সুপ্রীতি ধরের লেখা, আমাদের সিস্টেম আর কিছু ভাবনা

শারমিন শামস্:

উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধরের একটি লেখা নিয়ে তুমুল আলোচনা সমালোচনা চলছে দেখলাম। লেখাটা আমি গতকালই পড়েছি। চারপাশে এই লেখার বিরুদ্ধে তুমুল আপত্তি ওঠার প্রেক্ষিতে আমি এ নিয়ে আমার কিছু মতামত লিখছি।

প্রথমেই বলে রাখি, উইমেন চ্যাপ্টারকেই প্রথম দেখেছি আয়েশা লতিফের ছবি প্রকাশ করে তার অপকর্মের কথা মানুষকে জানিয়ে একটি বিস্তারিত নিউজ করেছে। সেই নিউজ হাজার হাজার শেয়ারও হয়েছে। পোর্টালটি এ বিষয়ে আরো বেশ কিছু লেখাও প্রকাশ করেছে। সবই আয়েশা লতিফের গৃহকর্মী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে লেখা। অতএব ধরে নিচ্ছি, উইমেন চ্যাপ্টার এই নিন্দনীয় ঘটনার প্রতিবাদ করে গেছে প্রথম থেকেই।
এখন আসি দিদির লেখাটি প্রসংগে।

সুপ্রীতি ধরের লেখার বক্তব্য আমি ধরতে পেরেছি। তিনি কী বলতে চেয়েছেন, সেটা আমার বোধগম্য হয়েছে। কীভাবে হয়েছে, তা বলতে গেছে কিছুটা নিজের সম্পর্কে কথা বলতে হবে, যা বেশ অপ্রিয়। তবু বলব। সাথে আরো কিছু বিষয়ও লিখব আজ। তবে তার আগে দিদির লেখাটির একটা ছোট সমালোচনা করে নিই। লেখাটা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, লেখাটা অগোছালো, বিক্ষিপ্ত। সম্ভবত খুব কাজের চাপে, মানসিক অস্থিরতা নিয়ে লেখাটা লেখা হয়েছে। অথচ একজন লেখক যখন লিখবেন, তার উচিত শান্ত মন নিয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে প্রতিটি লাইন যাচাই করে বুঝে লেখা। দিদি এই কাজটিতে অবহেলা করেছেন। ফলে যা বুঝাতে চেয়েছেন, তা পরিস্কার বুঝাতে পারেননি। ফলে সমালোচকের হাতে অস্ত্র উঠে গেছে সহজেই। আর বরাবর যা হয় তাই হয়েছে, লেখার মূল বক্তব্য না বুঝে, সাব বক্তব্য নিয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ শুরু হয়ে গেছে।

এবার আসি গৃহকর্মী নির্যাতন প্রসঙ্গে। ছোট্ট সাবিনার বীভৎস ছবিটার দিকে তাকানো যায় না। নিউজ ফিডে যতবার এই ছবি এসেছে, আমি দ্রুত স্ক্রল করে নিচে নেমে গেছি। বাচ্চাদের উপর যেকোন নির্যাতন আমি নিতে পারি না। পরে দেখলাম সাথে আয়েশা লতিফের ছবি। দেখলাম মহিলার ব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ ঘৃণা প্রকাশ করছেন সবাই। এটি একটি ভালো উদারহণ। ক্ষমতাবান, পয়সাওয়ালা মনে রাখবে, টাকা দিয়ে তারা ন্যায়বিচার কিনে নিতে পারলেও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা যেভাবে বিচারের মুখোমুখি হবেন, তা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

তো, একই সঙ্গে দেখলাম, আয়েশা লতিফের শাস্তি দিতে অনেকেই তাকে বেশ্যা, মাগী বলে গালি দিচ্ছেন। তার রঙ রূপের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, অনেকেই তার ‘জায়গামত’ বিশেষ কিছু দিয়ে আঘাতের কথাও বলেছেন। এখন, সাবিনা নির্যাতনের ঘটনাটি যেমন একটি ঘটনা, তেমনি ক্রিমিনালের লিঙ্গ নারী বলে তার প্রতি ঘেন্না প্রকাশের ধরণটিও এখানে একটি ঘটনা। আমি আয়েশা লতিফের কর্মকাণ্ডের জন্য তার প্রতি তীব্র ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছি। তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু যারা ওই নারীর ‘জায়গামতো’ কিছু ঢুকিয়ে শাস্তি দিতে চাচ্ছেন, তাদের প্রতিও আমার তীব্র ঘৃণা।

এখন এটি মুদ্রার আরেকটি পিঠ। যেরকম দিদির লেখাটি। সুপ্রীতি ধরের উইমেন চ্যাপ্টার প্রথম থেকেই গৃহকর্মী নির্যাতনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সেই উইমেন চ্যাপ্টারে খোদ সম্পাদক আরেকটি ভিন্ন আঙ্গিকে একটি লেখা ছেপেছেন, যা পোর্টালটি সবসময়ই করে থাকে। সেটি গৃহকর্মীদের আচরণ সম্পর্কিত।

গৃহকর্মী আমরা সবাই রাখি এই দেশে। এখন যে দেশে সংসারের সমস্ত কাজ মেয়েদের একা হাতে সামলাতে হয়, সেই দেশে গৃহকর্মী রাখতে বাধ্য হয় মেয়েরা। এখন আমরা সবাই জানি গৃহকর্মীরা, বিশেষ করে বুয়া হিসেবে আমারা যাদের জানি, তারা আমাদের কীভাবে প্রতিদিন নাস্তানাবুদ করে। এই নাস্তানাবুদের সাথে না পোষালে গৃহকর্মী রাখবেন না, এটিই সহজ সুন্দর সুস্থ হিসাব। কিন্তু যারা গৃহকর্মীর প্রতি নির্যাতন চালিয়ে তাদের সার্ভিস প্রবাহ অবব্যাহত রাখতে চান, তারা বিকারগ্রস্থই বটে।

কিছুদিন আগে একটা ছবি দেখলাম। এক মহিলা ঈদরে বাজার করে রিকশায় স্বামীর সাথে ফিরছেন। রিকশার পিছনে হুড ধরে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে ১৪/১৫ বছর বয়সের গৃহকর্মী। এর চেয়ে কুৎসিত কোন দৃশ্য হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না।হাজার হাজার টাকা শাড়ি জামার পিছনে খরচ করে তার আরেকটি রিকশা নেবার টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল সম্ভবত!
আরেকটি ছবি দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। দামি রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে হাসব্যান্ড ওয়াইফ বাচ্চা। পাশে এক কোন দশ বারো বছরের গৃহকর্মী মেয়েটি বসে আছে জরোসরো।তার সামনে কোন খাবার নাই। তো এই দৃশ্য আমি বাস্তবেই দেখেছি। অসুস্থ মনোজগতের প্রতিচ্ছবি। তো সিস্টেমটাই তো অসুস্থ। বাড়ির ড্রাইভার, পিয়ন, বুয়া, কাজের সাহায্যকারী- এদেশে এদের বাড়ির খাটে, সোফায় বসার অনুমতি নাই। এরা বসে মাটিতে, মোড়ায়। এরা খায় রান্নাঘরে। এরা শোয় মেঝেতে পাটি বিছিয়ে। তো এই গোড়ায় গলদের দেশে আর হবে টা কী?

এখন নিজের কথা বলি।আমার বাসার সাহায্যকরী মেয়ে যারা থাকে আমার মেয়ের দেখাশোনার জন্য তারা কখন্ও মাটিতে বসে না, রান্নাঘরে খায় না, মাটিতে ঘুমায় না। তাদের পড়াশোনার দায়িত্ব আমি নিই এবং বাসায় টিচার রাখি। ভালো বেতন দেবার চেষ্টা করি। ভালো দোকানের পছন্দের পোশাক কিনে নেয় আমার সঙ্গে বাজারে গিয়ে। এবং বলতে দ্বিধা নেই, তার বিনিময়ে আমি তাদের ভালোবাসা পাই। আমার বুয়ার থাইরয়েড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর আমি তার পুরো চিকিৎসা করেছি, নিজে রক্ত সংগ্রহ করেছি, হাসপাতালে খাবার নিয়ে গেছি তিনবেলা। সে আমার ঠিকা বুয়াই ছিল। এখনও সে আমার বাসায় আসে, টুকটাক কাজে সাহায্য করে, সুস্থ আছে। এখনও তার ছয়মাস পরপর চেকাপের সব খরচ আমি দিই। আমার বাসায় আরেকটিমহিলা কাজ করতেন। তার বাচ্চা হবার পর ছয় মাস আমি তাকে কাজ ছাড়া প্রতি মাসে বেতন দিয়েছি। আমার বোনের বাসায় ঠিক একই চিত্র।

খুব লজ্জা ও সংকোচের সাথে ঘটনাগুলো উল্লেখ করলাম। কারণ কী? এবার যা বলবো তা অবিশ্বাস্য।
আমার প্রেগিনেন্সির সময় এই বুয়াদের চরম অমানবিক আচরণ আমাকে দেখতে হয়েছে। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হত। সেই সময় দিনের পর দিন দেখেছি তাদের অসম্ভব সব আচরণ।
একটি ১৬/১৭ বছরের মেয়ে এসেছিল কাজে। সেই মেয়েটির কাজ ছিল শুধু আমার সঙ্গে থাকা। আর কিছু নয়। বাসায় আমি একা থাকতাম বলে।সেই মেয়ে হঠাৎ জানালো সে কোনভাবেই আর থাকবে না, কারন বাড়ির জন্য প্রাণ কাদে। জানালামনিয়ে যাবার লোক আসতে ফোন দিচ্ছি। না, সেই ধৈর্য তার নেই। েসে এখুনি যাবে। যাবেই। হাত পা ছড়িয়ে চিৎকার করে কান্না। আমরা হতবাক। খাবে না, ঘুমাবে না। তার বাড়ির লোক ফোনে বুঝাচ্ছে। না, সেই বুঝও সে মানবে না। অবশেষে রাত বারোটায় তার বুড়ি দাদী এসে তাকে বকতে বকতে নিয়ে গেল। সেই বারোটা পর্যন্ত সে বাথরুমের সামনে বসে রইলো।আমি হতভম্ব।

আমার আত্মীয়ার বাচ্চাকে ব্লেড দিয়ে গলা কেটে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে ভাত খাওয়াতো এক গৃহকর্মী। আমার বোনের বাচ্চার সারা শরীরে চিমটি করে ঘা করে দিয়েছিল আরেক গৃহকর্মী। আমার কলিগের বাচ্চার যোনীর ভিতরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিত পনেরো বছরের এক মেয়ে গৃহকর্মী। আমার আরেক কলিগের দাদীকে খাওয়ানোর সময় পাখা দিয়ে মারতো এক চল্লিশ বছর বয়স্ক বুয়া। তার কাজই ছিল দাদীর দেখাশোনা। বেতন দশ হাজার টাকা।

এগুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করি? আমি দিদিকে জানি, চিনি। গৃহকর্মী নিয়ে তার লেখাটাকে এভাবে সমালোচনার আগে আমাদের বিষয়টা তলিয়ে দেখা দরকার দিদি আসলে কী বলতে চাইছে। হয়তো বলার ভঙ্গিটি জটিল হয়ে পেচিয়ে গেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় দিদি আয়েশা লতিফের পক্ষে সাফাই গাইছে। এ অসম্ভব।

সবশেষে বলি, পুরো সিস্টেমের মাঝে যে নোংরামি আর গলদ, তা সংশোধন না করে, পরস্পরকে কাদা ছুড়ে লাভ নেই। যারা আজ বড় বড় কথা বলছে, বাড়ি ফিরে তারা রেডি ভাত তরকারি, পরিস্কার জামা, বিছানা পান। কিন্তু এগুলো তাদের ‍মুখের সামনে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে দিতে বাড়ির মহিলাদের গৃহকর্মীদের নিয়ে যে তুমুল সংগ্রাম করতে হয়, তা তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।

আর যে মহিলারা পুরুষের পাতে রেডি খাবার দিতে বাড়ির গৃহকর্মীকে সাথে নিয়ে হেদিয়ে মরেন, গৃহকর্মীর উপর সকল রাগ ছাড়েন, তাদের বলি, এই বিকৃতি আপনাকে কোন কিছু দেবে না। যে অভাবী মেয়েটা আপনার কাছে এসছে, তাদের মধ্যে ভালো মন্দ সব আছে। ভালো লাগলে রাখবেন। নাহলে বিদায় দেবেন। খুন্তি পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দেবার মধ্যযুগীয় নোংরামি করবার কোন অধিকার আপনার নেই।

লেখক, সাংবাদিক, প্রামাণ্য চিত্রনির্মাতা

শেয়ার করুন: