সন্তানের মঙ্গল সব মা-বাবা চায় না

বৈশালী রহমান:

ছোটবেলা থেকেই একটা কথা শুনে আসছি। “মা বাবা যা করেন, সন্তানের মঙ্গলের জন্যেই করেন”। আমি অনেক বড়ো হওয়ার পরেও মনে করতাম কথাটা সত্যি। কিন্তু অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম, এই কথাটা দুনিয়ার আরো অনেক প্রচলিত ভুল ধারণার মতোই একটা মিথ। সব বাবা মা-ই সন্তানের মঙ্গল চান না।

আবার বেশিরভাগ বাবা মা-ই সন্তানের মঙ্গল চান শুধুমাত্র নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে, সন্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। অর্থাৎ, তাঁরা মনে করেন থাকেন, তাঁরা সন্তানের মঙ্গলের জন্য যে পন্থা চিন্তা করে থাকেন, সন্তানের মঙ্গল তাতেই হবে। এক্ষেত্রে সন্তানের নিজস্ব ইচ্ছা, অনিচ্ছা, চিন্তা, চেতনা, বিবেক ইত্যাদির কোনো ভূমিকা নেই। কথায় কথায় পশ্চিমা দেশের প্যারেন্টিং এর সমালোচনা আমরা করলেও আমাদের নিজেদের দেশে এবং উপমহাদেশে প্যারেন্টিং এর সমস্যা আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ফারিয়া নামক মেয়েটির ভিডিওর পরিপ্রেক্ষিতে তার খালার বক্তব্য “মেয়েটির বাবা তাকে মারতো, কিন্তু বোরকা পরানোর জন্য, নামাজ পড়ার জন্য” এটা কি তাই প্রমাণ করে না? সিরিয়াসলি? সন্তানকে মেরেধরে ধর্ম পালন করাতে হবে?

অবশ্য মারধর বা ফিজিক্যাল এবিউজ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মা বাবার জন্য খুব আনকমন ঘটনা নয়। অত্যন্ত বাজে এবং নিষ্ঠুর এ আচরণ আমরা অনেকেই ছোটোবেলায় সহ্য করেছি, এবং মা অথবা বাবা দিবস উপলক্ষে আমরা জুতা, ঝাড়ু, রুটি বেলুনি প্রভৃতির ছবি দিয়ে আবার মার খাওয়া নিয়ে রোমান্টিক নস্টালজিয়ায় আক্রান্তও হয়ে থাকি। আমাদের মা বাবারা আমাদের প্রেম করার জন্য মারেন, পড়ালেখা না করার জন্য মারেন, ধর্মের আচার আচরণ পালন না করার জন্য মারেন। আমাদের উচিত ছিল এসবের বিরুদ্ধে বহু আগেই সচেতন হওয়া, কিন্তু আমরা তা হইনি। অতএব, আমাদের শিশুরাও এখন মার খাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে, আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম নই, মাত্র এক বছর আগে থেকে আমি আমার সন্তানের গায়ে হাত তোলা বন্ধ করেছি।

এখন আসুন, আমাদের দেশের বাবা মা কিভাবে সন্তানের “মঙ্গল কামনা” করেন তার কিছু দৃষ্টান্ত দেখি।

ঘটনা ১: আমার এক পরিচিতের ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। কিন্তু মা-বাবা ভাবলেন ছেলে ডাক্তার হলেই তার “মঙ্গল” হবে। ছেলের কাকুতি মিনতি, কান্নাকাটি কিছুই তাঁরা পাত্তা দিলেন না। ছেলে মেডিকেলে ভর্তি হলো ঠিকই, কিন্তু ডিপ্রেসড হয়ে গেল। মেডিকেলের পড়াশোনার সাথে সে কিছুতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারলো না। তার বাবা-মা তাকে উৎসাহ দেওয়ার বদলে বরং বলতে শুরু করলেন, তাঁরা ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে না দেওয়ায় ছেলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইচ্ছা করে এসব করছে। ফলাফল, ড্রাগ আসক্ত হয়ে পড়লো সে।

এক্ষেত্রে আমি শতভাগ দোষ ওই “মঙ্গল কামনাকারী” বাবা মাকেই দেবো। কিন্তু কথা হচ্ছে, এটা কি খুব আনকমন ঘটনা? আমাদের দেশের বেশির ভাগ বাবা মাই কি এরকম নন? বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই এরকম ঘটনা কি নেই যেসব ক্ষেত্রে যে ভালো ছবি আঁকে তার হাত থেকে বাবা মা জোর করে রংতুলি কেড়ে নিয়ে কলম ধরিয়ে দিয়েছেন, এমন ঘটনা কি নেই যেখানে কিন্নর কণ্ঠী গায়িকা বাবা মায়ের চাপে হয়ে গেছে ব্যাংকার, বা যে ছেলেটা বা মেয়েটা ভালো গল্প কবিতা লিখতো মেরেধরে তার মাথা থেকে “সাহিত্যের ভূত তাড়ানো হয়েছে? আমাদের দেশে এমন ছেলেমেয়ে কি আমরা দেখি নাই যারা পরীক্ষার ফল নিয়ে পিতামাতার প্রত্যাশার চাপ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে মানসিক চাপে আত্মহত্যা করেছে বা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে?

২. আরেক উচ্চশিক্ষিত বান্ধবী তার আরো “উচ্চশিক্ষিত” এবং “স্ট্যাটাসওয়ালা” শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের হাতে প্রায়ই নির্যাতিত হয়। কিন্তু তার বাবা-মা তাকে সাপোর্ট দিতে রাজি নন, এবং তাঁরা এও চান না যে সে ডিভোর্স নিক। কারণ একবার বিয়ে দেওয়া মেয়ে তাঁরা পুনরায় “পুষতে পারবেন না” এবং মেয়ে মাইর খেলে তাঁদের তেমন সমস্যা না থাকলেও মেয়ে যদি জামাইকে ডিভোর্স দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে, তবে তাঁদের বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে। কারণ মেয়ে মার খাচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে এটা তাঁরা সহ্য করে নিলেও সমাজের “কথা” নাকি সহ্য করতে পারবেন না।

এটাও কি একটা অতি পরিচিত চিত্র নয়? বাংলাদেশের হাজার হাজার মেয়েই তো এরকম শত নির্যাতন সহ্য করেও ডিভোর্স নিতে পারে না একমাত্র পরিবারের সমর্থনের অভাবে। এসব মেয়েদের বাবা মা মেয়েদের “মঙ্গলের জন্য” অল্প বয়সে বিয়ে দেন, পড়াশোনা করার সুযোগ না দিয়েই। আর পরবর্তীতে মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতাটুকু যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন খুব সুন্দর করে তাঁরা বিপদের সময় মুখ ফিরিয়ে থাকেন। এসব বাবা মা কি ছেলেমেয়ের মঙ্গল চান? নিজ সন্তানের বিপদের চেয়ে সমাজের “কথার” ভয় যেসব বাপ মায়ের বেশি তাঁদের কি “মঙ্গল কামনাকারী” বলা যায়?

৩. এক আন্টি একবার খুব গর্ব করে বলছিলেন, বিয়ের পর তাঁর ছেলে নাকি নিজের বউকে নিয়ে একা কোথাও যায়নি। সবসময় মা বাবাকে সাথে নিয়ে গেছে, এমনকি হানিমুনেও। আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, আন্টি, আপনার ছেলে বউ নিয়ে একা শোয় তো? নাকি খাটে আপনারাও থাকেন? এটা অনেকটা এক্সট্রিম কেইস হলেও কাছাকাছি ঘটনা যে কম আছে তা না।

ছেলেমেয়ের বিয়ের পর তাদের যে প্রাইভেসি দেওয়া প্রয়োজন সেটা আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাবা মা-ই বোঝেন না। মেয়ের বাবা মাকে মেয়ের সংসারের ব্যাপারে নাক গলাতে মানা করা হলেও ছেলের বাবা মায়ের বেলায় এটা করা হয় না। এতে করে বিয়ের পরে অনেক মেয়েকেই খুব বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, ছেলেদেরও। এই যেমন, বউয়ের জন্য একটা উপহার আনলে মায়ের মুখ কালো, বউকে নিয়ে বেড়াতে বের হলে বাপের মুখ গম্ভীর, স্বামী স্ত্রী রুমে ব্যক্তিগত সময় কাটানোর সময় মা অথবা বাবার গিয়ে রুমের দরজা ধাক্কাধাক্কি ইত্যাদি। অনেক মা আবার ছেলের দরজায় কানও পাতেন, যাতে বউ না আবার ছেলেকে “ভাঙিয়ে নেয়”। আর ছেলে যদি বউ নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে তবে তো কথাই নেই। মা বাবার সাথে সাথে পুরা সমাজ এবং দেশসুদ্ধ ছি: ছি: করে ওঠে। অবশ্য ছেলেমেয়ের শুধু প্রেমের কথা শুনলে যে দেশের বেশিরভাগ বাবা মায়ের মুখ শুকিয়ে যায়, সে দেশে এসব ঘটনা খুবই স্বাভাবিক।

৪. আরেক মেয়েকে চিনি, টিনএজ বয়সে একটা ছেলেকে চিঠি পাঠানোর অপরাধে তার বাবা তাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দশ বছর তাকে একা বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে কোথাও যেতে দেননি। প্রেম করার অপরাধে মাইর খাওয়া ৯০ দশক এবং আর্লি ২০০০ এও খুব কমন ঘটনা ছিল। এখনও ছেলে বা মেয়ে কারো সাথে প্রেম করছে শুনলে বেশিরভাগ বাবা মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। যুগ আধুনিক হওয়ার সাথে সাথে বাবা মায়েরা এখন প্রেমের বিয়েকে অনেক স্বাভাবিকভাবে নিলেও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে বিয়ে করাটা কয়জন বাবা মা স্বাভাবিকভাবে নেন? এখন এসব ঘটনা নিয়ে আমরা অনেক হাসাহাসি করলেও আমরা অনেকেই ভুলে যাই, এই মনোবৃত্তির এক্সট্রিম অবস্থাই হচ্ছে কুখ্যাত “অনার কিলিং” প্রথা, যেখানে প্রেম করে বিয়ে করে পরিবারের “সম্মান নষ্ট” করার অপরাধে পিতামাতা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সেই সন্তানকে হত্যা করেন।

৫. এই মনোবৃত্তির পেছনের মূল কারণ হচ্ছে নিজ সন্তানকে আলাদা একজন মানুষ না ভেবে নিজ সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা। ঠিক এই কারণেই সমাজে আরেকটা অপরাধ ঘটে থাকে। সেটা হচ্ছে জোর করে বিয়ে দেওয়া। আমাদের দেশে কতোজন মানুষের জীবন যে মা বাবার এরকম জেদের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে তার কি কোনো হিসেব আছে? নিজ পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করতে না পেরে আত্মহত্যা, গছিয়ে দেওয়া সঙ্গী বা সঙ্গীনিটিকে সারাজীবন মেনে নিতে না পারা, ঘটনার তো আর শেষ নাই। এই তো কিছুদিন আগেই একটা মেয়ে সাহসিকতার পুরস্কার পেলো, যে তার বাবা মায়ের তৈরি করা বাল্যবিবাহের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে উল্টা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আরেক মা নাকি কিশোরী মেয়েকে মাঝবয়সী লোকের সাথে বিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি। নিজের সন্তানকে ওই পুরুষ যাতে ঠিকমতো ধর্ষণ করতে পারে সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। এছাড়া প্রায়ই তো নিউজে আসে, অমুক স্থানে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাল্য বিবাহ বন্ধ হয়েছে। সেখানেও এই বিবাহের আয়োজনকারী তো বাবা মা-ই ছিলেন। যাঁরা মনে করেন সন্তানকে অল্প বয়সে বিয়ে দিলে দিলে তার “মঙ্গল” হয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইসব মঙ্গলকারী বাবা মায়ের সুবিধার জন্যেই ওই “বিশেষ বিবেচনায়” বাল্যবিবাহের বিধানটা রেখেছেন কিনা কে জানে।

অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় পিতামাতার বিরুদ্ধে আমি এতগুলো নেগেটিভ কথা বলছি কেন। আমি কি তবে অকৃতজ্ঞ? না, আমি মোটেও অকৃতজ্ঞ না। আমি নেগেটিভ কথাগুলো বলছি আমাদের বাবা মায়েদের প্যারেন্টিং এর ভুলগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। বাবা মায়েদের সম্পর্কে অতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার কারণে যেগুলো আমাদের অনেকেরই চোখে পড়ে না। আমিও আমার বাবা মাকে অনেক শ্রদ্ধা করি, তাঁদের প্রতি আমি আজন্ম কৃতজ্ঞ। তার মানে এই নয় যে আমার প্রতি হওয়া সকল অন্যায় এবং নির্যাতনের ব্যাপারে আমি অন্ধ হয়ে থাকবো।

“মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য” রচনা তো অনেক পড়েছে সন্তানেরা। এবার নাহয় “সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য” রচনাও মা বাবারা পড়ুন। খুব কি অন্যায় হবে তাতে ?

শেয়ার করুন: