, নারীবাদীরা দেখতে কদাকার, চেহারায় বয়সের ছাপ, নারীবাদীদের সংসার নেই, এরা স্বামীর সোহাগ থেকে বঞ্চিত। এইসব কি গালি? এইগুলো হচ্ছে সিম্পলি বর্ণবাদিতা। হিজড়া গালি হয় কেমনে, যারা আমাদের সমাজের মানুষ? নারী-পুরুষের বাইরেও যারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাদের ছোট করে দেখার মানে, তাদের মানবাধিকার লংঘন করা।
আবার কেউ কেউ যখন দেখছেন বেশ্যা, মাগী বলে আর নিচের দিকের গালি সংগ্রহ করতে পারছেন না, বা দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, তখন নারীবাদীদের চেহারা কেমন, বয়সের ছাপ পড়েছে কেমন, এইসব হাস্যকর যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নারীবাদীরা দেখতে সুন্দর না, একথা বলার সাথে সাথে নিজেদের চেহারা একটু আয়নায় দেখে নিয়েন এ জাতীয় কথা বলবো না। নিজেদের এতো দুর্বল মনে করি না যে, অন্যের চেহারা নিয়ে সস্তা মন্তব্য করবো! নারীবাদী ছাড়াও আশেপাশে তাকালে দেখবেন, এমন অনেক নারী আছেন; যাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সংসার করা হয়ে উঠেনি। যৌতুকের কারণে বহু পিতা তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না, অনেকের স্বামী অকালে মারা গেছেন (সমাজ তার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়েছে, এখন বাচ্চা-কাচ্চা বড় করাই তার দায়িত্ব, যেখানে পুরুষ হলে বলতো, বউ ছাড়া কি আর সংসার চলে?)। বার বার স্বামীর সংসারে নির্যাতনের ফলে যে মেয়েটি বাধ্য হয়েছে সংসার ছেড়ে আসতে, কেউ কেউ নির্যাতনের ফলে হত্যার শিকার হয়েছে বা আত্মহত্যা করেছে, এদের কী বলবেন? তারা কথা বলেন না, তাই বলে তারা মুক্তি পান আপনাদের হাত থেকে?
স্বামীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত নারীদের জন্য দুঃখ লাগার কথা, কিন্তু উপহাসের কী আছে, আমার বোধগম্য নয়। একজন মানুষের তার মনের মতো মানুষ বা সঙ্গী নেই; যা সকলে কামনা করে, সেখানে তার কষ্টটা নিয়ে আরেক দল রসিকতা করছে, ভাবতে কেমন লাগে নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন। সেটা কি আমাদের এই সমাজের ব্যর্থতা না? একজন রাষ্ট্রের নাগরিকের ভালো থাকার অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি নাই। রাষ্ট্রের নাগরিকের ভালো থাকার অধিকার এইজন্য বললাম যে, রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন কোনো নারী-পুরুষ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়; তখনও আমরা কথা বলতে ছাড়ি না। তার পিছনে লেগে থাকি সে আবার বিয়ে করছে কিনা, নতুন স্বামীর বয়স তার থেকে কম কিনা, হানিমুনে গেল কিনা, ইত্যাদি দেখতে।
আমরা চাই নারী সংসারে ভাল থাকুক বা না থাকুক, সংসার নারীকেই ধরে রাখতে হবে। যার ফলে ভালবাসার জন্যে নয়, সামাজিক সংসার করে বেশিরভাগ নারী-পুরুষ। এই সবের ফলই হচ্ছে পরকীয়া। যা আপনি/আমি না চাইলেও চলবে। সুখের নাটক না, সুখী হওয়াটা জরুরি সকলের জন্যই। যে জন্য কেউ কেউ দিনরাত ঝগড়া করলেও বাইরে বেড়াতে গেলে বা পারলে বাথরুমে বসেও দুজনে ছবি তুলতেই থাকেন। ব্যক্তিগত বলে আর কিছুই থাকে না। তিনারা সুখী মানুষ, এটাই হচ্ছে প্রচারের মূল উদ্দেশ্য (কথাটি সবার জন্য না, যাদের শুধুই সামাজিক কারণে সংসার দেখাতে হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে এই বলা)। অনেকে বেশি ভাল দেখাতে গিয়ে খাল কেটে কুমির আনেন। সমাজের অনেকের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ডিভোর্স দিলে, অনেকের কাছে চেনাজানা হয়ে যান। ফলে সংসারে যতোই অশান্তি থাকুক, ডিভোর্স নিতে বেশিরভাগ নারীরাই থাকেন দ্বিধায়।
এবার আসি চেহারায় বয়সের ছাপ নিয়ে যেইসব মন্তব্য হয়েছে এরই মধ্যে। আরে বাবা, বয়স হলে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়বেই; সে নারী হোক বা পুরুষ যেই হোন না কেন। চেহারা দিয়ে যাদের কাজ কারবার, তারা চেহারার যত্ন নেবে, চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লে তা নিয়ে টেনশন করবে, যেমন; নায়ক-নায়িকারা। নারীবাদীদের কাজ হচ্ছে সমাজ থেকে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পতন ঘটানো, তাদের চেহারা নিয়ে টেনশন করতে হবে কেনো? নারীবাদীদের দেখতে ভালো লাগে না, সেটা অন্য ব্যাপার। ‘যারে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা’। কিন্তু এইসব বলে নিজেদের অবস্থান কোথায় নামাচ্ছেন একটু ভেবে দেখুন।
আর বেশ্যা, মাগী বলে গালি দিলেই তো আর সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এই মাগীরা এই সমাজে বেশ্যাগিরি করেই বেঁচে আছে। আমি বেশ্যা, মাগীদের সম্মান করি। তারা আছে বলেই আমরা রাস্তাঘাটে ইজ্জতওয়ালা হয়ে নিরাপদে চলি। যে সমাজে ছয় মাসের বাচ্চা নিরাপদ না, রাস্তায়-বাসে, কোন অনুষ্ঠানে, ঘরে-বাইরে কোনো নারী নিরাপদ না, যেখানে নারীদের সব সময় নিজের তথাকথিত ‘ইজ্জতের’ কথা ভেবে ভেবে ভয়ে থাকতে হয়, সেই সমাজে কিছু নারী তথাকথিত ‘ইজ্জত’ বেঁচে খায়। সেটা আমাদের লজ্জার। যাদের কাছে তারা সেই ‘ইজ্জত’ বিক্রি করে, তারা আমাদের এই সমাজের কারও বাপ, ভাই, স্বামী হোন। এই বেশ্যারা কাউকে শার্টের কলার ধরে জোর করে তাদের কাছে নিয়ে যায় না, নিজের ইচ্ছাতেই যান তিনারা। যারা দিনের আলোতে এইসব বেশ্যাদের চেহারা দেখলে মনে করেন পরিবেশ নষ্ট, ঈমান নষ্ট হয়, তারাই এইসব বেশ্যাদের খোঁজ রাখেন। আপনাদের ভাষার এই ‘মাগী’রা কিন্তু লাইসেন্স নিয়েই এই কাজটি করে। আপনি ‘লাইসেন্স’ নিয়ে যান তো?
মেয়েদের ডিভোর্স দেখলে গালি দিতে ইচ্ছা হয়,পরকীয়া দেখলে গালি দিতে ইচ্ছা হয়, আর নিজেরা লাইসেন্সধারি বেশ্যাখানায় যান, সেখানেও মেয়েরা কিছু বললে খারাপ লাগে।
আরে ভাই আপনারে বলছি না, যারা যায় তাদের কথা বলছি। কেউ না গেলে বেশ্যাখানাগুলা চলে কেমনে? নারীবাদীরা আপনার ঘরের অবলা বৌ এর মতো না যে, যা ইচ্ছা তাই বুঝায়ে, বসায়ে রেখে দিবেন, সতী নারীর সনদ দিয়ে, যারা দুনিয়াদারির খবর রাখে না। যখন একটা দিয়ে পারেন না, তখন আরেকটা দিয়ে ঘায়েল করা সমাধান না। এখন বলতে যাইয়েন না, নারীবাদীরা নিজেদের অধিকারের নামে রাস্তায় পেচ্ছাবের অধিকার চাইছে। ভাই সাবেরা, পেচ্ছাবের বেগ পেলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই চেপে রাখা কষ্টকর। বিশেষ করে কোনো নারী যখন প্রেগনেন্ট হন। কথা হচ্ছে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও নারীরা পেচ্ছাব কন্ট্রোল করে থাকেন (যদিও কিছু কিছু জায়গায় প্রেগনেন্ট মহিলাদের বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়), যা পুরুষরা করতে পারেন না।
পারলে বলুন যে, রাস্তায় পেচ্ছাব করা কারো জন্যই ঠিক না, কোনো পুরুষ আর ব্রোথেল হোমে যাবে না, যৌনকর্মীরা বুঝুক এই পেশা এখন অচল পেশা। সব পুরুষতান্ত্রিকেরা গালাগালিতে যেমন এক হয়ে যান, তেমনি এক হয়ে বলতে থাকুন, বিবাহিত নারীদের আমরা পাত্তা দেই না। বলতে যাইয়েন না নারী আগুন, পুরুষ ঘি। পাশাপাশি থাকলে গলবেই। যেহেতু বুঝতেই পারছেন নারীরা খারাপ, তাই তাদের এড়িয়ে চলুন। নারীদের দোষত্রুটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখার চেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে নিজেদের সংশোধন করা।
গালিগালাজ আর কুযুক্তি দিয়ে যদি মনে করেন নারীদের থামানো যাবে, তবে ভুল ভাবছেন। আর নারীবাদ পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সব জায়গায় রাগ দেখায়ে, এনার্জি খরচ করতে যাইয়েন না; শেষে আরো কঠিন বিষয়ে রাগারাগি করার এনার্জি খুঁজে পাবেন না। যেমন ছোট বিষয়ে নারীদের বেশ্যা, মাগী গালি দিয়ে এখন বড় বিষয়ে আর গালি খুঁজে পাচ্ছেন না। একবার চেহারা খারাপ, একবার বয়সের ছাপ, একবার নারীর মেনোপজ নিয়ে লাফাচ্ছেন। এর কোনোটাই অস্বাভাবিক না বা আস্বীকার করার উপায় নেই যে কোনো পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীর ক্ষেত্রে। বিশ্বাস না হলে, ঘরে নিজের স্ত্রী, না থাকলে মা, বোন বা ভাবীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েন।