মনিজা রহমান:
প্রত্যেকটি আত্মহত্যার ঘটনা আমাকে অপরাধী করে। যে মারা যায় আমার যতোই অচেনা হোক, ফিরে ফিরে মনে হতে থাকে আমার কি করার কিছু ছিল না! আমি কেন আটকাতে পারলাম না তার অকালে চলে যাওয়া!
লাশকাটা ঘরে যখন একজন নারীর শবদেহ দেখি, তখন বিপন্নতার পাশাপাশি নিজেকে ভীষণ পরাজিত মনে হয়। সেই নারী যদি হয় একজন পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মা, তখন আবেগ কোনভাবে বাধ মানে না। নাদিয়া মাহফুজ সুমীর আত্মহত্যার ঘটনার পরে, সময় যত গড়াচ্ছে, অনেক অজানা বিষয় বের হয়ে আসছে। স্বামী কোমায় আছে দেড় বছর ধরে, শিশু সন্তান নিয়ে অসহায়-নিরুপায় মেয়েটি যখন বিধ্বস্ত-বিভ্রান্ত, তখন বন্ধু বেশে এক নরপিশাচ এগিয়ে এসেছিল। সে বন্ধুত্বের মুখোশ পড়ে মেয়েটিকে দুর্বল করে। কিন্তু এক সময় ওই নরপিশাচ পিঠটান দেয়।
শুধু তাই নয়, বুলবুল নামে ওই প্রতারক ও তার সুযোগ্য স্ত্রী, নাদিয়ার নামে এহেন কুৎসা নেই যে রটায়নি। নাদিয়ার বাবার বাড়ি-স্বামীর বাড়ি সবার কাছে ওর বিরুদ্ধে কানভারী করার চেষ্টা করেছে। প্রকাশ্যে সবার সামনে অপদস্থ করেছে। নাদিয়াকে খারাপ-বাজে মেয়ে প্রমাণের এমন কোন চেষ্টা নেই যে ওরা করেনি।
অভিমানে-অপমানে আত্মহত্যা করেও রক্ষা নেই নাদিয়ার। এখন শুরু হয়েছে তার চরিত্র হননের পালার দ্বিতীয় পর্ব। বুলবুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতখানি গড়িয়েছিল এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। তার কতটুকু ভিত্তি আছে কেউ জানে না। নাদিয়া বেঁচে থাকতে কোথায়, কী করেছিল, সেটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ তো আছেই। নাদিয়া বুলবুলকে বিয়ে করেছে, সে মৃত্যুর আগে অন্ত:সত্ত্বা ছিল এমন আলোচনাও শোনা যাচ্ছে। কীভাবে একজন সন্তান সম্ভবা নারীর মৃতদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া আমেরিকান পুলিশ খালাস করে দেয়, সেটাও একটা বিরাট রহস্য!
নাদিয়ার স্বামী মাহফুজুর রহমান খুলনা জেলা সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বুলবুল নামের ওই প্রতারকও ওই সমিতির সদস্য ছিল। নাদিয়া সমিতির বর্তমান কমিটির কর্মকর্তাদের কাছে বুলবুলের নামে বার বার বিচার চেয়েও কোন সমাধান পায়নি। তারা আজ পিকনিক, কাল অমুকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করে কালক্ষেপন করেছে। তিলে তিলে সবাই মিলে নাদিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার নামে নিউইয়র্ক শহরে এক বা একাধিক সংগঠন আছে। সেসব সংগঠনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল জেলার মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু নাদিয়ার আত্মহত্যার ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে তারা শুধু ক্ষমতাবানদের পাশেই দাঁড়ায়, অসহায়দের নয়, তাদের চিন্তা জুড়ে থাকে পিকনিক, ইফতার পার্টি, ঈদ পুনর্মিলনীসহ নানা আমোদ আয়োজন, কোন মানবিক উন্নয়নের কাজ নয়।
নাদিয়া দেশীজ রাইজিং আপ ও মুভিং নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিল। সে কঠিন মনোবলের লড়াকু মেয়ে ছিল বলে জানালো ওই সংগঠনের পরিচালক কাজী ফওজিয়া। পুরো ঘটনায় তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তাঁর ভাষায়, ‘স্বামী রিহ্যাব সেন্টারে কোমায় আছে। নাদিয়া নিয়মিত সেখানে যেত। তারপর সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসে যেত বেনিফিটের জন্য। ছোট্ট শিশু নিয়ে নাদিয়া আমাদের মানবাধিকার সংগঠনের মিটিংয়ে আসতে ভুলতো না। আমি বিস্মিত হয়ে যেতাম ওর প্রাণশক্তি দেখে। ছেলেকে বেবী সিটারের কাছে রাখতে হবে এই ভয়ে সে কোনো কাজ পর্যন্ত করেনি। আমাদের সংগঠনের চার হাজারের বেশী সদস্য আছে পুরো শহর জুড়ে। তারা কেউ কখনই কোথাও নাদিয়াকে তার শিশু সন্তানকে ছাড়া একা দেখেনি। সেই সামিনকে ছেড়ে কীভাবে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারলো নাদিয়া, সত্যি আমার মাথায় আসে না!
‘সমাজের সব খারাপের জিম্মা কি মেয়েদের?’ নাদিয়ার আত্মহত্যার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কাজী ফওজিয়া বলেন, ‘নাদিয়া লড়াই সংগ্রামে ক্লান্ত হয়ে যদি বন্ধু ভেবে কারো প্রতি দুর্বল হয়, এতে দোষের কি ছিল? এ দায় কি তার একার ছিল? পুরুষ মানুষটি কি দায়ী ছিল না? কেন সব সময় আমাদের মেয়েদের নীতি, আদর্শ, ধর্ম, অধর্মের ঠিকা একলা নিতে হয়? অসহায় সময়ে কেউ সমবেদনা জানাতে এলে তার প্রতি দুর্বল হওয়া কি অস্বাভাবিক? কেন এই একটি ঘটনায় তাকে আঘাতে আঘাতে এমনভাবে জর্জরিত করা হয় যে সে নিজের জীবনটাই দিয়ে দেয়। আমরা মেয়েরা এক জীবনে কত আর মূল্য চুকাবো এই সমাজের নিয়ম ধরে রাখতে?’
কাজী ফওজিয়ার করা এই প্রশ্নগুলির আদৌ সঠিক উত্তর মিলবে কিনা জানি না! যে সব পুরুষ সমবেদনার নামে তার মনটা নিয়ে খেলেছে, তাকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে গেছে, সে কি এত সহজে ছাড় পেয়ে যাবে? অবশ্যই না। প্রত্যেকের যে যার অবস্থানে থেকে নাদিয়ার আত্মহত্যার জন্য যে বা যারা দায়ী, তাদের শনাক্ত করে শাস্তির দাবি করা উচিত ছিল। একটা মেয়ে কতখানি মানসিক যন্ত্রণায় পুড়লে, আত্মহত্যার আগে শিশু সন্তানকে বলতে পারে ৯১১ এ ফোন করে পুলিশকে খবর দিতে! কিন্তু, তার বদলে আমরা কী করেছি? আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নাদিয়ার চরিত্রে কতভাবে কালিমা লেপন করা যায় সেই চেষ্টায়।
পাঁচ বছর শিশুকে অসহায় রেখে মায়ের এভাবে চলে যাওয়া অনেকে মেনে নিতে পারেনি। আত্মহত্যার আগে কি মানসিক অবস্থা ছিল নাদিয়ার? ঠিকই তো কীভাবে এটা পারলো একজন মা? এই নিয়ে কথা বলেছিলাম সাইকোথেরাপিস্ট নাসির আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘আত্মহত্যার সঠিক কারণ আসলে কখনই জানা যায় না। তবে সুইসাইড নোট গবেষণা করে মনোবিজ্ঞানীরা পাঁচটি কারণ সনাক্ত করেছেন- ১. অন্যের বোঝা হয়ে থাকার ভ্রান্ত ধারণা, ২. তীব্র আবেগ, ৩. কষ্ট থেকে পালানোর চিন্তা, ৪. ভিন্ন এক সমাজ বা পৃথিবীর স্বপ্ন থাকা (শিল্পী সমাজের মধ্যে এটা বেশী হয়), ৫. অসহায়ত্ব।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিপ্রেশন বা বিষন্নতার কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ ডিপ্রেশনে থাকা অবস্থাতে মানুষ এতোটাই দুর্বল থাকে, সে রীতিমত শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে, আত্মহত্যা করার মতো শক্তি থাকে না।’
আত্মহত্যা অনেকটা সংক্রামকও! নাসির আহমেদ একটা চমকপ্রদ তথ্য দিলেন। কোন কমিউনিটিতে একজন আত্মহত্যা করলে এই ঘটনা বার বার ঘটতে পারে। তাই কাউকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কিংবা বিষন্নতায় আক্রান্ত দেখা গেলে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রাইমারী ফিজিশিয়ানের রেফারেন্স নিয়ে মানসিক রোগের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। তার বেঁচে থাকার কারণগুলি তাকে জানাতে হবে। আর কোনো মেয়ের স্বামী এভাবে অসুস্থ হয়ে কোমায় থাকলে তার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সাহায্য পাওয়া যায়। ফেডারেল ফান্ডের ডিজঅ্যাবিলিটি বেনিফিট আছে। এর বাইরে ফুডস্ট্যাম্প, বিভিন্ন শেল্টার হাউজ আছে। তাই এখানে, এই দেশে আত্মহত্যার কারণ কখনও আর্থিক সংকট হতে পারে না। সমস্যা যদি হয়, তবে সেটা মানসিক সংকট থেকে।
যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাসটা খুব জরুরি। একজন পুরুষ যেভাবে স্বাবলম্বী হয়, নারীরা নিউইয়র্কে এসে সেই বাংলাদেশেই থেকে যায়। ভিনদেশে বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকার মতো আত্মবিশ্বাসী সে হয়ে ওঠে না। নাদিয়ার কথাই ধরুন। তার মধ্যবয়সী স্বামী বাংলাদেশে গিয়ে বয়সে প্রায় ২০ বছরের ছোট এক তরুণীকে বিয়ে করলো। বাংলাদেশের পাত্রীপক্ষ পাত্র আমেরিকায় থাকে এই আনন্দে বয়সটা গৌণ মনে করলো। বিয়ের পরে নাদিয়াকে তার স্বামী কোনো চাকরি করতে দেয়নি। কলেজ কিংবা কোর্সে ভর্তি করায়নি। সাধারণ গৃহবধু করে রেখেছে। এক সময় মধ্যবয়সী স্বামী যখন হার্ট এ্যাটাক করে কোমায় চলে গেল, তখন তরুণী নাদিয়া অথৈ সাগরে পড়লো। তার সেই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এগিয়ে এলো হাঙর-কুমিরেরা। আর এভাবে শেষ হয়ে গেল এক হতভাগা নাদিয়ার জীবন! তারপর মৃত্যুর পরেও রেহাই নেই তাঁর। এখন চলছে নাদিয়ার চরিত্র হরণের পালা।