বিয়েতে আইনি চুক্তি লঙ্ঘিত হলে কাফফারা দিতে হয় নারীকেই

জাহানারা নুরী:

গালাগাল করেন কেন বন্ধুগণ? উইমেন চ্যাপ্টারের একটা আর্টিকেল নিয়ে এতো সময় ব্যয় করেন? বি পজিটিভ। ডিমলায় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। কম করে গোটা দশেক ধর্ষণ সমাচার আজকের পত্রিকায় পাবেন। হাজার হাজার নারী ও শিশু ধর্ষণ নিয়ে একটা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন না! আপনারা তো ইচ্ছে করলেই পারেন।

ভাইরে পরকীয়া নিয়া একটাই কথা। বিবাহ একটা আইনী চুক্তি। এই চুক্তির অধীনে চুক্তির শর্ত মেনে নারী-পুরুষ উভয়ে বিবাহ নামক যৌথ জীবন যাপন শুরু করে। আপনি এই চুক্তির শর্তের বাইরে যেতে হলে আইন অনুযায়ী চুক্তি বাতিল করে দিন। আপনি মুক্ত। চুক্তির ভেতর যতক্ষণ আছেন আপনি প্রচলিত আইনের অধীন। বিবাহকালে অন্য পুরুষের বা নারীর সাথে প্রেম মানে মন বা মসজিদ ভাঙ্গা না, আইনী চুক্তি ভাঙ্গা। এই চুক্তির বাইরে যেসব বিবাহ সে সবই প্রথা বা রিচুয়াল মাত্র। সেগুলোকে খুব বেশী হলে বলা যায়, ডকুমেন্টহীন এ্যারেঞ্জড লিভ টুগেদার। 

রাষ্ট্রের আইন না মানলে আপনাকে কাফফারা দিতে হবে। কিন্তু লিভ টুগেদার আপনার ও আপনার পার্টনারের পারস্পরিক মনময় ঘনিষ্ঠতার অধীন। যতক্ষণ এটা আপনাকে সুবিধা দেয়, আপনি থাকেন। অসুবিধা হলে পুরুষ পরকীয়ায় যান কিম্বা আরও তিনটা আনডকুমেন্টড রিলেশনে জড়ান। সমাজ তাকে অনুমোদন দিয়েছে। এই অনুমোদন সমাজ নারীকে দেয়নি। কারণ ধর্ম দেয়নি।

বিবাহ যারা করে তাদের ভেতর লিখিত চুক্তি থাকুক, আর না থাকুক, ধর্মের নিয়ম দ্বারা এ সম্পর্কের ভেতর আবদ্ধ মুসলিম নারী নিয়ন্ত্রিত। শরিয়া যাকে বলে। আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ‘পরিবার’ বলতে স্ত্রী বোঝায়। অথচ আইন বলে পরিবার একসাথে বাস করার এমন এক আয়োজন যাতে নারী পুরুষ সঙ্গমের সামাজিক অনুমোদন লাভ করে এবং তাদের সন্তান সে পুরুষের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

মনে রাখুন, শরিয়া কিন্তু কোনো আইন নয়। মুসলিম পারিবারিক আইন বলতে যা বোঝায়, তা আইনের নামে ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণ এবং পুরুষের সম্পত্তি পরিবারের গণ্ডিতে রাখার নানা কৌশলের একটা মাত্র। জনৈক পাকিস্তানী সেনাপ্রধান একে রাষ্ট্রীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ করেছেন। আসলে তো এটা একটা গোত্র শাসনের রীতি মাত্র।

আসল কথা হলো, বিবাহঘটিত যেকোনোও আইনি চুক্তি ভঙ্গ হলে, কাফফারাটা নারীকেই দিতে হয়। পুরুষ যে কোনও আইন ভাঙ্গতে পারে। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, পুলিশ, পুরুষের মা বাবা, ভাই-বোন বন্ধু আত্মীয়-স্বজন এতে কিছু মনে করে না। পুরুষ তো, এক আধটু না ১০০ ভাগই আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাবার কাজগুলো করতে পারে।

নারী এমন কী পরকিয়ার জন্য তালাক পর্যন্ত দিতে পারবে না, যদি না তালাকনামা রেজিষ্ট্রিকৃত থাকে। যদি না সে তালাকনামার তালাক ক্লজে, যিনি স্বামী হবার জন্য বিবাহ সভায় এসেছেন, তিনি তার হবু স্ত্রীকে তালাকের লিখিত সম্মতি দেন। দুনিয়াতে এমন যুক্তিহীন আইনহীন আইন এই একটাই আছে! আইন বানায় রাষ্ট্র, কিন্তু নারীর রাষ্ট্র তিনিই, যিনি বিবাহ করতে এসেছেন-একজন ব্যক্তি। নারী তালাক দিতে পারবে কিনা সে অনুমোদন দেবে একজন পুরুষ-যিনি নারীটিকে বিবাহ করতে যাচ্ছেন। বিশ্বের এই প্রথম ও শেষ ওয়ান্ডার একমাত্র সৌভাগ্যবান মুসলিম নারীগণের জন্যই নির্ধারিত!

এই যে অন্যায় জাস্টিফিকেশন, এর মধ্যে আপনি আমি আমরা সবাই জড়িত। অপরাধীকে পার পাইয়ে দেবার সংস্কৃতির চর্চা আমরাই করি। এই ছোট্ট উদাহরণ থেকে ভাবতে শুরু করলে দেখবেন কেন এই দেশের কোনও অপরাধীই এখন আর অপরাধ করে লজ্জা পায় না, সংকোচ বোধ করে না। কারণ সে জানে তার ইমপিউনিটি আছে; সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয়, আইনগত কিম্বা ব্যক্তিক, অথবা দলীয়, এমনকি গোত্রগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ইমপিউনিটি আইনের শাসনকে একটা প্রহসনে পরিণত করেছে।

চুক্তি রক্ষা করা সভ্য সমাজের একটা নৈতিক মানদণ্ড। সমাজ যদি সভ্যতার বাইরে চলে যেতে থাকে, সবাই চুক্তি ভাঙ্গবে। সভ্যতার এমনতরো নানা মানদণ্ড বিশ্ব মানব তৈরি করে মানবসমাজের মানুষের অধিকারের একটা সহনীয় লেভেল নির্ধারণ করতে চাইছে। তা প্রয়োগ, সমস্যা, উত্তরণ, উন্নয়ন চলছে। যদি আপনি আমি সর্বোচ্চ মানদণ্ডটা মেনে নিই, সে প্রক্রিয়ায় সহযোগিতাই করা হয়। 

যদি ব্যত্যয় হয় তাকেও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ মানদণ্ডেই বিচার করা চাই।

শেয়ার করুন: