বিথী হক:
দু’দিন আগে উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক লেখক সুপ্রীতি ধরের “গৃহকর্মি যখন গৃহকর্ত্রী হতে চায়” শীর্ষক একটি লেখা নিউজফিড জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শিরোনামটাই এতো অপছন্দ হলো যে ভেতরে কী লেখা আছে তা পড়ার আগ্রহও পাচ্ছিলাম না। কী মনে করে তবু পড়লাম, সেও অনেক পরে।
পড়ার আগে যেমন ভাবছিলাম, পড়ার পড়ে ততখানি গুরুতর কিছু মনে হয়নি। তবু মন খারাপ হচ্ছিল এই ভেবে যে অনাকাঙ্খিত ও অপ্রত্যাশিতভাবে দিদির লেখাটা অনগ্রসর শিশু নির্যাতনকে অনেকখানি উস্কে দেবে। আয়শা লতিফদের মতো মানুষরাও আরেকটু গাঢ় করে কাজল পরবে, আগের পরা শাড়িটায় পায়ের আলতার দাগ পরিষ্কার হয়নি কেন বলে বেদম পেটাবে সাবিনাদের। মনটা খচখচ করছিল। উইমেন চ্যাপ্টারের অনেক লেখাই অনেকবার অপছন্দ হয়েছে। শুধু অপছন্দই হয়নি, তীব্র প্রতিবাদ করে কাউন্টার লিখে উইমেন চ্যাপ্টারকেই ছাপতে দিয়েছি। দিদির লেখার বিপরীতেও লেখা ছাপতে দেখলাম। দুপুরবেলা লেখক নাদিয়া ইসলামকেও দেখলাম দিদির লেখাটা তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে।
চিমান্দা গোচি আদিচির একটা বইয়ে পড়ছিলাম “ডোন্ট টার্ন দ্য অপ্রেসড ইনটু সেইন্টস।” আমাদের দেশে যে কোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আমরা প্রকৃত ঘটনা থেকে দূরে সরে গিয়ে ভিক্টিমবাদ চর্চা শুরু করি। কর্নেল তসলিমের স্ত্রী সামান্য ডিম পোড়ানোর ‘অপরাধে’ গৃহকর্মী সাবিনার সাথে যে নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে সেখানে শুরু করে কর্নেল-জায়ার সুন্দর মুখশ্রী, সাজগোজ, শাড়ি-গয়না কেন এখানে এতো গুরুত্ব বহন করতে শুরু করলো, এটাই আমার মোটা গোড়ার চুলওয়ালা মাথায় ঢুকলো না।
সুপ্রীতিদি’র লেখা পরে মনে হলো উনি নির্যাতিতকে সেইন্টে পরিণত করতে চাননি, মালকিনের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি গৃহকর্মীদের অপরাধ-অপকর্মগুলোকেও সামনে এনেছেন যে বিষয়টা আমিসহ অনেকেরই পছন্দ হয়নি। দিদি হয়তো বলতে চেয়েছিলেন পর্দার ওপারেও কিছু থাকতে পারে, হয়তো বলতে চেয়েছিলেন মালিকের মেজাজ খারাপের কারণ কিছুটা লেজিটিমেট হতে পারে। কিন্তু দিদি এটাও বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি আয়শা লতিফের পক্ষ নিচ্ছেন না!
