ড. সীনা আক্তার:
অপ্রিয় হলেও সত্যি যে মা-বাবা দ্বারাই শিশু নির্যাতনের ঘটনা অধিক ঘটে। শারীরিক, মানসিক, যৌন এবং অবহেলা – এই চার ধরনের নিপীড়নের শিকার হয় শিশুরা।
অনেক দিন আগে আমার এক ১৮ বছর বয়সী প্রতিবেশী মেয়েকে দেখতাম, একাই বসবাস করতো। তার বাড়ীতে কোন অতিথি আসতে দেখতাম না। ঘনিষ্ঠ হবার পর জেনেছিলাম তার বাবা ছোটবেলা থেকেই তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতো। মেয়েটি অনেক ভাল ছাত্রী ছিল, কিন্তু সারাক্ষণ নির্যাতনের ভয়ে থাকতে থাকতে পড়ায় মনোযোগ দিতে পারতো না। স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরতে চাইতো না। আবার দেরিতে ফেরার কারণে বাবার হাতে পিটুনি খেত।
তার শিক্ষকরা আচঁ করতে পারতো, সহযোগিতা করতে চাইতো, কিন্তু মেয়েটি তখন সবকিছু অস্বীকার করতো। কারণ সে তার বাবাকে অনেক ভালবাসে এবং সেজন্য বাবাকে হেনস্থা করতে চাইতো না। এসব বলে সে ঝর ঝর করে কাঁদতো।
১৬ বছর বয়সে মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থায় আশ্রয় চায়। সরকার থেকে সে বাড়ি এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পায়। এতে খেয়ে পরে মেয়েটির জীবন চলে, কিন্তু তার পড়াশোনার যে ক্ষতি হয়েছে সেটা সে আর পূরণ করতে পারেনি। এভাবেই শিশু নির্যাতনের দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব থেকে যায় সারাজীবন।
এজন্য বিলাতে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বিশেষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়। এখানে অনেক ছেলে -মেয়ে মা-বাবা’র নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। স্কুলেই তাদের শেখানো হয় শিশু নির্যাতন কী, শিশু হিসাবে তাদের অধিকার কী এবং যে কোনো নির্যাতনে কী করতে হবে। শিশুদের জন্য অভিযোগ জানানোর বিশেষ ফোন নাম্বার আছে।
আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা নেই। আর সেজন্যই হয়তো আহমেদ ফারিহা নামের একটি মেয়ে নিজের বাবা কর্তৃক নিপীড়ণের বিবরণ ভিডিও করে ফেসবুকে প্রকাশ করেছে এবং বাবার নির্যাতন থেকে পরিত্রাণের জন্য সহায়তা চেয়েছে। মেয়েটি অনেকের সহানুভূতি পাচ্ছে, একই সাথে অনেকের নিন্দাও পাচ্ছে।
যেমন একজন বাবার মন্তব্য: ‘আমি আমার মেয়েকে নিজের জীবনের চেয়ে ভালবাসি, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, সেজন্য মেয়েটির প্রতি এমন করা হয়েছে’। অদ্ভুত হলেও এভাবেই অনেকে চিন্তা করেন! একজন বাবা তার মেয়েকে প্রাণের চেয়ে ভালবাসেন, তার মানে সব বাবাই তেমন এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ প্রত্যেক বাবা-সন্তানের সম্পর্ক আলাদা এবং প্রত্যেকটি ঘটনা আলাদা।
অনেকে বলছেন, মেয়েটি মাদকাসক্ত ইত্যাদি। মাদকাসক্ত হলেই কি একজনকে নির্যাতন করা জায়েজ? কোনো কারণেই একজনকে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন জায়েজ হতে পারে না। লজ্জাজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই মনে করেন শাসনের নামে সন্তানকে মারধর করা মা-বাবা’র অধিকার (!)। এজন্য অনেকেই ছোটবেলায় মা-বাবা’র নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য করে বড় হয় এবং বড় হয়ে তারাও তাদের সন্তানদের প্রতি একই শাসন পদ্ধতি প্রয়োগ করে। এভাবেই নির্যাতনের দুষ্টচক্রে অধিকাংশ শিশুর শৈশব আবর্তিত হয়।
অন্যদিকে, ভিন্ন চিত্রও আছে তবে তা নগণ্য। যেমন, নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেছি কিছু কিশোর-কিশোরী নিজ মা-বাবাকে মানসিক নির্যাতন, ব্ল্যাকমেল (blackmail) করে। কারণ এই বয়সী ছেলে-মেয়েদের অনেকের মধ্যে নিজ বাবা-মা’কে প্রতিপক্ষ মনে করার প্রবণতা দেখা যায়। আহমেদ ফারিহা’র ভিডিওটা আমি দু’বার দেখেছি এবং বিশ্বাস করি তার প্রতি অন্যায় আচরণ হয়েছে। বিশ্বাস করার অনেক কারণ আছে কিন্তু একই সাথে তার বিবরণটি আমার কাছে অতিরঞ্জন মনে হয়েছে।
এটা মনে হবার কারণ ১. বর্ণনায় সে অনেক আবেগ প্রকাশ করেছে, কিন্তু অতোটা আবেগেও তার চোখে কোনো পানি দেখা যায়নি, যা অস্বাভাবিক; ২. বাবা পাশে শুইলে বা তার সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে তাকে বিয়ে দেবার বা বিয়ের জন্য চাপ দেবার কথা না।
যাই হোক, জানা যায় সংশ্লিষ্ট একটি সংগঠন তাকে সহযোগিতা দিচ্ছে। ঘটনা যাই ঘটুক, আশা করি বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লেখক: সমাজবিদ।