সুমু হক:
এমনিতেই নারীর প্রতিপক্ষ অনেক। সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্ম থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত। তার ওপর নারীবাদীরা একে অন্যের গায়ে কাদা না ছিটালেই কি নয়?
আগেও অনেকবার লিখেছি ও বলেছি এ‘কথা, আবারও বলতে হচ্ছে, নারীবাদ কোনো “ওয়ান সাইজ ফিটস অল” তৈরি পোষাক নয়, যে সবাই একে একইভাবে দেখবেন, এবং ধারণ করবেন। দেশ–কাল–ব্যক্তি–সমাজ ভেদে একে আলাদা রকম চেহারায় আসতেই হবে। চিন্তাশীল, পরিণত মানুষ ক্রমাগত তাকে প্রশ্ন করে যাবে, তার আলোকে নিজের ব্যক্তিজীবনকে চ্যালেঞ্জ করবে, লড়াই করবে, হেরে যাবে, আবারও উঠে দাঁড়াবে এবং ক্রমশঃ এই দ্বন্দ্বের ভেতর থেকেই নারীবাদ ক্রমান্বয়ে আরও পরিণতির দিকে যেতে থাকবে।
শুধু নারীবাদ কেন, যেকোনো প্রগতিশীল চিন্তার ধর্মই তাই হওয়া উচিৎ, কেননা প্রগতিশীলতা যদি স্থবির হয়ে যায়, কোনো একটা বিশেষ জায়গায় এসে থেমে যায়, তবে সেটা আর যাই হোক, প্রগতিশীলতা থাকে না।
পৃথিবীর সব দেশের মানুষের নারীবাদ বিষয়ক ভাবনা একে অন্যের সাথে মিলবে না। এমনকি আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান এমনকি অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণে একই দেশের সব মানুষও যে একে একই দৃষ্টিতে দেখবেন এমনটা হওয়া অসম্ভব।
আমি যে দেশ বা সমাজে বসবাস করি, সেই অবস্থানের কারণে এবং আর্থিকভাবে কারো ওপর নির্ভর করতে হয় না বলে একজন নারী হিসেবে আমার যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা রয়েছে, বাংলাদেশে বসবাস করা অনেক নিম্নবিত্ত কিংবা এমনকি মধ্যবিত্ত পুরুষেরও সেই স্বাধীনতা কিংবা নিরাপত্তাটুকু নেই, নারীদের কথা না হয় নাই বললাম। এখন এই প্রিভিলেজড জীবনের মাঝখানে থেকে বাংলাদেশ কিংবা এরকম আরও কোনো জটিল বাস্তবতায় বসবাস করা নারী–পুরুষের লড়াইকে আমি ছোট করে দেখবো কোন অধিকারে!
আবার একই দেশে একই সমাজে, অনেক প্রাচুর্যের ভেতর বসবাস করা একজন নারীও কেবলমাত্র আর্থিক স্বনির্ভতার অভাবে একজন আর্থিকভাবে স্বনির্ভর কিন্তু নিম্নবিত্তের সীমানার ভেতর দারিদ্রের সাথে লড়াই করে যাওয়া নারীর চেয়েও অনেক পিছিয়ে আছেন। বলাই বাহুল্য, এই দুই নারীর অভিজ্ঞতা, ভাবনার মতই নারীবাদ নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও আকাশ–পাতাল পার্থক্য থাকবে। আমি যদি কেবল আমার সাথে মিলছেনা বলেই এই হয় নারীর কোন একজনের লড়াইকেও ছোট করে দেখি তাহলে বুঝতেই হবে, আমার শিক্ষা এবং ভাবনার কোথাও একটা ভীষণরকম গলদ রয়ে গেছে।
আবার শুধুমাত্র একজন নারী বলেই যদি আমিই সমাজব্যবস্থার যেকোন ক্ষেত্রে বঞ্চনার স্বীকার হওয়া পুরুষদের সংকটের জায়গাটুকু না দেখি, না বুঝি তাহলেও বুঝতে হবে, আমার শিক্ষা অসম্পূর্ন রয়ে গেছে। নারীবাদ মানেই পুরুষবিদ্বেষ নয়, নারীবাদ মানে কারো ওপর কারো আধিপত্য নয়, নারীবাদ পৃথিবীর আর যেকোন কল্যাণকর ভাবনা কিংবা দর্শনের মতই লৈঙ্গিক পরিচয় এবং অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে মানুষের মুক্তির কথা বলে।
জী হ্যাঁ, মানুষের মুক্তি, কেবল নারীর মুক্তির কথা নয়।
সমাজের অর্ধেক নারীদের পেছনে রেখে যেমন মানবসভ্যতাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা যায়না, ঠিক তেমনিভাবে, পুরুষদের মানসিক,অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শৃঙ্খলগুলো কেটে না ফেলতে পারলেও মানুষের মুক্তির আশা করা যায় না। ভুলে গেলে চলবেনা, পুরুষতন্ত্র কেবল নারীকেই শৃঙ্খল পরিয়ে রাখেনি, পুরুষকেও তা ভরে রেখেছে সমাজের তৈরী করে দেয়া প্রত্যাশিত ভুমিকার খাঁচার ভেতরে, এই অন্যায্য ব্যবস্থার ভিকটিম নারী–পুরুষ দুজনেই সমানভাবে। সমাজের অন্যসব অবিচার, অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে নারীবাদকে তাই পৃথক করে দেখার অবকাশ তাই নেই। একেবারেই নেই।
তাই একজন মধ্যবিত্ত নারীর গার্হস্থ্য জীবনের সীমিত অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে করা লড়াই যেমন আমাদেরকে বুঝতে হবে (সবাই সব লড়াই একইভাবে, একই মাত্রায় লড়েন না, লড়াইয়ের মাঠে সবার শক্তি কিংবা সামর্থ্যও এক হয় না) , তেমনিভাবে বুঝতে হবে যে সমাজের আরেকটু প্রিভিলেজড অবস্থানে থাকা নারী হয়তো বা তার অবস্থানের কারণেই বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখবেন এবং অনেক সময় হয়তো একজন নিম্নবিত্ত নারীর লড়াইটাকে বুঝতে পারবেন না. এমন হলে খুব শ্রদ্ধার সাথে ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটাবার চেষ্টা করাটাই কাম্য। একে অন্যকে ছোট করে, অন্যের লড়াই কেবলমাত্র ভিন্ন বলেই তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে, অপমান করে আমরা কেউই কোথাও পৌঁছতে পারবোনা।
নিজেকে পুরুষের দৃষ্টিতে কামনার বস্তুতে পরিণত করতে পারাকেই যেই নারী জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেন, এবং একজন মধ্যবিত্ত বাঙালি পুরুষের ছকেবাঁধা জীবনে থেকে সৌখিন সমাজ উদ্ধার করতে যাওয়া যে পুরুষ নারীবাদকে কেবল তার বিকেলের চায়ের টেবিলে ঝড় তুলে আত্মশ্লাঘাবৃদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন, দুজনেই আমার কাছে সমানভাবে করুণার যোগ্য এবং তাদের ভুল ভাঙ্গানো প্রয়োজন বলে ভাবি। আমার চোখে করুণার পাত্র আমার সেই বামপন্থী বন্ধুটিও, সমস্ত জীবন শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেও দিনশেষে যার মনে হয় তার প্রিয় বন্ধুটিকে তার “রক্ষা” করতে হবে, তার একজন অভিভাবক নির্ধারণ করতে হবে, শুধুমাত্র সেই বন্ধুটি একজন নারী বলে।
তাই চলুন, একে অন্যের দিকে কাদা না ছিটিয়ে আমরা বরং ইতিবাচক আলোচনার দিকে যাই, যুক্তি দিয়ে একে অন্যের ভুলগুলো ভাঙ্গাই। আমরা নারীরা নিজেদেরকেই যদি সম্মানের চোখে না দেখতে পারি, সমাজের বাকি অংশ সেটা করবে এমনটা ভাবা ভুল। দিনশেষে কিন্তু মানুষের মুক্তিটাই আমাদের লক্ষ্য। তাই নয় কি?