যেহেতু আমাদের দেশে শ্রমিক দিয়ে কাজ করার ঐতিহ্য বেশ পুরনো এবং নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করানোতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, সেহেতু শিশুশ্রমিক অর্থাৎ গৃহকর্মী বিষয়ক অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি আছে তা বলা বাহুল্য। তাই আমরা জানি ছোটমাছের তরকারিতে শৈবাল, হাইড্রা, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন থেকে শুরু করে ঘাস লতাপাতা সব থাকে। তাই আমরা জানি ঘরদোর মোছার পরে যতটুকু জায়গায় পা রাখি এর বাইরে খাটের তলা, সোফা-আলমারির চিপায় তেলাপোকা-মাকড়সার দখলে। তাই আমরা জানি ঘরের বাচ্চার গায়ে অসংখ্য চিমটির দাগ দগদগে ক্ষত হয়ে ঘায়ে পরিণত হয়।
আমরা যেহেতু ঘরের কাজ করাকে অসম্মানজনক মনে করি এবং যেহেতু ঘরের নারী-পুরুষ দু’জনেই চাকরিজীবী হবার পরেও গৃহস্থালীর কাজ পুরোটাই সম্মানের স্কেলে নিম্মমাত্রার সম্মানীয় প্রাণী নারীর ঘাড়ে পড়ে, তাই অনেকখানি বাধ্য হয়েই নিজে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে গৃহকর্মি রাখতে হয় নারীদের।
আমাদের দেশে যেহেতু কোন আইনের বালাই নেই, আইন-কানুন, নিয়ম-নীতির ধার না ধেরেই আমরা ২ পাউন্ড ওজন নিয়ে জন্মে ২০০ পাউন্ডের শরীর নিয়ে মাটিতে জৈব সার হয়ে যাই, সেহেতু গৃহকর্মি আইন আছে কীনা সে খবর কে রাখে! মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ কারোরই খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই এ ব্যাপারে। আমাদের যেহেতু পড়াশোনা করাটা এক ধরনের বিলাসিতা, প্রচুর টাকা পয়সার ব্যাপার, যেহেতু আমাদের ৬০/৭০ টাকা কেজি দরের চাল না কিনতে পারলে না খেয়ে থাকতে হয়, সেহেতু নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বইখাতার পরিবর্তে ঝাড়ু, কলমের পরিবর্তে ডিশ ওয়াশার হাতে তুলে নেবে এ আর এমন কী ঘটনা! আর আমাদের টাকা থাকলে যেহেতু ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা দামের শাড়ি পরি এবং ৩ হাজার টাকা দামের গৃহকর্মী ঘরে পুষি সেহেতু কোনটাকে কতখানি প্রাধান্য দেবো, সেটাও আমরাই ভেবেচিন্তে দেই। আর সে ক্ষমতা আর টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার কে করেন না!
তো এই ক্ষমতা আর প্রভাব খাটিয়ে মানুষকে মানুষ মনে না করে আয়শা লতিফদের বিরুদ্ধ অবস্থানে না গিয়ে একজন নারীকে সমাজের ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে বাঁশ, লাঠি-সোটার সঠিক ব্যবস্থাপনার কথা যারা বলছেন, সাবিনাকে যে শক্তি ঝাপসা চোখে পৃথিবী দেখতে বাধ্য করছে, আর লেখক সুপ্রীতি ধরকে যারা মাগী, বেশ্যা আর নষ্ট এলিট-নারীবাদী তকমা লাগিয়ে জনসম্মুখে হেনস্থা করছেন, মোটা দাগে তাদের চিহ্নিত করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। একটু মাথা খাটালেই বোঝা যায় সুপ্রীতি ধর আয়শা লতিফের পক্ষ নিয়েছেন নাকি সাবিনার পক্ষে কাজ করেছেন। একটু দু’চোখ খুলে নজর রাখলেই বোঝা যা্য় লেখক সুপ্রীতি ধর তার ছোটবেলার গৃহকর্মি সংশ্লিষ্ট কিছু স্মৃতি টেনে এনেছেন মুদ্রার দু’পিঠই দৃশ্যমান করতে।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারতো সময়-কাল নিয়ে। সমালোচনার জায়গা বা বিষয়বস্তু হতে পারতো, সুপ্রীতিদি এমন সময়টাই কেন তার স্মৃতিচারণের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিলেন! সমালোচনা হতে পারতো, তেল চিটচিটে বালিশে নারীদের স্বামী আবিষ্কারের দায় কেন গৃহকর্মির শরীরের ওপর বর্তাবে!
