দাদু – দীদা, চাচা – চাচী- ফুফুরা ছাড়াও সারাবছর গ্রামের আত্মীয় – স্বজন দিয়ে মঞ্জুলিকাদের বৃটিশ আমলের পুরনো বাড়িটা সরগরম থাকতো। মা, মেজো মা আর ছোট মাকে একান্নবর্তী পরিবারের এই বিশাল রাবণের গুষ্টির উদরপূর্তির জন্য উদয়াস্ত খাটতে হতো। রোজ জনা তিরিশেক লোকের তিনবেলার খাবার রান্না করা চাট্টিখানি কথা ছিলো না। সেজো মা রান্নাঘরে হাঁড়ি ঠেলার ঝক্কি পোহাতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। ঘরদোর ঝাড়ামোছা আর থালাবাসন ধোয়ার কাজটাও করতেন বিরক্ত মুখে। বই পড়তে বড্ড ভালোবাসতেন। পড়ালেখায় বেশ ভালো ছিলেন বলেই নাকি দ্রুত পাত্রস্থ করা হয় তাকে। বেশি লেখাপড়া জানলে বিয়ে – থা – সংসারে যদি মন না বসে – এই আশংকায় আর পাড়ার লোকেদের বুদ্ধিতে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সেজো মার বাবা, মেয়ের মতামতের তোয়াক্কা না করেই। সেজো মা বাড়ির অন্য বউদের মতো সংসারের যাঁতাকলে দিনরাত পিষ্ট হতে চাইতেন না। বই, কবিতা, গান নিয়ে নিজের একটা জগৎ ছিল।
সন্ধ্যে হলে বাড়ির এক পাল বাচ্চা – কাচ্চাকে নিয়ে মাদুর পেতে পড়তে বসাতেন। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, সুকান্ত সমগ্র থেকে মিঠেকড়া পড়ে শোনাতেন বাচ্চাদেরকে।
সঞ্চয়িতা থেকে “নিষ্কৃতি ” কবিতাটি বারবার শোনাতেন কেন যেন। হয়তোবা মঞ্জুলিকার সাথে কোথাও না কোথাও নিজেকে মিলিয়ে দেখতেন। পড়ার মাঝে হঠাৎ একদিন থেমে গিয়ে বললেন, আচ্ছা, তোকে ” মঞ্জু ” না ডেকে এখন থেকে ” মঞ্জুলিকা ” ডাকবো, কেমন ? কবিতার নামে নাম – মঞ্জুলিকার ছোট্ট মনে বেশ গর্ব হতে থাকে। তবু ক্ষীণকণ্ঠে বলে, ” মা আর দীদা বকবে না তো? “
সেজো মা সহজ ভঙ্গিতে বলেন, “কেউ কিছু বললে আমার কথা বলবি”।
সেই থেকে সে মঞ্জু থেকে মঞ্জুলিকা হয়ে গেল।
বিয়ের বছর না পেরোতে সেজো মা কে ঘিরে নতুন কানাঘুষো শুরু হলো। দীদা দিনরাত মাথা চাপড়াতেন, “এ অপয়া মেয়ে যে আমার কোনো কাজে আসবে না সে আমি মেলা আগেই বুঝে গেছি। বাজা বউয়ের সাথে আমার ছেলে করব আর আমারে তা দ্যাখতে হইবো? হারামজাদীরে ঝ্যাঁটায় খ্যাদা তোরা “…
কিছুদিন পর দীদার সারা শরীর হলুদ হয়ে জন্ডিস ধরা পড়লো। কবিরাজের নির্দেশে চলছিলো চিকিৎসা কিন্তু কোনো উন্নতি নেই।
যে কোনো ধরনের হলুদ রঙের খাবার আর ফল খাওয়া বারণ। সেজো মা কাউকে কিছু না বলে এক বিকেলে সোজা গিয়ে প্রতিবেশী ডাক্তার হেমেন্দ্র কাকুকে ডেকে নিয়ে এলেন। জানা গেল হলুদ ফলের সাথে জন্ডিসের সম্পর্ক নেই। কম তেল – মশলার রান্না খেলে আর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলেই চলবে।
একইভাবে রন্টুর জন্মের সময় ছোট মার জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হলে বাড়ির সকলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে দাদা আর বাবাকে রাজী করিয়ে হাসপাতালে নিয়ে ছেড়েছিলেন। নাহলে হয়তো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতো। এর আগে এবাড়ির সব বাচ্চাকাচ্চা বাড়িতেই হয়েছে।
এসবেও যে দীদার মন নরম হয় তা না। এমনকি রন্টুর জন্মের পর নিঃসন্তান হওয়ার অপরাধে সেজো মার কোলে রন্টুকে দেখলেই চ্যাঁচামেচি করতো বুড়ি।
মজার ব্যাপার হলো সেজো মাকে নিয়ে এতো কথা বললেও সামনে এলে সবাই তাকে বেশ ভয় পেতো বা সমঝে চলতো। সেজো মায়ের সরল দৃষ্টি এবং সোজাসাপ্টা চালচলনে কোনো ভণিতা ছিলো না। সম্মান করতেন কিন্তু কাউকে ভয় করে চলতেন না। অন্য বউদের মতো স্বামী – শাশুড়ির সব কথা শিরোধার্য মেনে চলা তার ধাতে ছিলো না। ছোট চাচা প্রায়ই ছোট মাকে মারধর করতো। অসুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো। ছোট মাকে বহুবার ব্যথায় শয্যাশায়ী হতে হতো।
সেজো মা কঠিন ভাষায় ছোট চাচাকে ধমকানোর সাহস রাখতেন। একবার এমন আঘাত পেয়ে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। সকালে উঠতে পারলোনা ছোট মা। দীদা আর ছোট ফুফু দরজার সামনে গিয়ে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিলো, ” বাড়ির বউ বেলা আটটা পর্যন্ত ঘুমায়, হায়া – শরম কিছুই নাই নাকি !!! ”
সেজো মা স্বভাবগত শান্তভাবে এগিয়ে গেলেন ছোট মার ঘরে। ছোট চাচা মাথা নীচু করে দ্রুতপায়ে নীচে নেমে যায়। সেজো মা শাশুড়িকে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, মা আপনি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেন। ছোটর কাছে আমি আছি, ওকে ডাকবেন না । ফিরোজা (ছোট ফুফু) আজকে ছোটর কাজগুলো করুক না !
দীদা আর ফুফু হনহন করে চলে গেল কিছু না বলে।
মঞ্জুলিকার বয়স তখন দশ হবে।
গ্রীষ্মের এক গনগনে দুপুরে সবাই যখন ঘুমিয়ে, এবাড়িরই এক আত্মীয় মঞ্জুলিকাকে সিঁড়িঘরে একলা পেয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরে। বহুকষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে সে একছুটে মায়ের কাছে না গিয়ে সেজো মার ঘরে গিয়ে হাঁপাতে থাকে।
সেজো মা সবটা শুনে মার কাছে বলেন,
” বুবু, এই লোকটা যেন আর কোনোদিন না আসে। ” মা অতি নরম মনের বোকাসোকা এক মানুষ। নিজের কোনো বক্তব্য তার নেই। ভয়ে ভয়ে বলেন, ” চুপ কর সেজো! এসব জানাজানি হলে লজ্জার শেষ নেই। তাছাড়া সম্পর্কে ফুপার ভাই “… সেজো মা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন , ” রাখো তো! পুরুষ মানুষ আবার খালু ! “
মঞ্জুলিকার সবসময় মনেহয়, সেজো মা ছিলেন বলেই এবাড়ির পরবর্তী প্রজন্ম মানে মঞ্জুলিকা, দীপা, রুনু, অভি, রঞ্জু, রন্টু – প্রায় সবাই আজ যে যার জীবনে, ক্যারিয়ারে সফল। তা নাহলে তাদের বিশেষ করে মেয়েগুলোর জীবন হয়তোবা কারো স্ত্রী আর সন্তানের মা হওয়ার মাঝেই আবদ্ধ থাকতো। সেজো মা ঘরের বাইরে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাটা আর করতে পারেননি। তাই বলে থেমে যাননি। সংসারে থেকেও পদে পদে লড়াই করেছেন। তার লড়াইটা আসলে শাশুড়ির বিরুদ্ধে ছিলো না। ছিলো পরিবারের, সমাজের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে যা প্রতিদিন অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে কন্ঠরোধ করে চলেছে মেয়েগুলোর ।
সেজো মার নাম হয়তো অনেকেই জানবে না কোনোদিন। তবু তার নিজস্ব জগতের হাতেগোনা কয়েকজনের জন্য হলেও তো তিনি জীবনকে অন্যভাবে দেখার জানালাটা খুলে দিয়েছিলেন চোখের সামনে।
মঞ্জুলিকাকে ফিরে যেতে হবে। জীবনের বাকীটা পথ পাড়ি দেবে সে সেজো মার দেখানো পথে।
কানে বাজতে থাকে, ” ঘরে – বাইরে বলে কথা নেই, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদটা করবি। কাউকে পাশে পাবি এই আশা না করেই প্রতিবাদ করবি। ওরা দেখবি তোকে নিয়ে নানা কথা রটালেও তোর প্রতিবাদের কাছে মাথা নত করবে। “
বৈরী এ সংসারে সেজো মা থাকবেন মঞ্জুলিকার জীবনের বাতিঘর হয়ে।