চম্পটের সুযোগসন্ধানী পুরুষ এবং অন্যরা

সীনা আক্তার:

সৎ বাবা আরমান হোসেন সুমন টানা আট বছর মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। সৎ বাবা বা মায়ের ছেলে বন্ধু দ্বারা শিশু ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন সাধারণ নিকৃষ্ট ঘটনা। এমনকি নিজ বাবা কর্তৃক এমন ঘটনা বিরল নয়। আমাদের চারপাশেই এমন অনেক ঘটনা বিদ্যমান, কিন্তু আমরা ঐ ‘কাকের মত চোখ বন্ধ করে’ আত্মপ্রসাদ লাভ করি। আমার নিজের জানাশোনা অনেক ঘটনার মধ্যে কয়েকটা এখানে উল্লেখ করছি,

১. এক ভদ্রমহিলা ছোট-বড় কয়েকজন বাচ্চা নিয়ে বিধবা হয়েছেন। এর মধ্যে একজন ১৪, অন্যজন ১২ বছরের মেয়ে আছে। স্বামী হারানোর শোক এবং সংসারের চাপে ভদ্রমহিলা দিশেহারা। তার এই অসহায়ত্বকে পুজি করে একজন অবিবাহিত পুরুষ হাত বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের বিয়ে হয়। একদিন সেই স্বামী ১৪ বছরের সৎ মেয়ের উপর হামলে পরে। মেয়ের চিৎকারে মা পুলিশে ফোন করেন এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনাটি বিলাতের তাই এতটা দ্রুত ব্যবস্থা হয়েছে।

২. আরেক ভদ্রমহিলার ৫-৬ বছরের শিশু কন্যার সাথে তার পুরুষ বন্ধুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। দেখা হলেই দু’জনে মিলে খেলে, বন্ধুটি তার শরীরের উপর বাচ্চাটিকে হাঁটতে দেয়, পরস্পরকে কাতুকুতু দেয়, যা আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে করতেন ঐ মা। একদিন মা লক্ষ্য করেন, শিশুটি ঐ বন্ধুর পাশে বসে টিভি দেখার সময় লোকটি প্রায় সারাক্ষণ শিশুটির পেটে হাত দিয়ে রাখে। তাতেও ঐ মায়ের অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। একদিন মা রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত এবং শিশুটি বন্ধুটির সাথে হৈ চৈ করে খেলছে অন্য রুমে। এক সময় মা সেই রুমে গিয়ে দেখে শিশুটি চাদর গায়ে শুয়ে আছে। মাকে দেখেই অপ্রস্তুত বন্ধুটি বলে: ”দেখো, সে কী করেছে”।

মা: ”কী করেছে?” বলতে বলতে সে চাদর সরায়ে দেখে শিশুটি পুরো উলঙ্গ। জিজ্ঞেস করে, ‘উলঙ্গ হয়েছো কেন?’ শিশুটি হাসে, কিছুই তেমন বলতে পারে না, কিন্তু বন্ধুটির মুখ রক্তিম।

৩. এক দম্পতির বিচ্ছেদের পর তাদের ১২ বছরের সুস্থ-স্বাভাবিক কন্যাটি বাবার সাথে বসবাস করে। এই কিশোরী একবার গর্ভবতী হলো, কিন্তু কিভাবে ঘটেছে তা সে বলতে পারে না। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা মনে করলো, হয়তো সে বলতে চাইছে না এবং তাকে এ্যাবরশান করানো হয়। কিছুদিন পর সে আবারো গর্ভবতী হলো এবং এবারও সে কিছুতেই বলতে পারে না, কীভাবে কী হয়েছে। পেশাজীবীরা তদন্ত শুরু করলো এবং এক পর্যায়ে জানা গেল প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে তার বাবা তাকে দুধ খেতে দেয় এবং দুধ খেয়ে সে গভীর ঘুম দেয়।

যাই হোক, ঐশীর কথা আমাদের মনে থাকবার কথা যে নিজ মা-বাবাকে হত্যার দায়ে এখন দণ্ডিত অপরাধী। আমার একটা লেখায় ঐশীর সাথে তার বাবার সম্পর্ক তদন্তের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু এক পত্রিকা তা বাদ দিয়ে ছাপিয়েছিল, কারণ আমাদের সমাজে এসব বিষয় কার্পেটের নিচে রাখতেই স্বস্তি বোধ করে। এভাবেই ধর্ষণের মতো অপরাধকে সামাজিকভাবে সহনীয় করা হয় এবং পরিণতিতে শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে।

সৎ বাবা আরমান দ্বারা কিশোরীটি প্রথম ধর্ষণের শিকার হয় ১২ বছর বয়সে। তখন মেয়েটি হয়তো জানতোই না যে তার প্রতি একটা অন্যায় আচরণ হচ্ছে। কারণ আমাদের শিশু, কিশোর-কিশোরীদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট সঠিক জ্ঞান-তথ্য দেয়া হয় না। বরং চেপে রাখার দীক্ষা দেয়া হয়। আমাদের চারপাশে শিশুকামী, ধর্ষক পুরুষের অভাব নেই, যা তাদের শিক্ষা, পদবী এবং অবস্থান দেখে বোঝার উপায় নেই। এ ধরনের পুরুষরা হয়তো সচেতনভাবে মেয়ে শিশুসহ নারীর প্রতি ভালবাসার ভান করে। কারণ এভাবে খুব সহজেই এই নিকৃষ্ট পুরুষরা শিশুদের কাছাকাছি আসতে পারে।

সম্পর্ক-বিয়েতে পুরুষের মানসিকতা, নীতি মূল্যবোধ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং ভাইস-ভার্সা। তবে শিশু, বিশেষ করে কন্যা শিশুসহ একাকি মায়েদের সঙ্গী নির্বাচনে এ বিষয়টি বিবেচনা করা বাধ্যতামূলকভাবে আবশ্যক। সৎ বাবা আরমানের কু-কর্ম আলোচনায় অনেকেই মায়ের ভূমিকা নিয়ে কথা বলছেন। ঘটনাটি বিলম্বে প্রকাশিত কেন, তা নিয়েও কথা হচ্ছে। এই মুহূর্তে এসব বিষয়ে সমালোচনা মানে ধর্ষণ এবং ধর্ষকের উপর থেকে ফোকাস সরানো, যা মূল অপরাধকে লঘু করতে থাকে। তাছাড়া ভিকটিম ব্লেম (victim blame) অপরাধকে সামাজিকীকরণে সহায়তা করে এবং অপরাধীকে চম্পট দেবার সুযোগ করে দেয়। অধিকন্তু ভিকটিম মেয়েটির মায়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক-মানসিক-মেধাগত সক্ষমতা সম্পর্কে আমরা জানি না এবং সেজন্য তার সম্পর্কে চূড়ান্ত বিচার করে মন্তব্য না করাই ন্যায়সঙ্গত।

আমি যা করতে পারি, আমি যা ভাবি, আমি যেভাবে ভাবি অন্য নারীরা কেন তেমন নয়! এই দৃষ্টিভঙ্গীতে কাউকে বিবেচনা করা অশোভন এবং অযৌক্তিক। এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে ধর্ষক আরমানের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, এবং সেখানেই আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকা অত্যাবশ্যক।

লেখক: সমাজবিদ।

শেয়ার করুন: