প্রেম, বিয়ে, পরকীয়া জীবনেরই একটি অংশ

শিল্পী জলি:

একুশ বছরের একটি মেয়ে দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। বর্তমানে তার মানসিক চিকিৎসা চলছে যেনো আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে না বসে। বাবা-মায়ের চাপের মুখে মেয়েটিকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হয়েছিল। বাবা-মা চাপ দিয়েছিলেন, যদি সে তাদের কথায় বিয়েতে রাজী না হয় তাহলে তাদের মরা মুখ দেখতে হবে। ফলে বাধ্য হয়ে মেয়েটি নিজের পাঁচ বছরের প্রেমকে অস্বীকার করে বাবা-মায়ের ঠিক করা ছেলেটির সাথে বিয়েতে রাজী হয়। এমনকি বিয়ের আগে প্রেমিকটিকেও জানাবার সুযোগ দেয়া হয় না তাকে যে সে বিয়ে করে ফেলছে।

বাবা-মাকে খুশী করতে বিয়ে করলেও বরকে সে কখনও মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও বরটি মানুষ ভালো তবুও বিবাহিত জীবনে তার প্রেমিকই তার মন জুড়ে বসে থাকে। সে তার বরকে জানায় সব কথাক্ষমা চেয়ে বলে চেয়েও ভালোবাসতে পারছে না, বাবা-মায়ের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল, চাপের মুখে বিয়ে করেছে, ছেলেটিও তখন ছিল না যে অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতো।

বিয়ের দেড় বছরের মাথায় একদিন প্রেমিকটির সাথে তার আবার দেখা। ছেলেটি জানায় তার প্রতি তার ভালোবাসা এখনও আগের মতই অটু্ কেননা প্রেম জীবনে একবারই হয়। এখনও তাকেই ভালোবাসে সে এবং মেয়েটির যদি দশটি সন্তানও হয় তবুও তার ভালোবাসা কমবে না কোনদিন। স্বামীকে ছেড়ে চলে আসতে বলে সে। মেয়েটিও যেহেতু বরকে ভালোবাসেনি, আগের তুলনায় পরিণত হয়েছে, সাহস কিছুটা বেড়েছে তাই বরকে বলে ডিভোর্স নিয়ে নেয় অতঃপর প্রেমিকের সাথে বিয়ে।

বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় মেয়েটি জানতে পারে ছেলেটি আগেই বিয়ে করেছিল, এমনকি একটি ছেলেও রয়েছে তার কিন্তু তাকে বলেনি সে যদিও এত কিছু হতে প্রায় এক বছর লেগে গিয়েছিল। বর্তমানে ছেলেটির কথা, পোষালে থাকো, না পোষালে যাও যেখানে খুশী সেখানে, আমি আমার বউবাচ্চা ছাড়বো না। মেয়েটিও বলে না তার বউবাচ্চা ছাড়তে। তবে সব কিছু দেখে এবং বুঝে মেয়েটি এখন মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেবার বার ছুটছে আত্মহত্যা করতে। বলে, আগের বরটি ভালো ছিল, কিন্তু কোনদিন তাকে ভালোবাসতে পারিনি। আবার প্রেমের নামে এখন অযথা এমন এক বাচ্চার বাবাকে বিয়ে করলাম, যে আমার কথা কোনদিন ভাবেইনি। এখন না পারছি তাকে ভালোবাসতে, না পারছি ভুলে যেতে। নিজেকে শুধু অপরাধী মনে হচ্ছে !

সম্প্রতি, পরকীয়া নিয়ে নানা মুমিনের নানা মত পড়লাম। যেটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো তাদের অধিকাংশেরই পরকীয়ার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, তথাপি লিখেছেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। প্রত্যেকেই বলতে গেলে এক কথায় প্রকাশের মতো পরকীয়ার একটি কমন সূত্র দিয়েছেন, ‘আগে ডিভোর্স করো অতঃপর পরকীয়া !’ 

মানুষের জীবনের হাহাকার, জটিলতা, এবং আমাদের সমাজের বাস্তব প্রেক্ষাপটটি বিবেচনায় না এনেই এই মতামত দিয়েছেন অথচ আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়েই পরনির্ভরশীল এবং পরনির্ভশীল মেয়েরা চাইলেই ডিভোর্স করতে পারে না। তাদের আগে একটি আশ্রয় খুঁজে পেতে হয়। 

তাছাড়া, প্রেম বা পরকীয়া কখনওএসো পরকীয়া করিবলে কী হয়
নাকি বিষয়টি বলার অনেক আগেই মনের গুদগুদি শুরু হয়ে যায়
‘পরকীয়া করবো’ সেই উদ্দেশ্যে যদি মানুষ ঘর ভাঙতে শুরু করে দেয়, তাহলে সেটাকে হাস্যকর কৌতুক ছাড়া আর কিছুই মনে হবার কথা নয়। 
তাছাড়াপরকীয়া ঘটাবোএই অজুহাতে আদালতে কি ডিভোর্সও গড়াবে?

পরকীয়া ঘটে যাবার পরই মানুষ হয়তো ডিভোর্সের দিকে ঝোঁকে। তথাপি হুটহাট না ছোটাই ভালো, কেননা পরকীয়ার গভীরতাটিও উপলব্ধি করা জরুরি, যার জন্যে দরকার শান্ত হয়ে নিজের মনের মাঝে ডুব দেয়া, নিজেকে বোঝা, পার্টনারকে বোঝা, সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি। তাছাড়া পরকীয়াতেও প্রকৃত ভালোবাসার হিসেব করা জরুরি, মানুষটিকে চেনা জরুরি। কেননা পরকীয়া প্রেম প্রেম হলেও একেবারে বরবাদী প্রেমএতে মানুষের জীবননাশের আশঙ্কা বেশী।

তাই মন খোঁয়া গেলেও একটু সময় নিয়ে ঘোর কাটিয়ে বোঝা জরুরি জীবনে এই প্রেমের মূল্য কতখানি? এর ভবিষ্যত কী? পরিণতি কোথায়? সুখের সম্ভাবনা কতোটুকু? পার্টনারটি নির্ভরযোগ্য কী না ? সর্বোপরি, আদৌও ভালোবাসে কী না ? নাকি শুধু বাহানা অথবা শরীরের টান ? শুধু শরীরের টান হলে সময় নিলে সেটি কেঁটে যায়। দুজনার মন ছুঁলেই শুধু চিন্তার কথা!

যেহেতু আমাদের সমাজে ছেলেদের বদনাম কম, ধর্ষণেও তাদের সাজা হতে চায় না, ধর্মমতে চার বিয়ে লিগ্যাল এবং অনেক ছেলেই পরকীয়াকে ‘জাস্ট ফর ফানহিসেবে যখন তখন চালিয়ে দিতে পারেন, তাই মূলত মেয়েদের পরকীয়াকেই ফোকাস করবো আমি।

প্রথমত মেয়েদের পরকীয়া শুধু দৈহিক তাড়না নয়। তেমন হলে জনে জনে সম্পর্ক গড়েই মেয়েদের পক্ষে অতি সহজে শারীরিক সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। অনেক মেয়েই বিবাহিত জীবনে হতাশা, না পাওয়া, অবহেলা, অত্যাচার থেকে জীবনের চাওয়া-পাওয়া মেলাতে গিয়ে পরকীয়ায় জড়িয়ে যান। প্রতিটি পরকীয়ার কেসই আলাদা, কিন্তু অধিকাংশই পরিকল্পিত নয়। তাই জাজমেন্টাল না হয়ে বিষয়টি বোঝা এবং প্রয়োজনে সহযোগিতা প্রদান করা হয়ত বেশী ফলপ্রসূ।

একজন শিক্ষিতা, সুন্দরী, ভদ্র মেয়ের পরকীয়ার খবর জানতাম, যার বিবাহিত দীর্ঘ জীবনে পুরো সময়টিতেই বরের চরিত্র খারাপ ছিল। এমনকি কাজের মেয়েকেও প্রেগনেন্ট বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরে স্ত্রীটির প্রেম হয় তার সাথে যে কলেজ জীবনে তাকে অতি পছন্দ করতো বলে পাশে এসে দাঁড়ায়, কেয়ার করতে থাকে। ভালোবাসার এই গভীরতার খোঁজ পেয়ে তারও প্রেম হয়ে যায়, বিয়েতে রাজী হোন তিনি। বিয়েও করেন। এই বরেরও বেশ ভালোই আলুর দোষ আছে, কিন্তু তিনি বোঝেননি। তিনি যদি আরেকটু সময় নিতেন, তাহলে হয়তো এমন সম্পর্কে জড়াতেন না।

আরেক মেয়ের বর দিনরাত বউকে পেটাতো। ভাসুরজা মিলেও সেই মার ঠেকাতে পারতেন না। পরে মেয়েটি পরকীয়ায় জড়িয়ে বাচ্চা নিয়ে ভেগেছে সংসার থেকে। সে এখন বরবাচ্চা নিয়ে বেশ ভালো আছে, যদিও পরকীয়াতে অধিকাংশ মেয়েই ভালো থাকে কম। কেননা প্রেম বা পরকীয়া যাই হোক না কেন, খুব কম ছেলেই মেয়েদের মনের কদর বোঝে। বিয়ের পর আর কথা রাখে না।

আরেক মেয়ের বর বিবাহিত জীবনে পনের/ ষোল বছরের প্রতিদিন কথায় কথায় বলতো, তোকে ডিভোর্স দেবোরান্নায় দেরী হলে ডিভোর্স, ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে ডিভোর্স, শাশুড়ি অসন্তুষ্ট হলে ডিভোর্স…. বলতে গেলে দিনে দশবার ডিভোর্স হয় তাদের। ডিভোর্সের ভয়েই মেয়েটির একদিন পরকীয়া প্রেম হয়ে যায়। এখন বরটি দিনরাত মরতে যায়, আর বলে, বউ তোকে কত ভালোবাসি, আর তুই কিনা! এখনও তাদের বিয়ে টিকে আছে, কিন্তু সুখ নেই। মেয়েটি বলে, কোনদিন জানিনি যে সে আমায় একটুও ভালোবাসতো, জানলে কোনদিন পরকীয়া হতো না!

সিলসিলা মুভি দেখলে এবং হন্যতে পড়লে অনেকেরই বোঝার কথা পরকীয়াতেও মানুষের একটি গভীর প্রেম অনুভূত হয়। যেটা শুধুই শরীরকেন্দ্রিক নয়। আবার এমনও দম্পতি আছে যারা আজীবন পার্টনারকে ঘৃণা করে জীবন পার করতে থাকেন। অতঃপর একজন পরকীয়ায় জড়ালে তাদের উপলব্ধিতে আসে তারা একে অন্যকে আসলেই ভালোবাসে, পরকীয়ার সাথীকে নয়, কিন্তু এতোদিন বোঝেনি। বুঝতেই তারা পরকীয়া ছেড়ে আবার নতুন করে ভালোবাসায় জড়ায়।

আমাদের দেশে ছেলেমেয়ের সম্পর্ককে যেহেতু শুধুই শরীরকেন্দ্রিক করে দেখতে শেখানো হয় তাই পরকীয়া এত ঘৃণিত। কিন্তু পরকীয়াতেও মানুষ আত্মার খোঁজ করে, আরেকবার বাঁচতে চায়জীবনের সার্থকতা খোঁজে, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলায়, নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করে, বোধদয় হয়, এবং অনেকেই হয়ত সত্যিকার অর্থে আবার নিজের সংসারে ফিরে আসে যখন দেখে একটু হলেও আসল কেয়ারটি সেখানেই।

প্রেম, বিয়ে, পরকীয়া জীবনেরই একটি অংশছিল, আছে, থাকবে। পরকীয়াতেও প্রেমিকপ্রেমিকারা আসল প্রেমের জাজ করতে থাকে। আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে সময়ই বলে দেয়, প্রেমের কতদূর, পরিণতি কী
মানুষের মন হারায় আবার হয়তো ফিরেও আসে, কেননা জীবন জটিল
একে কোনো সংজ্ঞাতেই ফেলা যায় না

শেয়ার করুন: