নারীর যোগ্যতা-অযোগ্যতার সনদ দেয়ার অধিকার কারও নেই

হাবিজাবি গল্পকার:
আমার মাকে আমি কোন দিন দেখিনি আমার বাবাকে নাম ধরে ডাকতে। শুধু মা নয়, চাচী, জেঠি, ভাবি, পড়শী কাউকেই না। সবাইকে দেখেছি তাঁদের স্বামীকে প্রভু হিসেবেই মানতে, সম্মান করতে। এমনকি স্বামীর সাথে ঝগড়া করলেও কোন দিন নাম ধরে ডাকার সাহস দেখায়নি। এটি যে শুধু আমার পরিবার বা আমার এলাকার দৃশ্য তা নয়।
আমাদের বাঙালি বা ভারতীয় নারীরা নিজেদের এতো বেশি দূর্বল ভাবেন যে ভুল করেও স্বামীর নাম মুখে আনেন না। যদি স্বামীর অমঙ্গল হয়, যদি স্বামীর অসম্মান হয়, যদি স্বামীর নাম নেয়াতে আল্লা ভগবান অসন্তুষ্ট হয়! শহরের শিক্ষিত কিছু নারী নাম ধরে ডাকলেও অধিকাংশ নারীই গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত নারীর মতো স্বামীকে ডাকে অমুককের আব্বু, তমুকের ভাই, উনি, এই শুনছেন, কিগো শুনছো বলে। পরিচয় করিয়ে দেয় আমার হাজব্যান্ড, আমার স্বামী, তিনি বলে। 
এটা নারীর দোষ নয়। এটা আমাদের হাজার বছরের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি, ধর্মীয় কালচার, পুরুষতান্ত্রীকতার ফসল। নারীরা জন্ম থেকেই দেখে আসছে নারী পুরুষের অধীনস্থ, পুরুষের জিম্মাস্থ, পুরুষের হুকুম পালনকারী হিসেবে। আর পুরুষ নিজেদের প্রভু ভেবে এসেছে সারাজীবন। ভেবে এসেছে নারী দুর্বল, নারী অযোগ্য, নারী অশিক্ষিত, নারী কম বুদ্ধিমান, নারী সেবাদাসী। ওদের কাজ সন্তান জন্মদান, সন্তান পালন, স্বামী সেবা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, রান্না করা।
আর সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে স্বামীর মঙ্গল কামনা করা, স্বামীর সাথে অন্যায় না করা। দেখে এসেছে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে আজীবন কপালে সিঁদুর দিয়ে লাল করে রাখতে হয়। ফলে নিজেও রাখে। হাতে চুড়ি, বালা, শাঁখা, নাকে নাকফুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় প্রভু সেবা ও মঙ্গল কামনায় সার্বক্ষণিক সচেতন আছে!
পুরুষ তো কোন দিন তার স্ত্রীর মঙ্গল কামনা করে, ভালবেসে, সম্মান করে নারীর জন্যে কিছু করেনি, নিজের শরীরে বাড়তি কিছু ব্যবহার করেনি, স্ত্রীর নাম নিলে অমঙ্গল হবে ভাবেনি। তবে নারীকেই কেন ছাড় দিতে হবে? বাড়তি সম্মান দেখাতে হবে? 
যদি বলেন নারী কর্মক্ষমতায় পিছিয়ে, শিক্ষায় পিছিয়ে, স্বনির্ভরতায় পিছিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে দুুর্বল, শারীরিকভাবে দুর্বল, তবে বলতে হয় কাদের কারণে নারীর এই দুর্বলতা, এই পিছিয়ে থাকা? নিশ্চিত এর জন্যে দায়ী পুরুষ, দায়ী পুরুষতন্ত্র, দায়ী পুরুষ শাসিত সমাজ। দায়ী পুরুষের চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, চাপিয়ে দেয়া নিষেধাজ্ঞা।
নারী কাজে বের হলে পিছন থেকে একশ পুরুষ চেঁচিয়ে বলবে, মাইয়া মাইনষেরে কাজ করতে কে কইছে? তোমার স্বামী নাই? ছেলে নাই? ভাই নাই? নারী শিক্ষার জন্যে বের হলে পিছন থেকে মা, বাবা, ভাই টেনে ধরে বলবে, তোমার শিক্ষার প্রয়োজন নাই। বিয়ে হলে স্বামীর ঘরে গিয়ে কাজ করেই খেতে হবে। বসিয়ে তোমাকে কেউ খাওয়াবে না। তোমার প্রয়োজন শিক্ষার চেয়ে ভালো রান্না শেখা, আদব কায়দা শেখা, ঘরদোর কীভাবে পরিষ্কার রাখা যায় তা শেখা। চাকরি করতে চাইলে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি উঠতে বসতে বাধা দিয়ে বলবে, তোমার চাকরির কী প্রয়োজন, রোজগারের কী প্রয়োজন? স্বামী কি মারা গেছে নাকি অক্ষম? নাকি কোন কিছুর অভাব আছে তোমার? 
নারী কিছু করতে চাইলে, ধরতে চাইলে শিক্ষিত অশিক্ষিত সব পুরুষ বাধা দিয়ে বলে এটা করো না, এটা বলোনা, ওখানে যেও না। ও কাজ তোমার জন্যে নয়। তুমি দূর্বল, তুমি অযোগ্য, তুমি ভুল করবে। আমাকে করতে দাও। এই করে করে পুরুষ নারীর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে তার দ্বারা কিছু হবে না। সে পারবে না, সে দুর্বল, তার গায়ে শক্তি নেই। নারীও পুরুষের কথা মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয়, থামিয়ে দেয়, করতে ভয় পায়। জানে সে পারবে তবুও সাহস পায় না। যদি ভুল হয়, যদি পুরুষ কিছু বলে। 
এই যে, যদি ‘পুরুষ কিছু বলে’ ভয়টাই নারীর প্রধান শত্রু। নারীর শক্তি প্রদর্শনের শত্রু, নারীর স্বনির্ভরতা অর্জনের শত্রু। যতদিন নারীকে পুরুষ এই ভয় দেখিয়ে রাখবে যে পুরুষকে প্রভু মনে করতে হবে, পুরুষ নারীর চেয়ে শক্তিশালী –বুদ্ধিমান, নারীর চেয়ে পুরুষের সম্মান পাওয়ার অধিকার বেশি, নারী পুরুষের অধীনস্থ থাকবে ততদিন নারীর আর সবল হয়ে উঠা সম্ভব না। দূর্বল হয়েই থাকতে হবে। পুরুষকে ভাবতে শিখতে হবে যে নারী পুরুষের তুলনায় মোটেও দূর্বল নয়, কম বুদ্ধিমান নয়, কম দক্ষ নয়। পুরুষের চাকরি, ব্যবসা, কাজ করার যেমন ক্ষমতা আছে, যোগ্যতা আছে, শক্তি আছে, বুদ্ধি আছে তেমনই নারীরও আছে। নারী আলাদা কিছু নয়। পুরুষ যেমন মানুষ নারীও তেমনই মানুষ। কেউ কারো প্রভু হতে পারে না, হুকুম করার ক্ষমতা রাখে না, বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারেনা। 
নারীকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে পুরুষকে আলাদা করে সম্মান দেখানোর কোন কারণ নাই। যতটুকু সম্মান পুরুষের প্রাপ্য, যতটুকু সম্মানের সে যোগ্য ততটুকুই দেখাবে। বিনিময়ে ততটুকু আদায় করে নিবে। নারী পুরুষের সব কথা এক বাক্যে মেনে নিবে বলে যে মানসিকতা পুরুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করছে তাকে বিদায় করে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে তাঁর স্বযুক্তি, স্বচিন্তায় নিজের কাজ করে যাবার জন্যে মুক্ত করতে হবে।
পুরুষের যেমন অধিকার আছে নিজের ভালো মন্দ নিজের ঠিক করা তেমনই নারীরও অধিকার আছে নিজের কাছে যা সঠিক মনে হবে, ভালো মনে হবে তা করার। পুরুষের বুঝতে হবে কেউ কারো শত্রু নয়। পুরুষের স্বনির্ভরতায়, মুক্তভাবে চলায়, নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়াতে যেমন নারীর কোন ক্ষতি হয় না তেমনি নারীর স্বনির্ভরতা, মুক্ত ভাবে চলায়, নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়াতে পুরুষের কী ক্ষতি হবে? পুরুষকে বুঝতে হবে কেউ কারো শত্রু নয়, মনিব নয়, কেউ কারও উপর চেপে বসার অধিকারও রাখে না।
সমাজ পরিবর্তনের জন্যে, পুরুষের প্রতি নারীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্যে, নিজেদের অধিকার, সম্মান আদায় করার জন্যে পুরুষকে যেমন লড়াই করতে হয় না, রুখে দাঁড়াতে হয় না তবে নারীকে কেন তাঁর অধিকার আদায়ের জন্যে, সম্মান আদায়ের জন্যে, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্যে রুখে দাঁড়াতে হবে? পুরুষকে যেমন নিজের যোগ্যতা দেখানোর জন্যে প্রমাণ দিয়ে কোন খোলস ভাঙ্গতে হয়না, নারীকে কেন নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে? পুরুষতান্ত্রিকতার খোলস ভাঙ্গতে হবে? নারীতো পুরুষের কোন কাজে বাধা দেয় না, এগিয়ে যাবার পথে পিছন থেকে টেনে ধরে না তবে নারীকে কেন পুরুষ কথা কথায় বাধা দেয়, ঈর্ষাকাতর হয়, এগিয়ে যাবার পথে পিছন থেকে হাজার পুরুষ টেনে ধরে? তবে কি পুরুষের চিন্তায় ঢুকে গেছে নারী পুরুষের সমকক্ষ হলে তার হাজার বছরের ক্ষমতা হারাতে হবে, অধীনস্থ, সেবাদাসী করে রাখা সম্ভব হবে না? 
পুরুষ কালে কালে নারীকে দমিয়ে রাখার ফলে নারীর মানসিকতায় যে দুর্বলতা বাসা বেঁধেছে সেই দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠার জন্যে পুরুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। পুরুষকেই প্রমাণ করতে হবে নারীর প্রতি বাধা হয়ে দাঁড়ানোর যে মানসিকতা সে বহন করছে সেটা ভুল। বিশ্বাস করতে হবে পুরুষের যেমন যোগ্যতা আছে তেমনি নারীরও আছে। কেউ দুর্বল নয়, কেউ কারো অধীনস্থ নয়। কেউ কাউকে যোগ্য–অযোগ্যতার সনদপত্র দেয়ার অধিকারও রাখে না। 
শেয়ার করুন: