খুজিস্থা বেগম জোনাকী:
গ্রামীণ একটা প্রবাদ আছে, “ভাত দেওনের মুরোদ নাই, কিল মারনের গোঁসাই”। প্রবাদটির সত্যতা আমাদের সমাজে অহরহই মেলে। মানে পাওয়ার এক্সারসাইজ, অধিকার বলে অধস্তনকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করাই হলো এ প্রবাদের সার কথা।
সাম্প্রতিক সময়ে এক তারকা দম্পতির বিয়ে বিচ্ছেদের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে নানা শ্রেণীর মানুষের নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সবাই যেন এ বিচ্ছেদের বিপক্ষে। ব্যক্তি দুজনের মতামতকে ডিনায়েল এটিচ্যুডে মোকাবেলা করছেন। আহ্, কী সুন্দর জুটি ছিল, আইডল ছিল, মিডিয়ার সব মেয়েরাই এমন, বাচ্চাটার কী হবে? ইশ্ ভাবতেই পারিনি, মিথিলার ক্যারিয়ারের কী দরকার! সংসারটা করবে কেমনে, রুপালী পর্দার মোহ ইত্যাদি ইত্যাদি।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, যাদের নিয়ে এতো কথা, তারা কিন্তু খুব স্মার্টলি ডিল করেছেন। যৌথভাবে এনাউন্স করেছেন। কিন্তু সমবেদনা না জানিয়ে লোকজন ট্রল করছে এটা নিয়ে। অবাক হচ্ছি যে, মানুষের একান্ত সম্পর্কের ইচ্ছা অনিচ্ছাও বন্ধক রাখতে হবে? এটা আসলে কোনো সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। এ অনুপ্রবেশের অধিকার খুবই জঘন্য।
গত দশ বছর ধরে আমি একটা বিষয় বিভিন্নভাবে জানার চেষ্টা করছি, তা হলো বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ। কেন হচ্ছে, কেন করছে, কোন এলাকায় হচ্ছে! কারণগুলো নানা জায়গায় নানা রকম। হওয়াই স্বাভাবিক। এবং ফলাফলে নারীর জন্য তৈরি হয় কতোগুলো নতুন যন্ত্রণার ইস্যু। করুণা, অবহেলা, কুদৃষ্টিতে আরও অসহায়ের জীবন হয়ে উঠে। সংসার ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতা মেয়েটি একা নয়, তার পরিবারও বহন করে। তাই যতো দুর্বিষহ জীবনই হোক না কেনো, বাবা-মা বলেন, মানিয়ে নাও, আমাদের মুখে চুনকালি দিও না।
এসব সহ্য করতে না পেরে কতশত নারী মরে গেছে, তাও আমরা জানি। কথা একটাই, ঘর টেকানোর সুনিপূণ কৌশল তোমাকেই জানতে হবে নারী। অবস্থার অনেক পরির্বতন হয়েছে, আমার বন্ধুরা দাবিও করেন। আমিও অনেকাংশে একমত। কিন্তু গুটিকয় বিবেচনা তো সমাজের সকলের চিত্রকে বদলের কথা বলে না। মেয়েদেরকে র্পাটনার হিসেবে ভাবার মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে।
যাক সেসব বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে। আমার কথা হলো, বন্ধুরা আপনারা কি জানেন, সাম্প্রতিক সময়ে নারীরা নিজ উদ্যোগে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করছে ভয়ংকর হারে! ঢাকা সিটি করপোরেশনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর দুটি অঞ্চলে গত বছরের মোট তালাকের আবেদনের অনুপাত হচ্ছে ৬৮ দশমিক ১৯শতাংশ স্ত্রী এবং ৩৩দশমিক ০৪ শতাংশ স্বামীরা। গত ছয় বছরে দুই সিটিতে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৩০হাজার ৮৫৫টি। অর্থাৎ দৈনিক ১৫টা বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।
দুটি সিটির দশটি অঞ্চলের এ চিত্র দেখে, এ শহরের নাগরিক কয়েক জনের সাথে কথা বলেছিলাম। তারা উচ্চশিক্ষিত, সচেতন ও কর্মজীবী। তারা মোটা দাগে যেটা বলেছেন, তা হলো, নারীরা এখন শিক্ষিত হচ্ছে, আয় রোজগার করছে, নিজের স্বাধীনতা বুঝতে শিখছে। তাই পরিবারের জিইয়ে রাখা দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি নারীকে অধস্তন করে দেখা, তাকে অধিকার বলে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল এখন আর কাজে আসছে না। কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি। নিজেকে মূল্যবান ভাবা। অন্যায় আচরণের সাথে আপোষ না করার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠা।
পোষাক শ্রমিক কর্মীদের সাথেও কথা বলছিলাম, একজন বললেন আপা, দুজনই চাকরি করতাম। কিন্তু তার স্বভাব খারাপ, আমার সব বেতন সে নিয়ে নেয়, আমার বাবা-মাকে তো দিতে পারি না। এমনকি নিজের কসমেটিক কিনলেও তার কাছে চাইতে হয়। কিছু হলেই গায়ে হাত দেয়। তো, কী দরকার তার সাথে থেকে?
এমন একজন পুরুষের সাথেও কথা বলছিলাম, তিনি বলছিলেন, ‘শহরে এসে স্ত্রী বদলে গেছে, ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপে, ইমুতে কথা কয়। টাকা কামায় দেখে অামারে মানুষ মনে করে না’। তার আক্ষেপের কাছে আমার মন বলছে, ‘হুম, গোঁসাই, তোমাদের দিন শেষ। যে হারে নারীরা তাদের স্বরূপ উন্মোচনে তৈরি হয়েছে, কিংবা প্রস্তুত করেছে নিজেকে, সে হারে পুরুষরা কিন্তু নিজেদের বদলানোর সুযোগটি নেয়নি, তাই নারীকে মানুষ মনে না করে তারা গোঁসাই হয়েই থাকছেন। বা থাকতে স্বচ্ছন্দ্য বা গৌরবের মনে করছেন। তাই ভাত দেবার মুরোদ থাকার পরও গোঁসাইদের স্বভাবের কাছে নারী আর নত হতে চান না’।
প্রবাদটির যথার্থতা রয়েছে বৈকি! আর যাদের মুরোদ নেই, তারা তো পারবেনই না। বাংলাদেশের বিবাহ প্রথা নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। অনেক অসভ্য শর্তও রয়েছে মুসলিম বিয়েতে। তারপরও আমার ব্যক্তিগত মতামত, পরিবার খুব সুন্দর, পরিবারে শিশুরা অনেক মানবিক গুণ নিয়ে নিরাপদে বেড়ে উঠে। সমবায়ের খাবার খায়, স্নেহ ভালোবাসা পায়। যা তাকে স্বার্থপর হতে শেখায় না। সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে উঠে।
আর একাজটি নারীরাই বেশি করে। তাই নারীর প্রতি আপনার দৃষ্টিকোণ হবে শ্রদ্ধার, ভালোবাসার, সহমর্মিতার। পুরুষেরা এক এক করে চারটি বিয়ে করার পরও নারীরা সংসার করতো, শত নির্যাতনেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকতো। কারণ ওই একটাই। জীবন ধারনের ন্যুনতম উপায় নারীর সামনে থাকতো না। সেই নারীরা আজ ঘর ভাঙছে। সেটা কি কেবল তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা? নাকি গোঁসাইগিরির প্রতিবাদ?
কাজেই বলছিলাম কী, গোঁসাইগিরি ছাড়েন, অর্থ উপার্জনের মুরোদ থাকুক বা না থাকুক, সংসারে প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধার আর ভালোবাসার সম্পর্ক। যদি তা না থাকে তো অালাদা থাকাই উচিত।