সাদিয়া নাসরিন:
হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি পোর্টাল পাঠক বাড়ানোর জন্য খুবই শর্টকাট এবং সস্তা পথে হাঁটতে গিয়ে উইমেন চ্যাপ্টার এর লেখকদের বিভিন্ন লেখা চুরি করে, বিকৃত করে, রগরগে শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করছে। এই ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহ ছিলো এই অধমের। চৌদ্দ মাস আগে উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত “পরকীয়া-স্বকিয়া” বিষয়ক আমার একটি লেখা চুরি করে শিরোনাম পালটে বেশ রগরগে শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করেছে কয়েকদিন আগে। তারপর কয়েকদিন গালাগালির দুনিয়ায় মধুর নহর বইয়ে দিয়েছেন শিরোনামেই পড়া শেষ করা সাধুসন্ত পাঠক সম্প্রদায়।
অনেকে আবার এক কাঠি সরেস। তারা পরকীয়া আর নারীবাদ একসাথে গুলাইয়া স্যালাইন বানিয়ে খেয়ে ফেলেসেন। এদের মধ্যে নারীবাদ বিষয়ক লেখালেখি করেন এমন বন্ধুরাও আছেন। এদের অনেকেই “আমি পরকীয়া জায়েজ করা নারীবাদী না” বইলা ঘোষণা দিয়া নিজের পবিত্রতা প্রমাণ করেছেন। মজার বিষয় হইলো, এনারা কিন্তু আমার মূল লেখাটা চৌদ্দমাস আগেই পড়েছেন। কিন্তু পবিত্রতার ঘোষণা দিতে তাদেরও চৌদ্দমাস লেগে গেলো!
যাই হোক, ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলামেইল নামক সেই অখ্যাত পোর্টালের কাছে কৃতজ্ঞ এই কারণে যে, এই লেখা বিকৃত করে না প্রকাশ করলে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রতিক্রিয়া না দেখলে আমার জানাই হতো না এই বঙ্গদেশের অধিকাংশ নারী-পুরুষই সুফি পর্যায়ের। তাঁরা সবাই পরকীয়াকে অত্যন্ত ঘৃণা করেন। বিভিধ অনুভূতি আক্রান্ত এই সমাজে মনোগামিতার ধাপ্পাবাজিরে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে পরকীয়াকে ঘৃণা করেই নিজেরে সাধু-সুফি প্রমাণ করতে হবে বৈকি!
তবে আমার এই বোকা মাথায় ঢুকে না, যে দেশের অধিকাংশ পুরুষ প্রায় সাধুসন্ত পর্যায়ের, সেই দেশে কীভাবে ‘পতিতাবৃত্তি’ বৈধ হয়, ১১টি রেজিস্টার্ড যৌনপল্লী থাকে, যেখানে প্রায় এক লাখ যৌনকর্মি বৈধভাবে কাজ করেন এবং আরো তিন-চার লাখ অবৈধভাবে ভাসমান যৌনকর্মি হিসেবে কাজ করেন! কীভাবে সম্ভব!! অবশ্য সেই বিকৃত করে প্রকাশ করা লেখাটার নিচে কমেন্ট দেখে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরুষবাদীদের আক্রমণের ভাষা দেখে আমার অনুমান করতে কোন অসুবিধা হয় নাই এই চার-পাঁচলাখ যৌনকর্মির ক্লায়েন্ট কারা এবং তারা সংখ্যায় কী পরিমাণ!
যাই হোক, আসেন মূল লেখায় যাই। তার আগে পরকীয়া শব্দটিকে একটু বিশ্লেষণ করি। অভিধানে ‘পরকীয়’ শব্দটির স্ত্রীবাচক শব্দ হলো ‘পরকীয়া’। যার মানে হলো পর নারীর সাথে পর পুরুষের সাথে প্রেম। এই ‘পর নারী/পর পুরুষ’ হলো যারা বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ নয়। দক্ষিণ এশিয় সমাজ ব্যবস্থায় পরকীয়া বলতে বিবাহ বহির্ভূত বা বিবাহোত্তর শারীরিক কিংবা মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করাকেই নির্দেশ করে।
এবার চলুন পরকীয়ার ইতিহাসটা দেখি। কয়েক যুগ আগেও বহুপত্নিক পরিবার ব্যবস্থা ছিলো, এখনো আছে। সময়ের বিবর্তনে বহুপত্নিক পরিবারের পরিবর্তে ‘এক নারী এক পুরুষের’ যে যৌননিষ্ঠার ধারণার ভিত্তিতে ‘মনোগ্যামি ফ্যামিলি’ বা আধুনিক পরিবার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে, একক বিয়ে প্রথা চালু হয়েছে, বেশিরভাগ পুরুষই সেই যৌননিষ্ঠা পালন করেনি। একক পরিবার গঠন করার পর পুরুষ ব্যাপকহারে শুরু করলো যৌনতা ক্রয়ের সংস্কৃতি। ধীরে ধীরে বসত গড়লো যৌন পল্লী, আবারো স্বীকৃত হতে থাকলো পুরুষের বহুগামিতা, যা আগেও স্বীকৃত ছিলো।
যৌনপল্লীতে থাকতে পুরুষের বেশিদিন ভালো লাগেনি বলে এক সময় শুরু হলো ‘পরস্ত্রীগমণ’। ‘পরস্ত্রীর সাথে প্রেম’ থেকে শুরু হলো পরকীয়া শব্দটির ঘৃণ্যতা। কারণ ‘পরকীয়া’ শব্দটি স্ত্রীবাচক হয়েই নেতিবাচক হয়েছে, যেমনটা হয়নি ‘পরকীয়’। পরকীয়া শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে এর একপাশে থাকা নারীটিকে ফোকাসে দেখতে পাওয়া যায়। এবং নারীটিকে ফোকাসে পাওয়া যায় বলেই এই শব্দটিতে এতো ট্যাবু। যদি ফোকাসটা আরেকপাশের পুরুষটির উপরও সমানভাবে থাকতো, তাহলে সেটা নিশ্চিত “পুরুষমাত্রই বহুগামী” এর মতো স্নেহসুলভ ক্ষমাতে শেষ হতো।
পরকীয়ার সাথে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির একটি ঋণাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। মূলতঃ যেদিন থেকে ‘এক নারী এক পুরুষের’ বিয়ে প্রথা চালু হয়েছে সেদিন থেকেই পুঁজিবাদি-পিতৃতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক-মনোগ্যামাস সমাজে ছত্রাকের ছড়িয়ে পড়েছে অবৈবাহিক সম্পর্ক, যা আগেও ঢিমেতালে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। বিয়ের মতো নৈতিক প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই পরকীয়ার মতো অনৈতিক সম্পর্ক জিইয়ে আছে পুরুষতন্ত্রে। পরকীয়া নিয়ে যে সমাজ এতো ছি: ছিক্কার করছে, পরকীয়াকে গালি দিয়ে নিজেদের তুলসি পাতা প্রমাণ করছে, সেই সমাজটি প্রকাশ্যই বহুগামী।
বহুগামিতা নারী-পুরুষ উভয়েরই স্বাভাবিক প্রাণীজ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু পুরুষতন্ত্র “পুরুষ মানুষ অমন একটু আধটু করেই থাকে” বলে পুরুষের বহুগামিতাকে স্নেহসুলভ ক্ষমা করেছে। আর নারীর মনে যৌনতা নিয়ে ট্যাবু তৈরি করে, শিশুকাল থেকে মগজের মধ্যে ‘বিয়ে’ ঢুকিয়ে দিয়ে তার সামনে প্রতিষ্ঠিত করেছে মনোগ্যামিতার আদর্শ। পৃথিবীর ইতিহাসে পুরুষতন্ত্র নারীকে সবচেয়ে বড় যে ধাপ্পাটি দিয়েছে তার নাম মনোগ্যামিতা, যেখানে যৌননিষ্ঠার দায় শুধু নারীর উপর আরোপিত।
এই দক্ষিণ এশিয় সমাজে ‘পরকীয়া’ যৌনপেশার চেয়েও ভয়ংকর এবং ঘৃণীত। কেন? এই প্রশ্নটি নিয়ে কয়েকজন পুরুষ বন্ধুর সাথে আলাপ করে বুঝেছি, “যৌনকর্মির কাছে যাওয়াটা একজন পুরুষের জন্য পরকীয়ার তুলনায় লঘু অপরাধ। কারণ, একজন পুরুষ যখন একজন যৌনকর্মির কাছে যায়, তারা ধরেই নেন সেই যৌনকর্মিটির স্বামি নেই এবং স্বামীর প্রতি কমিটমেন্ট ভাঙ্গার প্রশ্ন নেই(?), সুতরাং ‘গণিকাগমণ’ সমাজে বিশৃংখলা তৈরি করে না”।
তাদের এই এনালিসিসটা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে এই যে পরকীয়া নিয়ে আমাদের পুরুষ সমাজের ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার, সেটা কি আসলে একজন নারীর তার স্বামীর প্রতি কমিটমেন্ট ভঙ্গ করা নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আতংক থেকে? সমাজে বিশৃংখলা কি শুধু একজন নারী তার স্বামীর প্রতি কমিটমেন্ট বা বিশ্বস্ততা ভঙ্গ করলেই হয়? একজন পুরুষ তার স্ত্রীর প্রতি কমিটমেন্ট ভঙ্গ করে যৌনপল্লিতে না যেতেন, তাহলে কি আমরা এই বিপুল সংখ্যক যৌনকর্মিকে এই পেশায় দেখতে পেতাম? পাশের ঘরে স্ত্রী রেখে কাজের মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা বা করতে চাওয়া স্বামীটি কি তার স্ত্রীর প্রতি কমিটেড থাকেন?
প্রতিদিন যে পরিমাণ নারী ঘরে বাইরে পরকীয়ার অপবাদে অপদস্থ হন, নিপীড়িত হোন, এই সমাজে পুরুষও কি সে পরিমাণ অপদস্থ হোন পরকিয়ার অপবাদে? একজন নারীকে প্রতিদিন সতীত্ব আর বিশ্বস্ততা প্রমাণের যে পরাকাষ্ঠা পার হতে হয়, তা কি একজন পুরুষকেও পার হতে হয়? “পরকীয়া দোষের কিছু না” নামে বিকৃত শিরোনাম দিয়ে যে লেখাটি আমার নামে ছাপিয়েছে ওই পোর্টাল, সেই একই শিরোনাম দিয়ে যদি কোন পুরুষের লেখা ছাপাতো প্রতিক্রিয়া কি ঠিক একই রকমের হতো? গালাগালির ভাষা কি একই রকমের হতো? হুমায়ুন-শাওনের অসম(?) সম্পর্কের আঁচ শাওনকে যতটুকু পুড়িয়েছে, ততটুকু কি হুমায়ুনকে পুড়িয়েছে? আমরা সবাই জানি, না।
এবার আসেন পরকীয়া জায়েজ করা না করা নিয়ে কথা বলি। আগেও বলেছি, আবারো বলি, ‘পরকীয়া’ শব্দটি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার দ্বিমত আছে। দ্বিমতের কারণ এর সংজ্ঞাতেই বিদ্যমান। মানুষ যখন কোন একজনের সাথে সম্পর্কে জড়ায়, তখন সে আর ‘পর’ থাকে না। তাই ‘পরকীয়া’ নামক শব্দ দিয়ে নাক সিঁটকানোর কিছু আমার অন্তত নেই। কিন্তু তার মানে এই না যে, আমি এই ‘অনৈতিক’ ‘অবৈবাহিক’ ‘অসৎ’ সম্পর্ককে জায়েজ করতে বসেছি বা করেছি। ইন ফ্যাক্ট আমি এই সম্পর্ককে জায়েজ করা বা না করার কেউ না। আমি শুধু বলতে চাই পরকীয়া এক ঐতিহাসিক সত্য। ইউসুফ জুলেখা-রাধা কৃষ্ণ- কেনেডি মনরো- লাইলি মজনু থেকে সাম্প্রতিক মনিকা ক্লিন্টন…বিভিন্ন সম্পর্কের বাস্তবতার নাম।
আমার কাছে সম্পর্ক মানেই পারস্পরিক সততা, সে যে কিয়াই হোক না কেন। হতে পারে সেটা বৈবাহিক, একত্রবাসও হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, একই সময়ে একাধিক সঙ্গীর সাথে দাম্পত্য বা যৌন জীবনযাপন শুধু অনৈতিকই নয়, অসৎও বটে। আবার একজন বিবাহিত মানুষ শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কের জন্যই বিয়ে বহির্ভুত সম্পর্কে জড়ান, এটিও সব সময় ঠিক নয় বলেই মানি। বিয়ের আগে যেমন স্বাভাবিক কারণে প্রেম আসে, বিয়ের পরেও ঠিক তেমন স্বাভাবিক মানবিক কারণেই মানুষের জীবনে প্রেম আসতে পারে। এখন অন্য কাউকে ভালো লাগলে স্বামী/স্ত্রীকে “ডিভোর্স দিয়ে দাও” এর মতো সরল টোটকা চিকিৎসা দেওয়ার মতো সরলও নয় বিষয়টি। কারণ এখানে রাষ্ট্রের খবরদারি আছে, আইনের নির্দেশনা আছে।
সন্তানের নিরাপত্তা, কাস্টডি, প্যারেন্টিং ইত্যাদি প্রশ্নও জড়িত আছে এখানে। এই সমাজ, এই রাষ্ট্র এখনো সিংগল মাদার বা ফাদার এর জন্য অনুকূল হয়নি, ডুয়েল প্যারেন্টিং তো শিখেইনি, ‘ওপেন রিলেশনশিপ’ এখানে আতঙ্ক ছড়ায়। এখানে স্বামী স্ত্রী আলাদা হয়ে গেলে সমস্ত ঝড় ঝাপটা চলে যায় বাচ্চাদের উপর। আবার এই বাচ্চার জন্য একজন মানুষ সারাজীবন প্রতি মুহূর্তে সচেতন থেকে, পা টিপে টিপে চলে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে যেতে পারবে, বা যাবে এমনটা নাও হতে পারে। এই পুরো বিষয়টিই আসলে মনস্তাত্ত্বিক। ভাইরে/বোনরে, মানুষের মনস্তত্ব খুব জটিল একটা জিনিস। এখানে হোয়াট শ্যুড বি/ শ্যুড নট বি এর মতো জাজমেন্টাল হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
পরকীয়া বলি আর স্বকীয়া বলি, মূলত এটা পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি। মনোগ্যামিতার ধাপ্পাবাজি দিয়ে আমরা বিয়ের আগের প্রেমকে মহান করি, বিয়ের পরের প্রেমকে বহুগামিতা বলে ঘৃণা করি, এই শিক্ষা পুরুষতন্ত্র আমাদের দিয়েছে। পুরুষতন্ত্র ঠিক করেছে কোন প্রেম বৈধ আর কোন প্রেম অবৈধ। পুরুষতন্ত্র বলেছে, নারীর বিশ্বস্ততা পুরুষের জন্য বেশি জরুরি। কেননা এখানে সন্তানের মালিকানার প্রশ্ন আছে। সামজিক শৃংখলা রক্ষার দায় আছে।
মানেন বা না মানেন, পরকীয়া হলো পুরুষতন্ত্রের বাই ডিফল্ট। সুতরাং বিয়ে থাকলে পরকীয়া থাকবে, বিয়ে না থাকলে পরকীয়া, স্বকীয়া কিছুই থাকবে না। যতোদিন বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটি ধর্মের মন্ত্র দিয়ে প্রেমের মতো মানুষের স্বাভাবিক কোমল মনস্তত্ত্বকে ‘বৈধ অবৈধ’ বলে নিয়ন্ত্রণ করবে, যতোদিন রাষ্ট্র তার আইন দিয়ে ‘প্রেম’কে শুধু স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিয়ে বাকি সব সম্পর্ককে অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত দিবে, যতোদিন সমাজ নারীর গর্ভ ও গর্ভজাত সন্তানের উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বৈবাহিক সম্পর্ককে ইলাস্টিকের মতো টানতে শেখাবে, ততোদিন পরকীয়ার মতো অসৎ সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য হবে মানুষ।
এই বাস্তবতা স্বীকার করা বা না করা আপনার স্বাধীন ইচ্ছা। আপনি বড়জোর জাজমেন্টাল হতে পারবেন, পরকীয়া নিয়ে নাক সিঁটকাতে পারবেন, আইন তৈরি করতে পারবেন, কিন্তু তাতে সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ততা রক্ষার বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে পারবেন না। বিশ্বস্ততার বোধ পারষ্পরিক, এটা আপনিই স্বতস্ফুর্তভাবে আসে। অতএব, পরকীয়ার মহামারী রোধ করতে গেলে আপনাকে বৈবাহিক প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। রোগটা ওখানেই।