তনয়া দেওয়ান:
পরিচিত মহলে সবাই আমাকে নারীবাদী বলেই জানে, তাই অনেকেই কোনো একটা ইস্যু পেলে তা নিয়ে বিতর্ক করতে সুযোগটা হাতছাড়া করে না, মাঝে মাঝে অনেকটা গায়ে পড়ে এসে নিজে নিজেই তর্ক করা শুরু করে, অনেকটা কাবাডি কাবাডি খেলার মতো !!!
কেউ কেউ আড্ডার ফাঁকে বলে, তুই তো নারীর পক্ষেই সাফাই গাইবি, কারণ তুই তো নারীবাদী।
আচ্ছা, নারীবাদী বলতে এই কতিপয় লোক কী বোঝে ?
নারীবাদী মানেই এরা যা বোঝে তা অনেকটা এরকম, শোক সমাবেশেও নারীর বিকিনি পরে যেতে চাওয়া, পুরুষদের বঞ্চিত করে নারীর তার অধিকার আদায় করতে চাওয়া, অবাধ স্বাধীনতার অপব্যবহার করা, যদি কোন নারী মহা অন্যায় করে ফেলে, তারপরও তার পক্ষে সাফাই গেয়ে অন্যায়কেও ন্যায় বলে চালিয়ে দেওয়া এবং পুরুষদের উপর অন্যায় অত্যাচার করার মন মানসিকতা পোষণ করা, কিংবা তারা মনে করে নারীবাদী হওয়া মানে নারীর পায়ের তলে পুরুষদেরকে পিষে মারতে চাওয়া এবং ব্লা ব্লা …..
অন্তত একদল মানুষের (এই দলের মধ্যে পুরুষ তো আছেই, নারীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়) কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তারা নারীবাদী বলতে এসবই বোঝেন, এসবই জানেন, এসবই মানেন। আপনারা যদি এটাকেই নারীবাদ মনে করেন তাহলে বলবো, নারীবাদ নিয়ে আপনাদের আরও অনেক কিছু জানার দরকার আছে।
সেই সব পুরুষ বা নারীদের জন্য উইকিপিডিয়ায় দেয়া নারীবাদের সংজ্ঞা তুলে ধরলাম
” নারীবাদ (ইংরেজি ভাষায়: Feminism) বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভূত একটি দর্শন, যা সভ্যতায় মানুষ হিসেবে পুরুষের তুলনায় সর্বার্থে নারীর সমতা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। নারীবাদ সমাজে নারীর সমতা অর্জন, বিশেষ করে পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের যৌক্তিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
নারীবাদ দাবি করে: নারী পুরুষের তুলনায় একদিকে সক্ষম, অন্যদিকে সামাজিক অবদানের দিক দিয়ে পুরুষ থেকে কম নয়।
নারীবাদী কর্মকাণ্ড-এর মূল লক্ষ্য সমাজে বিদ্যমান লৈঙ্গিক বৈষম্যের অবসান। নারীবাদী কর্মকাণ্ড সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রদত্ত বিভিন্ন মতবাদ ও আন্দোলনকে নির্দেশ করে। নির্বাচনী ভোটাধিকার, উত্তরাধিকারী সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বৈবাহিক জীবনে সমানাধিকার, রাজনীতি ও ব্যবসায় সমান সুযোগ, সমান কাজে সমান বেতন, মাতৃত্ব-অবসর ইত্যাদির নারীবাদী প্রবক্তাদের মৌলিক দাবি। ঐতিহাসিক ভাবে নারীরা বঞ্চনার শিকার, অতএব নারীবাদীরা নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
নারীবাদীরা নিজ দেহের উপর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করেন এবং ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ ও পারিবারিক নিগ্রহ থেকে নারী ও কন্যাশিশুদের রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট থাকেন। বিভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী নারীবাদী হতে পারেন যে কোন লিঙ্গের বা শুধুমাত্র কোনো নারী (এই ক্ষেত্রে নারীবাদী পুরুষরা হবেন উপনারীবাদী বা ‘প্রোফেমিনিস্ট’) যিনি নারীবাদে বিশ্বাস করেন।”
উইকিপিডিয়ার দেওয়া নারীবাদের এই সংজ্ঞা পড়ার পরও যাদের বুঝতে অসুবিধা হয়, তাদের জন্য সহজ ভাষায় বলছি,
নারীবাদ মানে হচ্ছে, হাজার বছর ধরে নারী লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে, পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে যে বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে, তার যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করা।
আপনার বিবেক বুদ্ধি দিয়ে বলেন তো উপরের কোন কথাটা অযৌক্তিক মনে হয়েছে ?
নাকি আপনি ” তাল গাছ আমার টাইপ লোক “, তাই কোনো যুক্তি-বুদ্ধি মানতে চান না!
আচ্ছা নারীবাদের কথা বাদই দেন, মানবাধিকার মানেন তো? সেটাতো মানবেনই, অন্তত নিজের স্বার্থের জন্য হলেও তো মানেন। তা আপনাকে প্রশ্ন করতেই হয়, স্বার্থের কথা ভাবার অধিকার কি শুধু আপনারই আছে? আপনি স্বার্থের চিন্তা করতে পারলে অন্যজন কেন পারবে না ?
মানুষকে নারী বা পুরুষ হিসেবে চিন্তা না করে আগে মানুষ হিসেবে চিন্তা করুন। আপনার যেমন ক্ষুধা লাগে তেমনি অন্যদেরও ক্ষুধা লাগে, আপনার যেমন চাহিদা আছে আরেকজনেরও আছে, আপনার যেমন সুখে দিনাতিপাত করার ইচ্ছা আছে আরেকজনেরও আছে। একটু নিজেকে দিয়ে অন্যকে বিচার করলেই তো অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
যে মানবাধিকারের কথা আপনি এখন ভাবছেন, এই মানবাধিকারটুকুই একজন নারী “মানুষ” হিসেবে চায়, নারীর এসব অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যে সংগ্রাম, সেটাই নারীবাদ এবং একদল মানুষ যারা নারীর অধিকার আদায়ের জন্য সদা সোচ্চার, তাদেরকেই নারীবাদী বলে।