সঙ্গীতা ইয়াসমিন:
বাংলাদেশে এখন ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। যদিও ঠিক এখন শুরু হয়েছে কথাটি বলা ভুল হবে। শুরুটা হয়েছে অনেক আগেই, এখন আমরা জানছি অনেক বেশি, রিপোর্ট হচ্ছে বেশি, জনসমক্ষে আসছে বেশি, মিডিয়াগুলো সোচ্চার হচ্ছে বেশি। সাধারণ মানুষও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, লিখছেন, কথা বলছেন।
কিন্তু তারপরেও কি এর কোনোরূপ প্রতিকার হচ্ছে? কারো চৈতণ্যে কি এতোটুকু হাওয়া লাগছে? সৎ বাবা, নিজের বাবা, শিক্ষক থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম কেউ কি বাদ আছে এই তালিকায়?
যখন দেখি, নিজের বাবার কাছে কন্যা সন্তান নিরাপদ নয়, তখন এ বেদনার কথা কার কাছে বলি? মনে মনে কি আমি তখন কেবল সেই ঘৃণিত পুরুষটাকেই ঘৃণা করি? নাকি আমার নিজের পিতাকেও ওই পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ঘৃণা করি? আমার তো মনে হয়, এখন মায়েরা কন্যা সন্তানকে তাদের বাবাদের কাছেও আর নিরাপদ ভাবতে পারছেন না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে কেবল ত্রিকোণ ছোট্ট একটা মাংসের শরীর, যার খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে এক বিশালদেহী অতিকায় পুং দণ্ড! যেখানে কোন বালাই নেই বয়সের, সম্পর্কের, সম্বন্ধের কিংবা আইনের!
আমি খুব অসহায় বোধ করি। একধরনের বোবা কান্না গুমরে মরে ভেতরে আমার। প্রতিটি ঘটনায় আমি নিজেকে বসাই ভিকটিমের স্থলে। কখনো আমি ওদের মা, কখনো বড় বোন কিংবা কখনো আমি নিজেই ভিকটিম! কারণ আমিও যে নারী! ধর্ষণ যে নারীর কোথায় লাগে, নারী জন্ম না হলে সে যন্ত্রণা বোধ করি আর কারো হবার কথা নয়। যদিও আমি জানি না দু’লাইন লিখে আদতেই এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব কিনা, কিন্তু হৃদয়ের ক্ষরণ তো কিছুটা হলেও ঘুচাতে পারি, তাই এই প্রয়াস।
সম্প্রতি বগুড়ায় ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাটি সারাদেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যার ফলে প্রশাসন বাধ্য হয়েছে তুফান সরকার ও তাঁর সহযোগীদের গ্রেফতার করতে। কিন্তু এতে কি সত্যিই আমাদের আশান্বিত হবার কিছু আছে? কারণ, আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে, ক্ষমতার দাপটে এরা ঠিকই বেরিয়ে আসবে, আর আবার এমন যথেচ্ছাচার করবে। এমন প্রমাণ আমাদের দেশে ভুরি ভুরি আছে। ধর্ষণ আমাদের সমাজে নিতান্তই মামুলী ব্যাপার!
যে সমাজে সেই শৈশব থেকেই মেয়েকে শেখানো হয় অন্যের মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর দেহ-মন তৈরি করতে, যে সমাজে মেয়েরা কোনোকালেই মানুষ হিসেবে পরিগণিত হয়নি, যে সমাজে নারীর বিদ্যা-বুদ্ধির চেয়ে শারীরিক সৌন্দর্য্য প্রাধান্য পেয়েছে সর্বকালে, সেই মাটিতে তো ধর্ষণের বীজ বরাবরই ছিল। কেবল একটাই পার্থক্য যে, ১৯৭১ এ যুদ্ধের নামে ‘পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দোসর বাঙালী রাজাকাররা’ করতো, আর এখন ওদেরই ঔরসজাতেরা ঘরে-বাইরে, অফিসে-আদালতে, রাস্তায়-বাসে আনন্দের ফ্রি অনুষঙ্গ লাভের জন্য ধর্ষণ করে বেড়াচ্ছে।
দেশের চলমান অস্থিরতা আর অরাজকতায় প্রায়শই মনে হতো আমাদের আরেকটি ৭১ দরকার। ৭১ এ যুদ্ধ ছিল বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে, এবার দরকার ঘরের শত্রুর বিরুদ্ধে। এখন মনে হচ্ছে সে যুদ্ধ কেবল নারী-কিশোরী-তরুণী-কন্যাশিশুর শারীরিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যেই দরকার! সে যুদ্ধে দুর্বল-অবলা নারী শুধুই একা! তাই শারীরিক শক্তি দিয়ে নয়, এখন সকল গর্ভবতী মাদের উচিৎ আল্ট্রাসনো করিয়ে মেয়ে শিশুর ভ্রুণ হত্যা করে ফেলা! আর এটাই হতে পারে প্রতিবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ! ক্ষোভ প্রদর্শনের উত্তম পন্থা! নারীকেই কেনো নারী হয়ে জন্মানোর জ্বালা ভোগ করতে হবে?
আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ধর্ষণ নিছক আনন্দেরই কর্ম! ছেলেপিলেরা বয়সকালে অমন একটু-আধটু করেই থাকে; এ জাতীয় মন্তব্য আমাদের সমাজেই চালু আছে! অপরপক্ষে মেয়েরা আজকাল উচ্ছৃঙ্খল হয়েছে, মেয়েদের পোশাক, মেয়েদের অবাধ চলাচল, আচার-আচরণ সবই ধর্ষণের জন্য দায়ী এমন প্রচলিত ভাবনা আমাদের সমাজ মানসের বহু যুগ থেকেই।
মনে পড়ে বনানীর ঘটনায় অনেক মহাত্মারা বলেছিলেন, মেয়েগুলো কেন গেল হোটেলে? এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু কিছু মানুষের নয়, গোটা সমাজকেই প্রতিনিধিত্ব করে, যা ধর্ষণকে উৎসাহিতই করে প্রকারান্তরে।
যারা নারীকেই নানাভাবে দায়ী করেন ধর্ষণের দায়ে, তাঁরা দয়া করে বলবেন আমায় চার বছরের সেই ছোট্ট শিশুটি, যাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা করা হলো, তার কী অপরাধ ছিল? এমন চার/পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যা আজ কোনো নতুন ঘটনা তো নয়! কোনোরকম পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যায় গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে এই ঘটনা। আর অতি দুঃখের সাথেই বলতে হয়, অধিকাংশ ঘটনার নায়কেরাই ছিলেন ক্ষমতা-অর্থ-প্রতিপত্তি আর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, যাদের টিকিটি পর্যন্ত ধরা যায়নি, কিন্তু সেসব ভিকটিমের জীবন হয়েছে দুর্বিষহ! যার খবর আমরা কেউই আর রাখিনি।
এমন অসংখ্য ঘটনায় প্রশাসন মামলা নেয় না, নিলেও অপরাধী ধরা পড়ে না, কিংবা ধরা পড়লেও কিছুদিন পরে ছাড়া পেয়ে যায়। আমরা গাজীপুরের এক হতভাগ্য পিতার কথা জানি, যিনি বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আমরা তানহার কথা জানি, পূজার কথা জানি। যে শিশুর এক্কা দোক্কা খেলার বয়স, হাতে বইখাতা আর রঙ পেন্সিল নিয়ে বিনুনী দুলিয়ে ফ্রক পরে স্কুল যাবার সময়; তাকে কিনা পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় এই জঘন্য লালসার শিকার হয়ে? আর সেইসব নোংরা নর্দমার কীটগুলো মাথা উঁচু করে বসবাস করে এই বাংলাদেশে! কে নেবে এসব হত্যার দায়? যদিও এর দায় আমাদের সকলের; তবুও দিনশেষে এই জঘন্য অপকর্মের দায় রাষ্ট্রকেই তো নিতে হবে!
আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য, রাষ্ট্রের দায় নেয়া তো দূরে থাক, উপরন্তু আমরা দেখি আমাদের মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন আগাগোড়াই থাকে নীরব, অনেক দায়সারা কথাবার্তা বলে, দায়িত্ব এড়িয়ে যান, খোঁড়া যুক্তি দিয়ে ঘটনাকে আড়াল করে রাখে। প্রায়শই আমাদের দায়িত্বপূর্ণ কর্তাদের মুখে শোনা যায়, ধর্ষণ কি আর কোথাও হয় না? এটি পৃথিবীর সকল দেশেই আছে।
আছে বৈকি! তবে এমন নির্লজ্জতার সাথে ধর্ষণের মহোৎসব নেই পৃথিবীর কোথাও।
আমাদের ধর্ষণের আইনে কোনো বাস্তবসম্মত পরিবর্তন হয়েছে কি? আইনের বিধানে কি কোনো উল্লেখযোগ্য শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে যাতে করে ধর্ষকের বুক কেঁপে উঠবে এই জঘন্য কর্মটি করার আগে? একবার হলেও ভাববে সে এটা করলে তার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,এই ফিচার লিখতে লিখতেই বিবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে জানলাম,ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ধর্ষককে জনসম্মুখে গুলি করে হত্যা করে ধর্ষণের বিচার করলেন সেনাবাহিনীর সদস্যগণ।
জানি আমি, এটাকে আপনারা বর্বরতা বলবেন; কিন্তু যখন মা-মেয়েকে ধর্ষণ শেষে মাথা মুড়িয়ে রাস্তায় হাঁটানো হয়, তাকে আপনারা কী সভ্যতা বলবেন? সুতরাং, আমাদের দেশেও ধর্ষণ প্রতিরোধে এমন কঠোর শাস্তির বিধান হওয়া উচিৎ বলে আমি অন্তত মনে করি।
কথায় বলে, বিষে বিষক্ষয়! যেমন কুকুর তেমন মুগুর! আজকের বিশ্ব সভ্যতায় মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কথা উঠেছে অনেক আগেই, কিন্তু একইভাবে ধর্ষণ এবং হত্যাও কি মানবাধিকার বিরোধী নয়? এ বিষয়ে আমাদের আইনপ্রণেতাগণ, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞগণ আরো গভীরভাবে ভেবে দেখবেন বলে আশা করি।
কেউ কেউ ধর্ষণের জন্য দায়ী করছেন পুরুষতন্ত্রকে, কেউ কেউ বলেছেন এ বিষয়ে সমাজ মনোস্তাত্ত্বিক গবেষণা দরকার, কেউবা বলেছেন, ধর্ষণের জন্য দায়ী অবাধ ইন্টারনেট-পর্নো দেখার সুযোগ! কেউ বা বলেন আমাদের হতাশা, ভেতরের জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা, না পাওয়া ইত্যাদি! আমি বলি, আমাদের আইনের শাসনহীনতা, আইনের অপপ্রয়োগ, বিচারহীনতা এবং ন্যায়বিচারের অভাব, ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের দুর্বলতা তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ঔদাসীন্যতা। হ্যাঁ, এগুলোই মূখ্যত ধর্ষণকে উৎসাহিত করছে অধিক হারে।
এমতাবস্থায় সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসবে কেন এই ঔদাসীন্যতা কিংবা আইনের দূর্বলতা? অতি সহজ কথায় এর জবাব, মস্তিস্কে যখন পচন ধরে তখন তা ছড়িয়ে পড়ে দেহের সবখানে। আমাদের সমাজ দেহে বহু আগেই ক্যান্সারের জীবাণু বাসা বেঁধেছিল। যখন দরকার ছিল তাদেরকে রেডিও থেরাপি দেওয়ার,বিনিময়ে তাদেরকে আরও কন্ডিশনাল এনভাইরনমেন্ট দেওয়া হয়েছে যাতে করে তাঁরা বেড়েছে তেলে-জলে দ্বিগুণ হয়ে দলে দলে। সংখ্যায় আজ তারাই বহুগুণ! সুতরাং আজ তারাই ছড়িয়ে পড়েছে দেখের সবখানে! যখন ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষে একদল ক্ষমতালোভী, পদলেহনকারী উন্নাসিক রাজনৈতিক দল বসে থাকেন, যারা গদি হারানোর ভয়ে সবকিছুর সাথে আপোষ করেন, তাঁদের কাছে এর বেশি আর কী আশা করবে জাতি?
তবু স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ! আমাদের স্বপ্নে পদ্মা ব্রিজ হয়, স্বপ্ন দেখি মধ্য আয়ের দেশের, স্বপ্ন দেখি অধিক জিডিপির, অধিক মুনাফার! আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বৈকি! কিন্তু সেসব ছাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রুমকিরাও! কে টেনে ধরবে এদের রাশ? আজ উন্নয়নের স্রোতে ভেসে চলেছে সব; তালে তাল আর পালে হাওয়া দিয়ে! স্রোতের বিপরীতে কেবল একটিই লাইন স্বপ্ন ভাঙা বেদনায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে; পূর্ণিমা, কল্পনা, স্মৃতিকণা, তনু, খাদিজা, সুমাইয়া, তানহাসহ আরো নাম না জানা কতশত মুখ…!
পরিশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে দুটো কথাই বলতে চাই- একটিবার পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব থেকে উঠে এসে, ক্ষমতার বাইরের পৃথিবীটা দেখুন। শুনতে পাবেন তনুর মায়ের আর্তনাদ! দেখবেন তানহার ছোট্ট শরীরটা যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে বাঁচার কী আকুতি! শুনবেন খাদিজার মায়ের আহাজারী! একবার ‘মা’ হয়ে উঠুন! একবার নারী হয়ে উঠুন! আর সেই মা হয়ে ওঠা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার সুস্পষ্ট আহ্বান, যা এখন সময়ের দাবী!
১। অবিলম্বে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী এনে এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান।
২। ধর্ষণ প্রমাণে ভিকটিমের সাক্ষ্যই যথেষ্ট হবে এমন বিধান।
৩। ধর্ষণের মামলা অগ্রহণে কিংবা অপরাধীকে গ্রেফতারে ঔদাসীন্যতায় জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির বিধান।
৩। ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত বিচার আইনের মাধ্যমে দ্রুততার সাথে বিচারের বিধান।
অন্যথায় ভেসে যাবে আপনার ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৪০, ভেসে যাবে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের ফানুস! ভেসে যাবে সকল উন্নয়ন বিপরীতমুখী স্রোতের তোড়ে! পরিকাঠামো যতই চকচকে হোক, ভেতরের পিলারে রড-সিমেন্ট-বালুর পরিমাণ আনুপাতিক হারে না হলে ধসে পড়বে অচিরেই সব মুখ থুবড়ে।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই-আপনার সকল ভিশনে শিশুকন্যা-তরুণী-যুবতী-নারী বাঁচবে মানবাধিকারে, মাথা উঁচু করে! বুভুক্ষু শেয়ালের মুখের গ্রাস হয়ে নয়!!
সঙ্গীতা ইয়াসমিন, লেখক, টরন্টো, কানাডা