হায়দরাবাদ থেকে আওরঙ্গাবাদ- ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

সরিতা আহমেদ:

৮ আগস্ট ২০০৭ / ২৯ জুলাই ২০১৭ 
হায়দরাবাদ / আওরঙ্গাবাদ।
১০ বছর বাদে আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। 
তারিখ আলাদা , স্থান আলাদা।
হোতা এবং টার্গেট একই।

এই দশ বছরে অনেককিছু বদলেছে। সরকার এবং তাদের এজেন্ডা বদলেছে।
আশা এবং নিরাশার মানে বদলেছে।
দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতার মানে বদলেছে।
‘সুরক্ষা’ প্রশ্নে পার্লামেন্টের তর্জন-গর্জন বদলেছে।
শুধু বদলায়নি তসলিমা নাসরিনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।
এটা জানা কথাই যে, উপমহাদেশের কোথাও কোনও দেশেই এই একটা নামের প্রতি পক্ষপাতমূলক নিষেধাজ্ঞা উঠবে না।
এই একটা নামের সাথে ‘বিতর্কিত’ ট্যাগ ঘুচবে না।
এই একটা মানুষকে নিয়ে গা-জোয়ারি হম্বিতম্বি এবং মানসিক -শারীরিক সবদিকে নাজেহাল করে দেওয়ার ট্রাডিশান ঘুচবে না।

এটা এখানকার অস্থি মজ্জায় মিশে গেছে, কারণ এই একটা নামের জন্য কোনও মানবাধিকার কমিশন ধর্না দেবে না, কোনও বুদ্ধিজীবী লেখিকার সমর্থনে টিভিতে ‘বাইট’ দিতে একটা শব্দ খরচা করবেন না।
আর আমাদের ডিজিটাল প্রতিবাদীরা প্রশাসনের কারুর নজরে পড়বে না, যেমন পড়েনি গত দশ বছরে।
কাজেই একের পর এক নিষেধাজ্ঞা (সরকারি), ফতোয়া (বেসরকারি) চলবে। কিছুজন প্রতিবাদী পোস্ট দেবে, কিছু মিডিয়া লেখিকার সাক্ষাৎকার নিয়ে হোক, না নিয়ে হোক ‘খবর’ বানাবে, আর বেশিরভাগ মানুষ হাততালি দেবে।
এই ট্রাডিশান সমানে চলছে, চলবে।
কাজেই ..এই ঘটনায় আমি মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হলেও, অবাক হইনি।

আওরঙ্গাবাদের ৪০০ লোকের আস্ফালন, ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস ই ইত্তেহাদুল মুস্লিমীন’ এর নেতা ইমতিয়াজ জলিল এবং সাঙ্গপাঙ্গদের মিডিয়ার সামনে দেওয়া ‘বাইট’, অজন্তা ইলোরার ‘গুফা’তে ছেলে পাঠিয়ে তসলিমাকে ‘গুফা ক্যসি হোতি হ্যায়’ দেখিয়ে দেওয়ার হুমকিগুলোর সাথে ২০১৩ তে টিভি সিরিয়াল ‘দুঃসহবাস’ বন্ধ করার ‘মিল্লি ইত্তেহাদ পরিষদ’ এর ফতোয়ার মধ্যে আমি তফাৎ পাইনি।

তফাৎ পাইনি, কলকাতা বইমেলায় আত্মজীবনীর সপ্তম খণ্ড ‘নির্বাসন’ উদ্বোধন নিষিদ্ধ করার সরকারি ফতোয়াতেও।
বারবার সরকারকে ঢাল বানিয়ে মোল্লাতন্ত্র নিজেদের জয়ঢাক বাজিয়েছে।
এদিনও আবার হলো।
না, আমি অবাক নই।

ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে যখন ‘লোকন্যায় হিন্দ চ্যানেল ‘ ফলাও করে ভিডিও আপলোড করে দেয় ইউটিউবে, দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফেসবুকে নিজেদের তোলা ভিডিও আপলোড করে AIMIM এর সমর্থকরা এবং এসব ভিডিও উত্তেজক হওয়া সত্ত্বেও কোনও বিরোধিতার মুখোমুখি হয় না, রিপোর্ট করলেও ‘ফেসবুক স্ট্যান্ডার্ড’ অমান্য করেছে বলে গণ্য হয় না – তখন আমার অবাক হতেও অবাক লাগে।

৪০০- ৪৫০ লোকের জমায়েত নিয়ে উচ্ছ্বসিত ইমতিয়াজ যখন বলছে , “হোটেলের বাইরে আমাদের ছেলে বহুক্ষণ থেকে তসলিমার জন্য অপেক্ষায় আছে, বাইরে এতো পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে আমরা বলে দিয়েছি কোনো গোপন পথে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ‘দেখে নেওয়া’ হবে “… আর তার পরদিন পুলিশ কর্তা মিডিয়ার সামনে জানাচ্ছেন, ‘আমাদের কাছে উনার আসার কোনও খবর ছিল না’ – তখন সত্যি হাসি পায়। দুষ্কৃতিকারীরা যে ‘খবর’ লিক হওয়া নিয়ে নানাভাবে ফলাও করে বুক বাজিয়ে বলছে, সেই খবর পুলিশ কর্তা অস্বীকার করছে! 

‘রাজনৈতিক শিকার ‘ -হওয়ার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে!
এই আমাদের সিকিওরিটি, এই আমাদের আপোষকামী প্রশাসন।

এখানে তসলিমা যে এখনো শ্বাস নিচ্ছেন, এখনো যে কালবুর্গী বা দোভালকারের পরিণতি দেখতে হয়নি – এটাই বোধ হয় অনেক পাওয়া।
লজ্জা পেতে পেতে আজকাল গায়ের চামড়া অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে।
গত দু’দিন ধরে সত্যি লজ্জা আর নির্লজ্জতা আলাদা করে অনুভব করতে পারছি না।

ক্ষমা করবেন তসলিমা, আপোষকামী দেশে আপোষকামী গণতন্ত্রের আপোষলোভী এবং ইয়েস, ‘শান্তিকামী’ নাগরিক হিসেবে আমরা আপনার নামের থেকে ভয়ের গন্ধটুকু সরাতে পারিনি।
হ্যাঁ, আপনাকে এই দেশ ভয় পায়। 
উঁহু, এর সাথে আবার সম্মানকে গুলিয়ে ফেলবেন না। ওসব জাস্ট ‘ফুটেজ’!
শান্তিকামী প্রশাসন, শান্তিকামী জনতা – সবাই শান্তির জন্য এক পায়ে খাড়া এবং বারবার অন্য কোনও উপায় না পেয়ে আপনাকে তাড়ায়। এতো ভয় ধরিয়েও আপনি টিকে আছেন কী করে! 

শুনুন,
শক্ত শিরদাঁড়া নিয়ে কবিতা শেয়ার করেই আমরা বিপ্লব করি। আসলে ঐটাই আমাদের মানায়। বাস্তবে ভয় আর অজুহাত নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা।
তাই তো আপনার আদর্শ বা লেখাকে সম্মান দেখানো তো দূর, একজন মানুষ হিসেবে বেড়ানোর ইচ্ছেটুকুকেও মর্যাদা দিতে পারে না -এমনই ক্লীব আমাদের সংস্কৃতি।
এটুকুই চাইবো, যেখানেই থাকুন বেঁচে থাকুন। এটুকু চাওয়া টিকে গেলেই জানব অনেক পেয়েছি।

#জনৈক_ক্ষমাপ্রার্থী

শেয়ার করুন: