নারীবাদে আপনার এতো এলার্জি কেন?

দিলশানা পারুল:

বাংলাদেশের নারীবাদীরা কি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ্ থেকে অর্থ্ পাচারের সাথে জড়িত? এই দেশের নারীবাদীরা কি সিন্ডিকেট করে হাজার হাজার মণ চাল চুরি করেছে? এই দেশের নারীবাদীরা কি হাটে, ঘাটে, মাঠে, অলিতে, গলিতে ধর্ষণ এর সাথে জড়িত? এই দেশের নারীবাদীরা কি পরীক্ষার হলে নকল সাপ্লাই দেয়? নারীবাদীরা কি সীমান্তে ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত? নারীবাদীরা কি শ্রমিকদের বেতন মেরে দিয়ে সিংগাপুর ঘুরতে যায়? এই দেশের নারীবাদীরা কি রানা প্লাজার ধসের সাথে জড়িত? তাহলে নারীবাদে আপনার এতো এলার্জি কেন?

আমি একটু বোঝার চেষ্টা করি কেন এই রিপালশান! নারীবাদী মানে আপনার মাথায় যে চিত্রটি আছে, সেটা হলো শাড়ির সাথে হাতাকাটা ব্লাউজ পরে অথবা জিনস ফতুয়া পরে গুলশান এ গ্লোরিয়া জিনসে কফি খায়, আর নারীর ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলে, নারীবাদীরা স্মোক করে এবং মেয়েদের স্মোক করার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখে না, এই নারীবাদী মেয়েরা যখন তখন লিখায় অথবা কথায় র্নিবিকারভাবে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে! এরা শুধুই কিটি পার্টি করে বেড়ায়! বাস্তবের সাথে এদের কোনো সর্ম্পকই নাই! এরা সবাই ডিভোর্সি, এবং এদের কাজই হলো সংসার ভাঙা। এরা উগ্রবাদী! সবাই তসলিমা নাসরিনের চ্যালা, এরা যৌন স্বাধীনতার প্রচার করে বেড়ায়, আসল কাজে কেউ নাই! 

ঠিকই তো, এই ধরনের মেয়েদের আপনার ভালো লাগবে কেন? আর যে মতবাদে বিশ্বাসের কারণে একটা মেয়ে এরকম বিপথে যায় সেই মতবাদকে তো ভালো বলার কোনো কারণই নাই ! এবং সেই মতবাদকে তো সর্বতোভাবে আটকানোই দরকার, তাই না?

এখন দুইটা প্রশ্ন আপনার জন্য, আপনি আসলেই কজন নারীবাদীকে ব্যক্তিগত জীবনে চেনেন, যারা এই ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী? আমি নিজেকে শক্তপোক্ত নারীবাদী মনে করি, এবং আমি বিবাহিত, এক সন্তানের মা, খুবই (আপনাদের ভাষায়) মার্জিত পোশাক পরি, সত্যি সত্যি জীবনে কোনদিন গুলশান গ্লোরিয়া জিনসে যাওয়া হয়ে উঠেনি! তবে যাবো না, এমন কথাও নেই।

আমি অন্তত একশ নারীবাদী রীতিমতো এক্টিভিস্টের লিস্ট আপনাকে ধরিয়ে দিতে পারবো, যারা উপরের কোনো বৈশিষ্ট্যই ধারণ করেন না! সেইটা গেলো একটা ব্যাপার! এবার আসেন দ্বিতীয় প্রশ্নে, কথার কথা ধরেই নিলাম নারীবাদী মেয়ে মানেই অশালীন পোশাক পরে, স্মোক করতে করতে, দল বেঁধে কফি হাউজে আড্ডা দিতে দিতে একদল তালাকপ্রাপ্তা অথবা নিজেরা তালাক দেয়া মেয়ে নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলছে, তাতে আপনার সমস্যা কোথায়? ভেবে দেখেছেন?

এরকম বৈশিষ্ট্যের নারী আপনি নিতে পারেন না, কারণ আপনার মাথায় যে প্রথাগত চিন্তার ফরম্যাট আছে, সেই ফরম্যাটে এই ধরনের নারী মানেই ‘ভালো-না’ নারী! এইটা আপনার চিন্তা পদ্ধতির সমস্যা, যারা এই ধরনের জীবন আচারে অভ্যস্ত এইটা তাদের জীবন আচার, তাদের কোনো ব্যবহারিক সমস্যা না! আর ভালো মানুষ হওয়া আর ভালো কাজ করা সর্ম্পূণ দুই ব্যাপার।

আমাদের সমাজে তো লক্ষ লক্ষ ভালো মানুষ ঘুরে বেড়ায়, যারা হুদাই ভালো মানুষ! জীবনে শুধু ভালো মানুষই থেকে গেলো, কোনদিন একটা ভালো কাজ করে দেখলো না। ভালো থাকাটা আসলে এই সমাজে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, কারণ ভালো থাকার কোনো ঝক্কি নাই। কিন্তু ভালো কাজ করার হাজারটা ঝক্কি আছে। ওই জন্য ভালো মানুষরা ভালো থাকতেই ভালোবাসে, কিন্তু ভালো কাজ করায় তত আগ্রহ পায় না।

এখন সামাজিক সংজ্ঞায় এই সমস্ত খারাপ মেয়েরা যদি সমাজের কাদা সরানোর মতো গুরুদায়িত্ব স্ব-ইচ্ছায় নিজের কাঁধে নেয়, আপনার তো তাতে খুশি হওয়ার কথা, রাগ হওয়ার কথা নাতো! কারণ কাদা সরাতে গেলে গায়ে কাদা লাগবেই। কাজেই সমাজের এই সমস্ত ‘ভালো-না’ মেয়েগুলোর গায়েই কাদা লাগুক, আপনাদের বাড়ির ভালো মেয়েগুলো ভালোই থাকলো পরিষ্কার আচার আচরণ, অনিন্দ্য সুন্দর! আপনি নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলেন, এতো দুশ্চিন্তার কী আছে?

আপনি কেন এতো রেগে যান, জানেন? কারণ আপনি খুব ভালো করেই জানেন, ভালো-না মেয়ে হওয়ার নেশা বড় মারাত্মক নেশা। একবার যদি আপনার বাড়ির মেয়েগুলোকে ভালো-না হওয়ার নেশায় পেয়ে বসে, আপনার বাড়ির শান্তি উচ্ছন্নে যাবে, এই ভালো-না মেয়েটিকে আর আপনি সামাল দিতে পারবেন না। আপনার বাড়ির মেয়েটি যদি ভালো না হওয়ার প্রকৃত অর্থ যে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা, অধিকার বুঝে নেয়ার আরেক নাম এইটা বুঝে যায়, সে বাড়ির বাপ, মা, ভাই, চাচা, শ্বশুর, শাশুড়ি, জামাই সবার সাথে ট্রেড অফ শুরু করবে। আপনার ঘরে বিনে পয়সায় দাসীটি যে পেতেন, সেটি আর পাবেন কোথায়, তাই না? কাজেই যারা এই নারী স্বাধীনতার ডাক দেয়, তাদের উপর আপনার রাগ হওয়ারই তো কথা, তাই না!  

নারীর অধিকারের পক্ষের যে আন্দোলন, সেটি একটি সামাজিক আন্দোলন। প্রতিটি আন্দোলনের দুটি পর্যায় থাকে: ব্যক্তিগত এবং যূথবদ্ধ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যখন কেউ সংগ্রামটি করছে, তখন সেইটার মধ্যে সাবধানী হওয়ার কিছু নেই। প্রতিটি মানুষের জীবন তার মতো, কাজেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংগ্রাম বা প্রতিবাদটাও তার মতোই হবে, ব্যক্তিগত বক্তব্যে, চালচলনে, কাজে তার ব্যক্তি প্রতিবাদটাই মুখ্য, সেইখানে ব্যক্তি নারী তার নিজের মতো করে সমাজের প্রথাকে আঘাত করবে, চ্যালেঞ্জ করবে, হতেই পারে সেটা কোন রকম নিয়মনীতি, শৃঙ্খলা- ভব্যতা, সভ্যতার ধার না ধেরে!

কিন্তু যখনই নারী যূথবদ্ধ আন্দোলন করবে, বা করছে, তখন সাবধান হওয়া জরুরি বৈকি! কারণ এইখানে নারী, আপনি যূথবদ্ধ আন্দোলনের অংশীদার। এইটা রোল মডেল, নারী, আপনি বা আপনারা সমস্ত নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এইখানে আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বড় ব্যাপার। যেহেতু আপনি বা আপনারা কোনো একক নারীর ম্যানডেট নিয়ে রাস্তায় নাই, তাই ইস্যু নির্বাচন, দাবি বা বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সার্বজনিনতা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়!

নারী অধিকারের পক্ষে আপনি যেই বিষয়টি উথ্থাপন করছেন সেটি আসলেই দেশের সামগ্রিক নারী সমাজের কথা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন করা হয়েছে কিনা সেটি অবশ্যই ভাবতে হবে। বিষয়বস্তুকে আপনি যেভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করছেন সেটি সবর্জন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কিনা সেটিও অবশ্যই ভাবতে হবে! সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কথা ভাবতে হবে এই কারণে যে, আপনি সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন। আপনার বক্তব্য যদি সমাজের মানুষ গ্রহণ না করে সেতো নিজেকে সেই মতো পাল্টাবে না। নারী অধিকারের পক্ষে আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন, এটি কোনো ব্যক্তি নারীর জনপ্রিয়তা বাড়ানোর আন্দোলন না। 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.