লুতফুন নাহার লতা: চোখের পলকে এক বছর হয়ে গেল! আকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথি থেকে ঝরে গেলেন বড় প্রিয় মানুষটি! আমার প্রথম সিরিজ নাটকের জনপ্রিয় নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদ !
অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসে ! কোন কথাটি বলি আর কোন কথাটি বলি না , আর কোন কথাটি মনে করে যে মন বিষন্ন হয়ে যায় ! কত যে কথা ! নরওয়ে থেকে রওনা হলাম লন্ডনের পথে বন্ধু সালাম ভাই ভাবীর বাসা থেকে বেরুবো এমন সময় টি ভি তে শোনা গেল হুমায়ুন আহমেদের অবস্থা খুব খারাপ, মাজহার মিডিয়াকে জানাচ্ছে পরিস্থিতি ভালর দিকে !
ঘন্টা দুই তিনেকের মধ্যে লন্ডনে পৌঁছে খবর পেলাম চলে গেছেন ! জুলাইয়ের ১১ তারিখে আমি নিউইয়র্ক থেকে আসার কয়েকদিন আগে গেলাম বেলভিউ হসপিটালে তাঁকে দেখতে, কিন্তু তিনি যেখানে আছেন সেখানে সবাইকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না ! সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে,বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁচের ভেতর থেকে তাকে এক নজর দেখার জোর চেষ্টা শেষে একা একা ঘরে ফিরছি , হঠাৎ মনে হল কেউ আমাকে ডাকছে ‘মিস মিলি !’ আমার চোখ বাঁধা মানলো না ! অনেকটা পথ বাস-ট্রেন করে আমি ঘরে ফিরে এলাম !
শেষ দেখা হয়েছিল জামাইকায় তার বাসায় ! সেদিন ছিল বাসন্তী পূজো ! বাসন্তি রঙের শাড়ী আর হলুদ গাঁদা ফুল পরেছিলাম পূজোর অনুষ্ঠানে মঞ্চের উপরে আমার একক পরিবেশনা ছিল বলে ! রাত তখন বেশ হয়েছে ! কেমন উদাস হাওয়া বইছে ! আর আমার মন উথাল পাতাল ! কেবল মনে হচ্ছে কেমন দেখব হুমায়ূন ভাইকে! বন্ধু মুনিয়া মাহমুদ আর নুরুদ্দিন ভাইয়ের সাথে গেছি হুমায়ূন ভাইকে দেখব বলে । বাসায় গিয়ে যখন দাঁড়ালাম বসার ঘরে নিশাদ কেঁদে চলেছে, কারণ নিনিত তাকে ধাক্কা মেরেছে ! আর নিনিত দূরে দাঁড়িয়ে অভিনয় করে দেখাচ্ছে সে কেমন করে ভাইকে মেরেছে ! লজ্জা পেয়ে নিশাদ মার কোল থেকে নেমে দৌড়ে গেল বাবার কাছে ! ক্লান্ত শাওন , কত কত রাত সে ভালো করে ঘুমায়নি ! দিনের পরে দিন ওই মেয়েটির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে অকাল বৈশাখী !
হুমায়ুন ভাই শোবার ঘরে, দেশে কারো সাথে কথা বলছেন ! আমি এসেছি সে খবর পেয়েছেন কিনা বোঝা গেল না ! কিছুক্ষণ পরে এক হাতে নিশাদকে পেটের উপর বেঁধে নিয়ে অন্যহাতে লুঙ্গির গিঁট ধরে খালি গায়ে খালি পায়ে এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে ! কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই এক রকম জোরেই হেসে উঠলাম ! সারা মাথা, মুখ , বুক, পেট বেয়ে নামছে দুধের ধারা ! সব সাদা ! বাবার সাথে বনিবনা না হওয়ায় নিনিত দুধের বোতল ছুঁড়ে মেরেছে আর তা খুলে গিয়ে বাবার মাথায় পড়ে এই অবস্থা !
আমাদের সামনে হাতের কাছে টিস্যু বক্স থাকায় আমি, মুনিয়া, শাওন সবাই মিলে তাকে মুছানোর চেষ্টা করলাম ! উনি এক মুখ হাসি ছড়িয়ে আমার দিকে সরাসরি চেয়ে বললেন ‘ মিস মিলি, আপনার কি কোনোদিন বয়স বাড়বে না !’ সমস্ত আকাশ উঠলো হেসে !পুরো পরিবেশ গেলো বদলে ! কোথায় ভেবেছিলাম হুমায়ুন ভাইকে দেখে কেমন করে কান্না লুকিয়ে হেসে হেসে কথা বলব , মনে মনে তার একটা রিহার্সাল মতো ভেবে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম হুমায়ুন ভাই কে বলব ‘এই সব দিন রাত্রির বাবলু’র কথা ! তার সেই বিখ্যাত ডায়লগ ‘হৈয়ার বাড়ি গেছিলাম, দুধ ভাত দিছিল দুধভাত খাইছিলাম!’ সেই কথা ! বাবলু এই শহরেই থাকে , অনেক বড় হয়ে গেছে —এইসব ,
নাহ সে কথা বলার আর অবকাশ রইল না ! আমিও হেসে বললাম ‘ হ্যাঁ হুমায়ুন ভাই সেই যে আপনি আমাকে মিস মিলি বানিয়েছিলেন, বয়স ওখানেই আটকে আছে !’ রাত বেড়েছে আরো ! ঘরে ফেরার পালা ! বের হয়ে আসার আগে দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়ালেন আমাদের পিছু পিছু—–
ফিরে আসতে আসতে আবার সেই ডাক শুনতে পেলাম ! ‘ মিস মিলি!’ কেমন যেনো নিশি পাওয়া মানুষের মত আমি আমার চারিদিকে তাকালাম ! আমার মনে পড়ল ১৯৮৮ তে আমরা যখন বহুব্রীহি নাটকের কাজ করছি তখন টেলিভিশনে ‘রাজাকার’ শব্দটি বলা যেত না ! কিন্তু কি অসম দৃঢ়তায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের কালাকানুন ভেঙ্গে পাখীকে চরিত্র বানিয়ে সেই পাখীর মুখ দিয়ে সারা জীবনের ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে দিলেন ! বাংলার মানুষ আবার দীর্ঘকাল পরে জ্বলে উঠল ঘৃণায় ! ফিরে যেতে যেতে চোখ বয়ে আমার জলের ধারা নামল ! বিপন্ন বাসনা তবু তাঁর মঙ্গল কামনায় নতজানু হল ! আমি যেনো সারা আকাশ জুড়ে থৈ থৈ পূর্ণিমার ধু ধু জোৎস্নায় হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টিয়ার মুখে সমস্বরে সেই ধিক্কারের স্লোগান শুনতে পেলাম ! তুই রাজাকার , তুই রাজাকার , তুই রাজাকার !!!
বাঙালির গর্ব হুমায়ুন আহমদের স্মরণে আপনার স্মৃতিচারণমুলক লেফাটি পড়ে ভালো লাগলো। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।