দু:খজনক হলেও সত্যি আলোচনা, সমালোচনা এর ধারেকাছে দিয়েও যায়নি। গেছে নোংরামির পর্যায়ে। এসে পড়েছে উইমেন চ্যাপ্টারের নাম, ‘নষ্ট-নারীবাদী’দের নাম। একটা সারাজীবন যা কিছু করে গেছে, তার সবকিছু একটা লেখা দিয়েই মুছে ফেলা যায়? একটা লাইন দিয়েই তার সব অবদান, সব ভালকাজ ধুয়েমুছে তাকে রেখে দেওয়া যায়?
উত্তরটা হচ্ছে, হ্যাঁ একটা লেখা দিয়েই একটা পুরো পোর্টালের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। আমাদের অশিক্ষা, অসহিষ্ণুতা আর অশ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি আমাদের অন্তত তাই শিখিয়েছে। এখন তাই নারীবাদকে ‘শখের আন্দোলন’ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। তাই সমাজের কাছে নারীবাদীদের মুখোশ (!) এখন আলগা হয়ে যাবে বলে হাততালি দিচ্ছেন অনেকেই। অনেকেই আবার রাগ করেছেন যে অন্যান্য প্রসঙ্গে যারা লবন-মরিচ ছিটিয়ে ছিটিয়ে লেখাকে ঝাল বানায়, তারা সুপ্রীতিদিকে এমন নরম করে কেন বলছেন!
সোজা কথায়, তাকে অসম্মান করে কেন কথা বলা হচ্ছে না! অনেকেই বলছেন উইমেন চ্যাপ্টার গৃহকর্মি, গার্মেন্টস শ্রমিক, শিল্প-কারখানায় কাজ করা নিম্নবিত্ত নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না! তারা যে কোনদিন উইমেন চ্যাপ্টার পড়েননি, সেটা এভাবে জানান না দিলেও কিন্তু পারতেন।
নিউজফিডে ঢুকলেই চোখে পড়ছে উইমেন চ্যাপ্টার, সুপ্রীতি ধর, নারীবাদ নিয়ে নোংরা নোংরা সব লেখা, ছবি। আমি এসব দেখতে চাই না। অথচ দেখতে না চাইলেও দেখতে পাচ্ছি চোখ ফুলে ঢোল হয়ে থাকা সাবিনা, আয়শা লতিফ আর সুপ্রীতি ধর এক কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। নোংরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তিনজনই। আয়শা লতিফের ঘৃণ্য কৃতকর্মকে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে তার লিঙ্গীয় পরিচয় দিয়ে, গৃহকর্মি নির্যাতনের ঘটনাকে দেওয়া হচ্ছে ‘শখের নারীবাদিরা’ সাবিনাকে শ্রেণী বহির্ভূত ভাবেন এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ দিয়ে, আর সুপ্রীতি ধরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তার তৈরি পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টার আর নারীবাদি প্ল্যাটফর্মকে ধ্বংস করে ফেলতে।
আপনাদের কি আরো কোনভাবে বলতে হবে, পুরুষতন্ত্র আর পুরুষশাসিত সমাজ সমাজের কোন কোন জায়গায় কতখানি ক্ষত তৈরি করেছে? আপনাদের কি আরো কোনভাবে বলতে হবে অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে ভাবুন, ভিক্টিমকে ভিক্টিম হিসেবে? আপনাদের কি আরো কোনভাবে বলতে হবে পাপকে ঘৃণা করুন? আপনাদের কি বলে দিতে বলতে হবে যার যার কৃতকর্মের জন্য জবাব চান, শাস্তি চান? আপনাদের কি বলে দিতে হবে অপরাধ লিঙ্গ দ্বারা জাস্টিফাই করা যায় না তাই শাস্তিও যেন না হয়।
শাড়ি, গয়না, চেহারা, শারীরিক গঠন সর্বপোরি নারী বা পুরুষ দিয়ে অপরাধকে বিচার করে গুরু বা লঘু কোনটাই না বানাই। আসুন অপরাধীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করি। এর মধ্যে নারীবাদ, হিন্দুত্ব, এলিটপনা ইত্যাদি জিনিসপত্র না টেনে আনি! ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ নির্বিশেষে অপরাধী শুধুমাত্র একজন অপরাধী, এই হোক তার পরিচয়।