উইমেন চ্যাপ্টারের সাম্প্রতিক লেখা নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া

শাশ্বতী বিপ্লব:

শিশু পালন একটি বিশেষ দক্ষতা, যেটা সবার থাকে না। এমনকি অনেক মা বাবারও না। কিন্তু নিজের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে তারা অনেকক্ষত্রেই উতরে যান। শিশু লালন পালনের জন্য সেই শিশুটির প্রতি এই ভালোবাসা থাকাটা খুব জরুরী। শুধু মানবশিশু কেন, যে কোন প্রাণী লালন পালনের ক্ষেত্রেই সেটি সত্যি। শুধু দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা দিয়ে অন্ততঃ এই কাজটা সঠিকভাবে করা কখনোই সম্ভব নয়।

সাধারণতঃ মানুষ নিজের সন্তানকে যতটা ভালোবাসে, অন্যের সন্তানকে ততটা নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, মা বাবার বাইরে নিকটবর্তী পরিবারের সদস্যদের/ আত্মীয়দের মাঝেও অনেকসময় এই ভালোবাসার ঘাটতি দেখা যায়। (আবার অনেক মানুষ সম্পূর্ণ অনাত্মীয় কোন শিশুকেও গভীরভাবে ভালোবাসেন, যদিও তারা সংখ্যায় খুবই কম।)

যেমন ধরুন, গত বছরের ভারতীয় হিন্দি সিনেমা “কাহানী ২” কথা। সেখানে “মিনি” নামের ৭-৮ বছরের এতিম মেয়েশিশু তার আপন চাচা দ্বারা নিয়মিত যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। এবং মিনির স্কুলের একাউন্ট সেকশনে কাজ করা দূর্গা সেটা আবিস্কার করে যখন সেটা নিয়ে সেই চাচার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলে, তখন শিশুটির দাদী শিশুটিকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে, অপরাধী ছেলের পক্ষ নেয়।

অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই অনেক শিশুর বাস্তবতা। অথচ, এই পরিবারটি অশিক্ষিতও নয়, বা দাদীটি কাজের মেয়েও নয়। এমনকি তারা অপ্রাপ্তবয়স্কও নয়। তবুও, নিজের ছেলের, ভাইয়ের ঔরশজাত সন্তানের প্রতিই মানুষ কতটা নির্দয় হতে পারে।

এইরকম যখন এই মানবসমাজ, তখন একজন বেতনভোগী গৃহকর্মী, যাদের অধিকাংশ নিজেরাই শিশু, তাদের কাছে কতটা আশা করা যায়? সকল সুযোগ, সুবিধা দিলেও মাতৃত্বের বা পিতৃত্বের মমতা দিয়ে তারা আপনার সন্তানকে কেন দেখবে? কিভাবেই বা দেখবে? সে নিজেই তো শিশু, তারতো কাজই করার কথা নয়।
বরং তারা কেন এই বিরূপ আচরণ করে/ করছে, সেই কারণগুলো খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে কথা বলা, তার প্রতিকার করাটা যুক্তিযুক্ত।

উইমেন চ্যাপ্টারে আমি নিয়মিত লিখি। তাই উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদকের সাম্প্রতিক লেখাটা এড়িয়ে যেতে পারলাম না। সারাদিন চুপ করে থেকেও মনে হলো কিছু লেখা উচিত। ভুল হয়েছে, এই লেখাটায় অনেকগুলো ভুল হয়েছে। আমি এই লেখাটার সাথে একমত নই। আমার যদি দুজন পাঠকও থাকে, তাদের কাছে আমার অবস্থান পরিস্কার করা দরকার বলে মনে হয়েছে।

কিন্তু, এই লেখাটার চাইতেও আমি অবাক হয়েছি স্বয়ং সুপ্রীতি ধর এটা লিখেছেন বলে। একদিন আগেই যে মানুষটা লিখেছেন, “এই শিশু নির্যাতককে চিনে রাখুন” এর মতো বলিষ্ঠ একটি লেখা, তার পরদিনই তিনি কিভাবে এরকম একটা লেখা লিখলেন!!  উইমেন চ্যাপ্টারের একজন লেখক হিসেবে আমি যেমন মর্মাহত হয়েছি, ঠিক তেমনি তিনি ভুল স্বীকার করে তাৎক্ষণিক আরেকটি লেখা লিখেছেন বলে মন থেকে তাকে স্যালুটও করেছি। কারণ ভুল আমরা অনেকেই করি, আমাদের সবারই সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু সেটা স্বীকার করার সৎ সাহস সবার নেই। সেটা উনি করে দেখিয়েছেন।

এখন, এর সমালোচকদের উদ্দেশ্য দুটি কথা বলতে চাই। আপনাদের আমি শুভানুধ্যায়ী হিসেবেই দেখতে চাই। এই যে আপনারা হতাশ হয়েছেন, এটাও একটা পজিটিভ দিক বলেই আমি মনে করি। তারমানে এই প্লাটফর্মের কাছে আপনাদের/ পাঠকের একধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আপনারা এখানকার লেখায় ন্যূনতম একটি মান আশা করেন। সেদিকে উইমেন চ্যাপ্টারকে নজর দিতে হবে বলে মনে করি।

এখানে মনে রাখা দরকার, উইমেন চ্যাপ্টার মানে শুধু সুপ্রীতি ধরের একটি লেখা নয়, উইমেন চ্যাপ্টার মানে বহু নারীর মন খুলে কথা বলার এক প্লাটফর্ম। সেই কথাগুলো সবসময় হয়তো ঠিক হয় না, সবসময় আপ টু দ্য মার্কও হয় না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, অনেক সমৃদ্ধ লেখাও এখানে ছাপা হয়। এবং তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এখানে যেকোন মেয়ে (এবং পুরুষ) মনের ভেতর কথা চেপে না রেখে অন্ততঃ প্রকাশ করতে পারেন, প্রতিবাদ করতে পারেন, তাই বা কম কিসে?

আজ যারা আশাহত হয়েছেন, তাদের প্রতিও অনুরোধ থাকবে, আপনারাও লিখুন, বলুন যেগুলো উইমেন চ্যাপ্টার বলছে না, কিন্তু বলা উচিত বলে আপনারা মনে করেন।

বিন্দু বিন্দুতেই সিন্ধু হয়। এভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই, ভুল ধরিয়ে দিয়ে এবং ভুল শুধরে নিয়েই উইমেন চ্যাপ্টার এগিয়ে যাবে। এবং একদিন একটি জায়গায় আমরা অবশ্যই পৌঁছাতে পারবো।

শেয়ার করুন: