নারীবাদ অথবা নারী, কার প্রতি বিদ্বেষ?

জান্নাতুল মাওয়া আইনান:

জনৈক লেখকের সমালোচনা করতে গিয়ে তার পাঠক লিখেছে, “আপনি মেয়েদের মতো লিখেন।” 
আমি অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করছি, মেয়েদের মত লেখা আবার কেমন? সেদিন হুমায়ূন আহমেদের একটা সাক্ষাৎকার পড়লাম। এই বিখ্যাত লেখক একসময় কবিতা লিখে পত্রিকায় পাঠাতেন। তবে সেগুলোতে তিনি নিজের নামের বদলে তার বোনের নাম দিতেন। কেন এই কাজ করতেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানালেন, “কবিতাগুলো তেমন সুবিধার ছিল না, পুরুষ কবির কবিতা হিসেবে চলে না, মহিলা কবির কবিতা হিসেবে চলতে পারে”। 

বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক কবিতারও জেন্ডার খুঁজে বেড়ান। তার কাছে কোনো কবিতা নারী, কোনো কবিতা পুরুষ। হুমায়ুন আহমেদের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই। তিনি অসাধারণ লেখক। তার একটা অসম্ভব কোমল মন আছে। তার লেখা উপন্যাসকে কেউ ‘অপন্যাস’ বললে সেই সৃষ্টিশীল কোমল মনে তিনি প্রচণ্ড আঘাত পান। অথচ, সেই তিনিই নারীর সৃষ্টিশীলতা নিয়ে হুট করে কটাক্ষ করে বসলেন।

আমাদের আজকের যুগের মোটামুটি জনপ্রিয় বেশ কিছু পুরুষ লেখকও দেখি একই ধরনের চিন্তায় আক্রান্ত। তাদের কেউ কেউ নিজেরা প্রতি ঘন্টায় একটি করে ছবি পোস্ট করেন। গড়ে প্রতিদিন একবার করে প্রোফাইল ছবি পাল্টান, গভীর রাতে ফেসবুক লাইভে এসে কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। এসবের কোন কিছুতেই এটা প্রমাণিত হয়না যে তিনি বিখ্যাত হবার জন্যে, লাইক কামানোর জন্যেই এইসব কাজ করছেন। 

কিন্তু খুব দুঃখের সাথে দেখা যায় তার গল্পের নারী চরিত্ররা বিখ্যাত হবার জন্যে যা নয় তা করে বেড়ান। যে নারীরা ঋতুস্রাব বিষয়ক লেখা প্রকাশ্যে লিখেন তাদেরকে একহাত নেয়ার জন্যে তিনি সুদীর্ঘ রচনা প্রকাশ করে এটাই জানাতে চান যে এই নারীরা শুধু দুটো লাইক কামানোর জন্যেই এক কাজ করছে। যে নারীরা রাস্তায় ঘাটে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নিয়ে লিখেন তাদেরকেও তার কাছে মনে হয় লাইকের কাঙ্গাল!

এই কবি কিংবা লেখকের কাছে নারী শুধুই রমণীয় বস্তু, যার বয়স পঁয়ত্রিশ পার হলেই তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে হয়! এদের কাছে নারী কখনো সহকর্মী নয়, সে শুধুই অনুপ্রেরণা দাতা; যে কি না শুধু ধানি রঙা শাড়ি পরে ‘আমার জন্যে কী লিখেছ’ বলে আল্লাদী করবে। সেই ধানিরঙা শাড়ির মেয়েই যদি লিখতে বসে যায় কিংবা বিখ্যাত হতে চায়; সেই কবি কিংবা লেখক তাকে নিয়ে অবশ্যই হাস্যরস করবেন। মেয়েরা আবার লেখালেখি কেন করবে? মেয়েরা কেন বিখ্যাত হতে চাইবে? বিখ্যাত হবার একচেটিয়া অধিকার তো শুধু পুরুষ কবি কিংবা লেখকদের আছে। মেয়েরা শুধু ওদেরকে চা আর সিঙ্গাড়া বানিয়ে বানিয়ে খাওয়াবে! আর সেই চা খেতে খেতে ওরা নারী লেখকদেরকে নিয়ে হাস্যরস করবে।

লেখকের লেখার বিষয় কী হয়? তার যাপিত জীবন। এবার একজন পুরুষ লেখকের যাপিত জীবন আর নারী লেখকের জীবন যাপন আমাদের এই দেশে এই সমাজে কি একই রকম? অথচ একজন পুরুষ যখন তার বেকারত্বের কথা লিখে, সে যখন তার দিকে চেয়ে থাকা পরিবারের কথা লিখে, দারিদ্রের কথা লিখে, পকেটে এমন কি সিগারেট কেনারও টাকা না থাকার কথা লিখে তখন চারপাশে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। আহা উহু, ধবনিতে চারপাশ মুখরিত হয়। নারী পুরুষ সবাই সেই লেখা পড়ে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে।

আর একজন নারী যখন লিখে, আজকে রাস্তায় এক বদমাইশ আমার শরীরে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছিল। সেই বদমাইশকে আমি থাপ্পড় দিয়ে সাইজ করে দিয়েছি। তখন আর সেই লেখা কাউকে স্পর্শ করেনা। তখন কোন এক বদমাইশ কবি সেই লেখা নিয়ে হাসিঠাট্টাও করে বসতে পারে। অথচ এই দেশে রাস্তায় ঘাটে চলাফেরা করা প্রত্যেকটি নারীর জন্যে এটা একটা চরম বাস্তবতা। কোন পুরুষ যদি লিখে,আজকে অফিসের কাজ করতে করতে, কিংবা লেখার প্রুফ দেখতে দেখতে পিঠ ব্যথা হয়ে গিয়েছিল, তবুও ছাড় পাইনি। সবাই সেই পুরুষের দুঃখে দুঃখিত হয়।

আর কোনো নারী যদি লিখে আজকে আমার পিরিয়ড ছিল, সেই যন্ত্রণার মধ্যেও আমাকে অফিস প্রেজেন্টেশান করতে হয়েছে, তারপর বাসায় এসে সবার জন্যে রান্না করতে হয়েছে, অনেক ধোয়াপালাও করেছি। মাথা ব্যাথায় এখন চোখে অন্ধকার দেখছি। তখন আর কেউ সেই নারীর দুঃখে দুঃখিত হয় না। সেই পিঠে ব্যথার লেখকও বলে, এইসব হইলো লাইক পাবার ধান্ধা।

মেয়েদের জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে তারা লিখতে পারবে না। কারণ এতে পুরুষদের অস্বস্তি হবে! কারণ তারা মেয়েদের সাথে জড়িয়ে থাকা যে কোন বিষয়কেই অশ্লীল মনে করে। তাই এই অতি দরকারি বিষয়টিও তাদের কাছে আদি রসাত্মক। এটা নিয়ে তারা গোপনে গা টেপাটেপি করে হাসবে, হাসতে হাসতে কাল্পনিক আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু একজন নারী তার বাস্তব সমস্যা গুলো জানাতে পারবেনা।

ঈদের সময় অনেক দিন পর তাদের বালক বয়সের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। বউয়ের হাতে বানানো পিঠা পায়েশ খেতে খেতে বালক বয়সের স্মৃতিচারণ করে লম্বা লম্বা আবেগঘন লেখা লিখবে। ঠিক সেই সময়ে কোন নারী যদি লিখে, ‘আহারে, ঈদের দিনে বাবা মায়ের সাথে ঈদ করতে পারছিনা’। তখন স্বাভাবিক ভাবেই উনাদের খুবই বেআরাম বোধ হবে। উনাদের মনে হতে থাকবে, এইসব কোনো দুঃখ হলো, শহুরে নারীদের এইসব ঢং কোথা থেকে আসে!

পুরুষের হাসি-আনন্দ-দুঃখ হয় সার্বজনীন, আর নারীর হাসি- আনন্দ-দুঃখ হয় হাস্যরসের বিষয়! তাদের মতে, নারীদের দুঃখ কষ্ট শুধুই দুষ্ট নারীবাদীদের বিখ্যাত হবার হাতিয়ার! পৃথিবীর সবাই কোন না কোন কারনে কোন না কোন সময় চাইলেই প্রোফাইল ছবি পালটে বা বিশেষ কোনো রঙ্গে প্রোফাইল ছবিকে রাঙ্গিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে; এতে কোথাও কারো কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। কিন্তু যখনই একদল নারী তাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে এই কাজ করলো, তখন সে কী হাসাহাসির ঢল। প্রতিবাদটি কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে! কিন্তু কোনো প্রতিবাদ নিয়ে এতো হাসাহাসি, এতো কৌতুক এই প্রথম আমরা দেখলাম!

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোন সুস্পষ্ট আর সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই নারীবাদীদেরকে ভয় পায় এবং ঘৃণা করে। লক্ষ্য করুন, এখানে আমি পুরুষ বলিনি, বলেছি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। অর্থাৎ এদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েই আছেন। নারী মানেই যে সে নারীবাদী হবে, আর পুরুষ মানেই যে সে পুরুষতান্ত্রিক হবে, তা কিন্তু না। তো, কেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীবাদীদেরকে ভয় পায়? কারণ নারীবাদীরা চায় সমতা।

আবার দেখুন, নারীবাদিরা কিন্তু নারীতন্ত্র চায় না, তারা চায় সমতা। মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীর আলো হাওয়ায় সমান ভাবে বেঁচে থাকবার যে অধিকার নারীর আছে সেটি প্রতিষ্ঠা করতে চায় নারীবাদীরা। নারীবাদীরা কিন্তু কারো কাছে অধিকার ভিক্ষা চায়না। মানুষ হিসেবে তাদের যে অধিকার আছে, যে অধিকার গায়ের জোরে কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছে সে অধিকার তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এতে হাস্যরসের কিছু নেই, বিখ্যাত হবার কিছু নেই। এতে রয়েছে শত বছরের নারীর বঞ্চনার, কষ্টের, ঘামের, চোখের পানির, অস্তিত্বহীনতায় ডুবতে ডুবতে খড়কুটো ধরে আশ্রয় খোঁজার গল্প।

সেই অস্তিত্বহীনতার গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে চায় নারীবাদীরা। সজোরে জানান দেয় তাদের অস্তিত্ব। এতেই টালমাটাল হয়ে ওঠে এতদিনের সাজানো অন্যায়ের, অসমতার রাজত্ব। তখনই পইপই করে সবাইকে শেখানো হয়, নারীবাদীরা খারাপ। নারীবাদীরা সমাজের ভালো চায়না। তা বটে! এতোদিনের যে নির্মম সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, সে সমাজের ভালো নারীবাদীরা চায়না। নারীবাদীরা চায় সমাজের পরিবর্তন হোক। যে সমাজে নারী কোন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে না, অর্ধমানব হয়ে থাকবে না, তেমন সমাজ চায় নারীবাদীরা।

আমাকে কেউ কেউ বলে, ‘তুমি তো নারীবাদী’। এই কথা বলে তারা আবার বলে, ‘রাগ করো না’। অর্থাৎ তারা ধরেই নেয়, নারীবাদী একটা খুব খারাপ ধরনের গালি। তাদের এই কর্মকাণ্ডে আমি হেসে ফেলি এবং খুব দম্ভের সাথে বলি, ‘হ্যাঁ, আমি তো নারীবাদীই!’

কেন দম্ভ করি জানেন? কারণ একমাত্র নারীবাদীরাই তাদের মায়েদের চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়েছে, একমাত্র নারীবাদীরাই দেখেছে তাদের বোনেদের ঠিকানাবিহীন হবার যন্ত্রণা। একমাত্র নারীবাদীরাই দেখেছে তাদের বাবার একা একা একটা পুরো পরিবার চালানোর কষ্ট, বোনের বিয়েতে খরচ করতে করতে কুঁজো হয়ে যাওয়া বাবার কষ্ট নারীবাদীদের চেয়ে আর বেশি কেউ বোঝেনা। একমাত্র নারীবাদীরাই মানুষকে সব প্রথা আর নিয়মের বাইরে এসে মানবিক চোখ দিয়ে দেখতে পারে। 

আমি নিজে একটি অত্যন্ত আরামদায়ক জীবন পেয়েছি, তাই জন্যে স্বার্থপরের মত নিজের বানানো বক্সে বসে থাকবো এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার মায়ের চোখের পানি মুছে দেবার দায়িত্বও আমার আছে। আমাদের সবার আছে। 
এবার আপনারাই ঠিক করবেন, দায়িত্ববানের মত জীবন যাপন করবেন, না কি দায়িত্বজ্ঞানহীন হবেন!

শেয়ার করুন: