ইনসেস্ট ট্যাবু এবং আমাদের পরিপ্রেক্ষিত

ঈশিতা বিনতে শিরিন নজরুল:
চাকুরী করার সুবাদেই বেশ কয়েকমাস আগে আইনী সহায়তার হটলাইনে স্থানীয় শাখা অফিস থেকে আইনী সহায়তা চেয়ে একটি ফোন আসার বিষয়ে জানতে পারি। একজন বাবা কয়েকবারই তার নয় বছর বয়সী কন্যাশিশুটিকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে! কন্যার মা যখন তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে তখন সে স্বামীর হাতে অসম্ভব মার খায়। কিন্তু স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মামলা করার পক্ষে ছিলেন না, এজন্য যে তাতে নাকি সেই কন্যাটির ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেই বাবাকে এটেমপ্ট টু রেপ কেস না দিয়ে স্ত্রীর ওপর শারীরিক নির্যাতন করার জন্য মামলা দেয়।
বেশ কয়েকমাস আগের ঘটনা… না… সংবাদপত্রে এটি অপ্রকাশিতই থেকে গিয়েছে। এই পুরুষটির জীবনবৃত্তান্তে জানা গিয়েছে…. সে সবসময়েই কারও না কারও সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করে থাকে!
এরকম হাজারও ঘটনা অপ্রকাশিতই থেকে যায়, কখনও নিজের পরিবারের কাছে অথবা কখনও সমাজের কাছে।
মুম্বাই এর একটি ঘটনায় মায়ের সামনেই কয়েক বছর ধরে বাবার হাতে ধর্ষণের শিকার হয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিল সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। 
১৩ বছরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী চিঠিতে লিখেছিল, আমার বাবা আমাকে ধর্ষণ করে, মা সব জেনেও আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেন না। থানা-পুলিশ বা বাইরের কাউকে ঘটনাটি বলার সাহস ছিল না তার। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ক কাউন্সেলিং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘হায়েনা বাবার’ কুকীর্তির কথা শিক্ষককে জানালে বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশকে মেয়েটি জানিয়েছে, ‘মায়ের সামনেই বাবা আমাকে ধর্ষণ করতো। তারপর মাঝে মাঝেই মা আমাকে একটা করে ওষুধ খেতে দিত। আমার যখন সাত বছর বয়স, তখন থেকে চলে আসছে এই ঘটনা। মা কখনই আমাকে সাহায্য করেনি।’(রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুলাই ২০১৫)
নিজের মেয়েকে চার বছর ধরে ধর্ষণ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সর্বোচ্চ আদালত ৪১ বছর বয়সী এক বাবাকে ১ হাজার ৫০৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই সঙ্গে আদালত মন্তব্য করেছেন, ‘এ ধরনের অপরাধ সমাজের জন্য ভয়াবহ।’ আদালতের কৌঁসুলি নিকোল গালস্টান মেয়েটির নাম প্রকাশ না করে বলেন, কিশোরী বয়সে মেয়েটি এক পারিবারিক বন্ধুর দ্বারা প্রথমবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। এরপর নিজের বাবার দ্বারা সে ধর্ষণের শিকার হন। তিনি আরও বলেন, মেয়েটি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান। এরপর তিনি তাঁর বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে সক্ষম হন। 
অনেকে মনে করেন যে,দেশে যৌনশিল্পের বৈধতাই নাকি ধর্ষণ সংখ্যা কমাতে পারে!! আদৌ কি তাই? যৌনতার অনেক প্রকার রয়েছে। একেকজন একেক প্রকারে আনন্দ পায় বলেই পর্নোসাইটগুলো সেইভাবেই তাদের ভাণ্ডার সাজায়। ঘরের বউকে শতশত বছর ধরে শেখানোই হয়েছে স্বামী চাইলেই তাকে তৃপ্ত করতে হবে। তাই তার সাথে জোর-জবরদোস্তির বিষয়টিই গৌণ।
আর রইলো পতিতালয়! যার সাথে অর্থনৈতিক বিষয়াদি সম্পৃক্ত,হোক আমাদের দেশে তা বৈধ, কি নয়! তাই সে বাধ্য। অন্যদিকে সতীত্ব বলে যে পুরুষতান্ত্রিক হেজিমনি আমাদের সমাজে বহুল জনপ্রিয়,তার জোরেই ধর্ষণ আরও বেশি পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে! এই পুরুষটির মতো অসংখ্যজন জোরজবরদোস্তি করেই যৌনতার স্বাদ পেতে চায় বলেই তো কেউ ধর্ষণে সেঞ্চুরী করে পার্টি করে, কেউ জন্মদিনে ধর্ষণ করে উদযাপন করে!!
এই পুরুষদের জন্য পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দিলেও তারা ধর্ষণ করবেই। ধর্ষণ সেটাই যে যৌন সম্পর্ক জোরপূর্বক বা সঙ্গীর অসম্মতিতে করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ঘরে-বাইরে সবখানেই তো ধর্ষনের গল্প লুকিয়ে রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর সহবাসে স্ত্রীর সম্মতি-অসম্মতির বিষয়টি তো একভাবে পরিহাস মাত্রই!! তাই প্রতি রাতে যে ঘরের ভেতরেই কত ধর্ষণ হয় তা কে বলতে পারে!! ওহ…. ভুলেই তো গিয়েছি,স্বামী তো পুরুষের অধিকারবলেই স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরও অধিকার পেয়ে যায়; সেখানে আবার ধর্ষণ বলে নাকি!!
আর বাইরে তো দুই কি চল্লিশ বছর, ছোট্ট মেয়ে শিশু কি বয়স্ক নারী, আনাচে-কানাচে হাজারও ধর্ষণের গন্ধ কুলষিত হয়ে আছে!! হাজারে কয়টা ধর্ষণের সংবাদ আমরা পাই? কয়টা ধর্ষিত শিশুর ট্রমাকে আমরা দূর করতে পারি?কয়জন ধর্ষিতার বিচার প্রার্থনার দুর্বিসহ প্রক্রিয়ায় তার পাশে থাকতে পারি? কয়জন নরখাদকের শাস্তি পাওয়াতে পারি?

কিছুই আমরা পারি না। অামরা শুধু ধর্ষণের ঘটনা শুনলে কার দোষ বেশি সেটা খুঁজতেই বেশি পটু!! সেটা নিয়ে তর্কে আমরা বিশ্বসেরাও বোধ করি হতে পারি!! প্রকৃত বিচারিক প্রক্রিয়া হয়তো কিছুটা হলেও ধর্ষণ কমাতে পারতো। কিন্তু বিধিবাম, ধর্ষিতাই যেখানে সতীত্ব-অসতীত্বের তকমার বেড়াজালে কাউকে জানাতেই ভয় পায়; অথবা মামলার চলাকালীন সংকটময় পরিস্থিতি, এসব থেকে বললেই কি মুক্তি পাওয়া এতোই সহজ? 

অামরা তো আসলে বলতেই ভয় পাই। লড়াই করতে ভয় পাই। যখন পরিবারের কেউ যখন ছোট্ট কি বড় মেয়েটির সাথে এধরনের যৌনতায় লিপ্ত হতে চায় তখন সে সেই সাহস সথেকেই করে যে মেয়েটি বললেও তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না!! ঘটনা কিন্তু আসলেও তাই।

মা যদি শোনে তার স্বামী, ভাই বা পরিবারের অন্য যেকোনো ‘বিশ্বস্ত’ পুরুষ পরিবারের ছোট্ট মেয়েটির সাথে জোর করে সঙ্গমে লিপ্ত হতে চাইছে; তখন অাদৌ সেই মায়ের পক্ষে কি বিশ্বাস করা সম্ভব? অথবা যদি মনে করি বিশ্বাস করলোও, তো মা কাকে বলবে যে নিজেও বিশ্বাস করবে? আমাদের সমাজের কাঠামো এমনই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যেখানে প্রথমেই অবিশ্বাস হবে পরিবারের মানুষ বিধায়, দ্বিতীয়ত ভিকটিমের বয়স শুনেই মানুষ বলবে নিশ্চয়ই কোন কারণে ফাঁসাতে চাচ্ছে, সেইজন্য এধরনের বদনাম দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তো, কোথায় মায়ের ও মেয়ের পক্ষের মানুষজন আমাদের এই সমাজে?? তারা লড়তে চাইলে সেই লড়াইটি হবে তাদের নিতান্তই ব্যক্তিগত সাহসের লড়াই। এই লড়াইয়ের রসদ বেশিরভাগ সময়েই অপর্যাপ্ত থাকে, তাই লড়াইটি সবসময়েই অসমাপ্তই থেকে যায়।

তবে আমাদের উচিৎ চিরাচরিত ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সত্যকে বিশ্বাস করা, অথবা অন্তত ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করা যেন সেই মেয়েটিকে ভয়াবহ ট্রমা থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়। 

আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন ১৯৯৭ সাল থেকে সেখানে সংঘটিত ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের পরিসংখ্যান প্রকাশ করছিল যে, ১৯৯৭ সনে শতকরা ৩৫ শতাংশ শিশুর যৌন নিপীড়ক ছিলো তার মা,বাবা ও ভাই।  যে সংখ্যাটি ১৯৯৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫%  হয়েছিল।  ডাবলিন শহরে শিশুদের যৌন নিপীড়নের প্রায় অর্ধেকই সংঘটিত হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের হাতে , যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এবং শতকরা ৫০ শতাংশ ধর্ষণ করছে আত্মীয় স্বজন। লোকলজ্জা ও পারিবারিক বন্ধনজনিত কারণে বিষয়গুলো পরিবারের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়।

যেগুলো প্রকাশিত হয়, সেসব ক্ষেত্রেই দেখা যায় বেশিরভাগ অভিযোগকারী আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয় না।বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ শিশুই পারিবারিক গণ্ডিতে ধর্ষণ থেকে শুরু করে স্পর্শজনিত নিপীড়ন পর্যন্ত কোনও না কোনও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এটি বিশ্বের সবখানের একটি মহামারী রোগ। একটু সচেতনতা, সাহস আর প্রতিবাদই হয়তো আপনার মেয়েটির বিভীষিকাময় জীবন থেকে রক্ষা করতে পারে। 

Eshita Binte Shirin Nazrul                                                                                                                       
Anthropologist , Researcher & Blogger
Bad Homburg, Germany
শেয়ার করুন: