কমল পর্বতের পথে পথে

ফাতিমা জাহান:

চীন দেশের গোয়াংজি রাজ্যের গুইলিন শহরে ট্রেন যখন থামলো তখন বাজে রাত তিনটা। হোটেল আগে থেকেই ইন্টারনেটে বুক করা ছিল তাই মাঝরাতে হোটেল খোঁজার ঝক্কি থেকে মুক্তি পেলাম। ট্রেনে সহযাত্রীদের জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলাম কী করে হোটেলে পৌঁছাবো!

তারা জানালেন, যেহেতু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাবার সম্ভাবনা কম সেসময় তাই ট্যাক্সি ধরে যাওয়াই ভালো। ট্রেন থেকে নেমেই দেখলাম একদল পুরুষ ট্রাভেল এজেন্টের সাথে একটি মেয়েও সেই মাঝরাতে তাদের ট্যুর প্যাকেজ কেনার জন্য ট্রেন থেকে নেমে পড়া যাত্রীদের অনুরোধ করছেন। আমি প্যাকেজ ট্যুরে কোথাও যাই না তাই,সবিনয়ে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলাম।

ট্যাক্সি ধরে চললাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। মাঝপথে ট্রাফিক সিগনালে ট্যাক্সি থামলো, যদিও আশপাশে আর কোন যানবাহন চোখে পড়লো না, তবুও নিয়ম মানার চেয়ে মধুর আর কিছুই নেই, সেটায় চীনের মানুষজন সতর্ক। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে দেখলাম এই সুনসান রাস্তায় একটি কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে ফুটপাথ ধরে চলতে চলতে নিজ মুঠোফোনে কাকে যেন টেক্সট করছেন। তাঁর হাঁটার গতি ছিল ধীর, আর চোখেমুখে ছিল না কোন উদ্বেগের ছাপ। কল্পনা করা যায় আমাদের দেশে কোনো মেয়ে যে কোনো শহরে এতো নির্বিঘ্নে ভর দুপুরবেলায় চলাফেরা করছে! কেন নির্বিঘ্নে আমরা চলাফেরা করতে পারছি না, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? 

সোলো ট্রাভেলিং বা একা কোথাও ভ্রমণ করতে যাওয়া আদৌ কি সম্ভব? এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন প্রায়শই হতে হয়। অনেকের কাছ থেকে শুনি পরিবারসহ কোথাও ভ্রমণ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয় বা ভালো লাগে না, ৫/৬ টি পরিবার একসাথে কোথাও গেলে তবেই নাকি ভ্রমণে আনন্দ আসে। অনেক পুরুষও বলে থাকেন, একা ভ্রমণ করার মতো সাহস নাকি তাদের নেই। কেন নেই প্রশ্ন করলে তার সঠিক জবাব তারা কখনোই দিতে পারেন না।

আমাদের দেশে ভ্রমণ মানে ৩/৪ দিন যে কোন রিসোর্টে গিয়ে কাটিয়ে আসা। অথবা ট্রাভেল এজেন্টের ঠিক করে দেওয়া সময় ও প্ল্যান অনুযায়ী সপ্তাহখানেকের জন্য বেড়াতে যাওয়া।আমি কোন শহর বা গ্রামে গেলে নিদেনপক্ষে এক সপ্তাহ কাটিয়ে আসি। এর চেয়ে কম সময়ে সে স্থানের বর্ণ, গন্ধ, সংস্কৃতি বোঝা যায়না। অবশ্য যাদের হাতে একেবারেই সময় থাকে না তাদের কথা আলাদা।

একা মেয়ে ভ্রমণ করে এমন কথা আমাদের দেশে বিরল অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশগু লোর মেয়েরাই দূর-দূরান্তে চলে যাচ্ছে ভ্রমণ করতে। এখানে ভ্রমণ বলতে বোঝাতে চাইছি শুধুই ভ্রমণ, কোন কাজ বা পড়ালেখার উদ্দেশ্যে কোথাও একা যাওয়া নয়। নিজেই নিজের ভ্রমণ প্ল্যান করা, বাস/ ট্রেন/ প্লেনের টিকেট কাটা, হোটেল বুক করা এবং যেখানে যাচ্ছি সেখানেও একা ঘোরাফেরা করা। এই কাজগুলো আমাদের দেশের মেয়েদের পক্ষে আদৌ কী সম্ভব?

আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলবো, কেন নয়! আমাদের দেশের মেয়েরা বাস, প্লেন, রিক্সা চালাচ্ছে, সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও নারীরা সমান দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে নারীর সরব পদচারণায় মুখরিত হয়নি, তবে একা ভ্রমণে এতো অনীহা কেন থাকবে! সমাজব্যবস্থার কারণে?

আসলে আমরাই তো সমাজ ব্যবস্থা, আমরাই নিয়মনীতি তৈরী করি সমাজের দোহাই দিয়ে, আর এটাও বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আমাদের সমাজ নারীবান্ধব নয়। আপনি বলতে পারেন পথেঘাটে তো নারীর নিরাপত্তা নেই। পথেঘাটে নারীর উপর হামলে পড়ে, নির্যাতন করে কিন্তু পুরুষ। তবে কী এটাই ধরে নিতে বাধ্য হব যে নারীর সমতায় পুরুষ বিশ্বাসী নয়। এটাও প্রমাণিত হয় যে নারীর সাধারণ চলাফেরায় তবে পুরুষই বাধার সৃষ্টি করছে। ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলে কি যে কোন পুরুষ নারীর চলার পথে ব্যাঘাত হানতো?

অনেকেই বলেন বিদেশ ভ্রমণ শংকাহীন, কিন্তু যারা ভাবেন বিদেশ ভ্রমণে অনেক খরচ, তাদের বলছি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম খরচে বিদেশের অনেক দেশেই ভ্রমণ করা যায়। আর আমাদের বাংলাদেশে সোলো ট্রাভেলিং আমাদের শুরু করতে হবে। আগে তো মেয়েরা স্কুল কলেজেও পড়তে যেত না। কেউ শুরু করেছেন মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা আর সেকারণেই আজ আমরা শিক্ষিত হতে পেরেছি। ঘর থেকে বের হতে পেরেছি আমরা শিক্ষার জন্য, তাহলে ভ্রমণের মতো মৌলিক মনোরঞ্জনকেই বা উপেক্ষা করবো কী করে!

বাংলাদেশের যে ক’টা জায়গায় আমি সোলো ট্রাভেলিং করেছি সেখানে হয়তো বা একটু বুঝেশুনে চলতে হয়। কিছু মানুষ অভ্যস্ত নয় এটা দেখে যে, মেয়েরা ঘরের বাইরে যাচ্ছে। সেজন্য তাদের বৈরী মনোভাব তৈরী হয়। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে একা ভ্রমণ শুরু করলে সামাজিক দৃষ্টিকোণও বদলে যেতে বাধ্য। তবে আমার তেমন কোন অসুবিধাই হয়নি। একা ট্রাভেল করেছি নিজের মতো, কারো সাথে বা কারো সাহায্য নিয়ে নয়। মেয়েরা এগিয়ে আসলে যে কারোরই একা ভ্রমণ করা সম্ভব।

গুইলিন শহরে দুদিন থাকার ইচ্ছে ছিল। চীন দেশের সব শহরই আমাদের দেশ বা ভারতের চেয়েও বড় আর উন্নত মানের। নাগরিক সকল সু্যোগ-সুবিধাই উপলব্ধ। এমনকি গ্রামগুলো দেখলেও তাক লেগে যায়। আমি গুইলিন শহরে এসেছি চাংশা শহর থেকে। চাংশা শহর বিখ্যাত কারণ নেতা মাও সে তুং এর জন্মস্থান এবং তাঁর রাজনীতি চর্চার স্থান সেটি।

আর গুইলিন বিখ্যাত এর অপরূপ সারিবদ্ধ পাহাড় পর্বতের জন্য।

যেহেতু মাঝরাতে পৌঁছেছি সে কারণে আমার এপার্টমেন্টের হোস্টকে ফোন কল করে ডেকে ওঠাতেই হলো। এদেশে এপার্টমেন্টের একটা রুম বাথরুমসহ অনেকেই ভাড়া দেন। আমিও সস্তা পেয়ে আর চীনা পরিবারের সাথে থাকতে পারবো ভেবে এপার্টমেন্ট এর রুম ভাড়া করলাম।

আমার এপার্টমেন্টের হোস্ট নিচে নেমে এলেন আমাকে ওপরে নিয়ে যেতে। যে পদ্ধতিতে ওপরে গেলাম সেটায় আধো ঘুমে কিছুই মনে থাকবে না বলে লিখে নিলাম। নিচের প্রধান ফটকে নম্বর লক, নম্বর লিখলাম। তারপর ২৪ তলা এপার্টমেন্ট এর মূল ফটকের নম্বর কম্বিনেশন এবং শেষে আমার নিজের রুমের দরজার নম্বর। আমার এপার্টমেন্ট এর হোস্ট এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না। তিনি ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্ট এর নিচের অংশে থাকেন, আমাকে দিলেন উপরের অংশে থাকতে।

সব কথাই হচ্ছিল ইশারা ইংগিতে। আমি যে দু’চার শব্দ ম্যান্ডারিন জানি তা প্রয়োগ করি চীন ভ্রমণের সব জায়গায়। অসুবিধে তেমন হয় না। এদেশের মানুষ ভীষণ সৎ আর বন্ধুবৎসল। আর এদেশ এতোই নিরাপদ যে ধর্ষণ শব্দটি শুনেছে অনেকেই, কিন্তু প্রয়োগ হয় এমন কোথাও শোনা যায়নি। মেয়েরাও কাজে, ঘরে বাইরে সমান সুবিধা ভোগ করেন। পোশাকের জন্য কেউ বেশ্যা আর কেউ সৎ চরিত্র হয়ে যাবে এমনভাবেও কেউ ভাবতে শেখেননি।

গুইলিন শহর আর এর আশপাশের গ্রাম বিখ্যাত পাহাড় আর অসাধারণ প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের জন্য। সুশৃঙ্খল প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত সারিবদ্ধ পাহাড়ের এতো সৌন্দর্য্য আগে কোন দেশে দেখিনি। পৃথিবীজুড়ে গুইলিন বিখ্যাত এর অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপের জন্য।

পরদিন শহর ভ্রমণে বের হলাম। ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম রিড ফ্লুট কেইভ (Reed Flute Cave)। গুহার বৈশিষ্ট্য হলো, গুহাগুলো লক্ষ বছরের পাললিক শিলা জমে নির্মিত হয়েছে। প্রবাল, জীবাশ্ম, চুনাপাথর ইত্যাদি জমে জমে গুহায় অসাধারণ ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। কোনটা উপর থেকে নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে, কোনটা বা নিচ থেকে উপরে। নানান আকৃতির। কোনটা পদ্মফুল, তো কোনটা মেঘমঞ্জরী। কোনটা হাতি বা কোনটা উটের মতো।

কিছু গুহার ভেতরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, চীন সরকার সেখানে পর্যটকদের সুবিধের জন্য গুহার ভেতরে হালকা আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেখানেও প্রকৃতির উদারতায় ভাস্কর্য ফুটে উঠেছে। প্রতি ঘন্টায় লাইট শো হয়, যা অত্যন্ত মনোরম। গুহায় প্রবেশমূল্য ১২০ ইউয়ান। গুহা ভ্রমণ শেষ করে গেলাম এখানকার স্থানীয় খাবার খেতে সাধারণ মানের রেস্টুরেন্টে। স্টার রেটেড রেস্টুরেন্টে একেবারে সাধারণ মানুষের রন্ধন প্রণালীর স্বাদ মেলে না, তাই যে কোনো শহর বা গ্রামে আমি সেখানকার স্থানীয়ভাবে তৈরি খাবার খুঁজে বেড়াই। বুফে সিস্টেমের খাবার তাই ভিন্ন আইটেমের স্বাদও নেয়া যায়। আমার হিসেবে অসাধারণ খাবার, কারণ বেশিরভাগ খাবারই সেদ্ধ বা স্যুপ জাতীয়।

এরপর চলে গেলাম এলিফেন্ট ট্রাঙ্ক হিল (Elephant Trunk Hill)। প্রবেশমূল্য ৭৫ ইউয়ান। তাওহুয়া এবং লিজিয়াং নদীর মোহনায় অবস্থিত এ পাহাড়টি দেখলে মনে হবে যেন একটি হাতি নিচু হয়ে নদীর জল পান করছে। এলিফেন্ট ট্রাঙ্ক হিল গুইলিনের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিত।

সূর্যাস্তের সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম শহরের পথে পথে। গুইলিন শহর এক বিশাল পর্যটন কেন্দ্র। সব কিছুই আধুনিক, সুউচ্চ দালান আর রাস্তায় সুশৃঙ্খল গাড়িবহর সভ্যতা আর উন্নয়নের ইশারা করে যায়। রাতের খাবার খেতে ফিরলাম এপার্টমেন্টে। এপার্টমেন্টের হোস্টকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম যে আমি স্যুপ জাতীয় খাবার খেতে পছন্দ করি। হোস্ট, তার স্ত্রী আর তাদের সাত বছর বয়সী কন্যার সাথে ভালোই সময় কাটলো।

গুইলিন অবস্থানের দ্বিতীয় দিনে চলে গেলাম লংশেং রাইস টেরেস দেখতে, যা গুলিন থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। বাসে করে গেলে সময় লাগে আড়াই ঘন্টার মত। কেউ চাইলে ট্যাক্সি ভাড়া করেও যেতে পারেন। পাহাড়ের গা কেটে কেটে ধানক্ষেত শুধু ছবিতেই দেখেছিলাম। আজ নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে স্বপ্ন এতোদিনে সত্যি হলো। সারাদিন লংশেং গ্রামে কাটালাম। মানুষজনদের সাথে কথা খুব কম হলো, কারণ আমি ম্যান্ডারিন বুঝি না। তবে তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। আমি বাইরে থেকে এসেছি তাই তারা ফল, কেক, খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করলো। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এলাম গুইলিনে।

তৃতীয় দিনে রওনা দিলাম আরেকটি মনোরম স্থান ইয়াংশৌ এর উদ্দেশ্যে। লি নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত ইয়াংশৌ শহর আর তার আশপাশের গ্রাম।

(চলবে)

[email protected]

শেয়ার করুন: