এতোদিন কিছুই বলেনি কেন?

তানিয়া কামরুন নাহার:
কোন নারী ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে যখন তা প্রকাশ করে প্রতিকার চাইতে যায়, তখন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে প্রশ্ন করে, “আগে এসব বলেনি কেন?” “এতোদিন চুপ থাকলো কেন?”
অর্থাৎ এই ধর্ষণ বা যৌন হয়রানিতে নারীর সম্মতি ছিল এবং এতে পুরুষের কোনই দোষ নেই– এই কুযুক্তি উপস্থাপনের জন্য এমন প্রশ্ন উত্থাপন।
ভিকারুন নেসা স্কুলের শিক্ষার্থী যখন পরিমলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনলো, বনানীর রেইনট্রিতে ধর্ষিত দুজন যখন ঘটনার বেশ অনেকদিন পর অভিযোগ করলো, এমন কি সম্প্রতি সৎবাবা আরমান হোসেন সুমনের বিরুদ্ধে যখন তার সৎ মেয়ে দীর্ঘ আট বছর ধরে ধর্ষণ করার অভিযোগ আনলো— প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা একই প্রশ্ন শুনতে পেয়েছি, “এতদিন কিছুই বলেনি কেন?”
কোন নারী বা শিশু যখন একবার ধর্ষিত বা যৌন হয়রানির শিকার হয়, মনে রাখতে হবে–  পরবর্তীতে তার ধর্ষিত ও যৌন হয়রানির ঝুঁকি আরো বেশি বেড়ে যায়। কেননা, সেই নারী বা শিশুটি তখন মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। এ অবস্থায় তাকে সহজে ব্ল্যাকমেইল করা বা ভয় দেখিয়ে চুপ করে রাখা যায়। প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কায় সে তখন একরকম বোবা হয়ে যায়, নিজের কথা প্রকাশ করার মত অবস্থায় সে থাকে না। যদিবা কখনো প্রকাশ করেও, সেক্ষেত্রে সমাজ তাকে চুপ করে থাকা, বেশ্যা টাইটেল দেওয়া কিংবা গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া ছাড়া কোন অপশন রাখে নি। আপনারাই বলুন, এরকম শ্বাসরুদ্ধকর একটি সমাজে বাস করে একজন ধর্ষিতা কী করে ধর্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে?
বলি, আগে যদি একথাগুলো ধর্ষিতা নারীটি আপনাদের বলতো তবে কি এমন উদ্ধার করে ফেলতেন আপনারা? তার বলার মত অনুকূল পরিবেশ কবে কোনদিন আপনারা দিয়েছিলেন যে, সে আপনাদের কাছে এসে নির্ভয়ে, মনের আগল খুলে তার সব কষ্টের কথা বলতে পারবে?
আপনারা তো শুধু ধর্ষণের রগরগে বর্ণনা শুনে মজা নিতেই পারবেন। আপনাদের কাছে সুবিচার প্রত্যাশা করাও বোকামো।
তারপরেও কেউ যদি চুপ না থেকে প্রথমেই ধর্ষকের বিরুদ্ধে কখনো  অভিযোগ করে , তাতেও কি আপনাদের প্রশ্ন থেমে থাকতো?  ধর্ষকদের রক্ষা করতে ধর্ষিতার বিরুদ্ধে আপনাদের প্রশ্নবাণ তো প্রস্তুত করাই আছে,
” মেয়েটি ওরকম পোশাক পরলো কেন?”
“মেয়েটি ওখানে গেলো কেন?”
“রাতে ঘর থেকে বের হলো কেন?”
“তনু তো নাটক, নাচ গান করতো, তাই না?”
“ভালো মেয়ে হলে কি আর কেউ এসব বলে?”
আপনাদের প্রশ্ন চলতেই থাকবে ধর্ষকদের রক্ষা করার জন্য। এজন্যই নারীরা ধর্ষিত হলেও, চরম অপমানিত হলেও চুপ করে থাকে, কিছুই বলতে পারে না, প্রতিবাদ করতে পারে না। গলা কাটা মুরগির মত মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করলেও সে কিছুই কাউকে বলতে পারে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, কখনো কেউ যদি মুখ খুলে ফেলে কোনদিন, তখন আপনারা প্রশ্ন করবেন, “এতদিন কিছুই বলে নি কেন?”

শেয়ার করুন: