বিধবা তো বিধবাই, হোক ‘বাঘ-বিধবা’ বা ‘স্বাভাবিক’ বিধবা

আনা নাসরিন:

বাঘ দিবস গেলো কয়েকদিন আগে। বাঘের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হলো; আলোচনা হলো বাঘ বাঁচানোর নানা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে। এই দিবসের আলোচনায়ই একটা নিউজ পোর্টালে এসেছে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্টোরি – বিপন্ন বাঘেরই কারণে কীভাবে কিছু নারীর জীবনই বিপন্ন হয়ে ওঠে। এরা পরিচিত ‘বাঘ-বিধবা’ বলে।

সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে যাদের জীবিকা, যেমন মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ, কাঠ কাটা এসব কাজে গিয়ে যেসব মানুষ বাঘের পেটে যায় তাদের স্ত্রীদেরই বলা হয় ‘বাঘ-বিধবা’। যে পুরুষদের বাঘের মুখে মৃত্যু হয়, তাদের স্ত্রীদের অপয়া অপবাদ দিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে তাড়ানো হয়। শুধু তাই নয়, দিনের শুরুতে তাদের চোখে দেখাও লোকে অমঙ্গলকর মনে করে।

এদেরকে সাধারণত কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকে দাওয়াত দিতে চায় না, যদিও বা কেউ দাওয়াত দেয় তাহলেও খেতে দেয়া হয় সবার শেষে। এদের সাথে কেউ মিশতে চায় না, এমনকি কথাও বলতে চায় না। বেঁচে থেকেও এরা মৃতের মত জীবন যাপন করে। যদি স্বজন থেকে থাকে এরা হয়তো বাবার ভিটায় গিয়ে আশ্রয় নেয়, নয়তো অন্যত্র গিয়ে কোনোমতে মানবেতর জীবন বহন করে। (বিস্তারিত – http://www.banglatribune.com/country/news/228607)

এটা অবশ্য হবারই কথা ছিলো। স্বামীর উপস্থিতিতেই যেখানে নারীদের হাজারো লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অবজ্ঞা, অসম্মান ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়, সেখানে কোনো নারীর স্বামী যদি অপঘাতে মারা যায়, সেক্ষেত্রে তার অবস্থা কী হতে পারে ধারণাই করা যায়।

ব্যাপারটাকে একটু ভিন্নভাবে দেখা যাক। যে শাশুড়িটা অপয়া বলে মৃত ছেলের বউকে বাড়ি ছাড়া করে তারই নিজের মেয়েটার যদি একই দশা হয়, প্রচলিত ভাষায় স্বামীকে খেয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে মায়ের বাড়িতে ফেরত আসে তাকে কি বের করে দেয়া হবে? সেও তো অপয়া। মজার ব্যাপার হলো এক্ষেত্রে কিন্তু তা হচ্ছে না। বাঘ বিধবারা বাবার বাড়িতে ঠিকই আশ্রয় পেয়ে থাকে (যদি থাকে)।

তবে কি আসল ব্যাপারটা এই যে মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে অনাকাঙ্খিত, চক্ষুশূল বলেই এই সুযোগে তাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়? আচ্ছা যদি আবার একটু অন্যভাবে দেখি যদি সামাজিক নিয়মটি উল্টো হতো, যদি পুরুষদেরকে বিয়ের পর শ্বশুরালয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে হতো! এই পুরুষের স্ত্রীটি যদি বাঘের পেটে যেত, সেই পুরুষকে কি ‘স্ত্রী খেকো’ উপাধি দিয়ে একইভাবে সমাজ বিতাড়িত করতো? সম্ভবত না, কারণ শ্বশুরালয়ে অবস্থানরত পুরুষের ওপর তেমন কোনো শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে না, শ্বশুরালয়ে অবস্হান করা নারীর ওপর যা ঘটে থাকে হরহামেশা। শুধুমাত্র অশিক্ষিত প্রান্তিক শ্রেণীর ক্ষেত্রেই যে ব্যাপারটা এরকম তা নয়।

ধরে নিলাম কোনো নারী বিধবা হলেন যার স্বামী অপঘাতে মারা যাননি এবং সেই নারী সুন্দরবন এলাকার মতো কোনো প্রান্তিক এলাকার নন, আর্থ-সামাজিকভাবেও প্রান্তিক নন। এরকম ক্ষেত্রেও কি সেই নারী চাইলে বিধবা হবার পরে শ্বশুরবড়িতে সম্মান নিয়ে থাকতে পারবেন? কিংবা আদৌ থাকতে পারবেন?

বিধবাদের পরিণতি সব সমাজে, সব শ্রেণীতে মোটামুটি একই, ভিন্নতা শুধু মাত্রাগত; হোক নারী ‘বাঘ-বিধবা’ কিংবা ‘স্বাভাবিক’ বিধবা। কোনো সমাজে কোনো সময়েই শ্বশুরালয় নারীর জন্য নিরাপদ, নমনীয় ও সম্মানজনক কখনও ছিল না আজও নয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.