চলমান অশরীরী

শবনম সুরিতা ডানা:

ভালোবাসতে ভয় মানুষ আগেও পেত, এখনও পায়। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কাউকে ভালোবাসার মধ্যে মানুষ যে শুধু আরেকজনকে আপন করে নেয় তাই নয়, নিজেরও অংশবিশেষ রেখে যায় তাদের মধ্যে। একটা সময়ের পর তাই নিজেকেই নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। আকাশে দুইহাতে প্রেম বিলাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। আর যে উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে কাঙাল হলাম, সেই বন মোটেও করতে জানেনা মোতি আর কানাকড়ির মাঝের ফারাকটুকু। মোতিগুলি পড়ে থাকে একা, নিঃসঙ্গ। আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলে জৌলুস।

এভাবেই ভালোবেসে এগিয়ে দেওয়া মুক্তো পরিণত হয় অকেজো, মলিন পাথরের টুকরোয়। আমিও এতদিনে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। ভালোবাসার চেষ্টা করতে করতে আমার কাছে দেবার মতন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই বললেই চলে।

এইসব হারিয়ে, একলা পড়ে থাকার মত করে ভালোবাসার পাঠ আমায় শিখিয়েছেন বাবা। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে ঠিক কবে কীভাবে শিখিয়েছেন সেটা বলতে পারব না। মনে নেই। বাবা যে কিছু শেখাবে আমায় সেটা ছোটবেলায় ভাবাটাই এক রকমের অবিশ্বাস্য বিষয় ছিল। বাবার সাথে দেখা হতো রোববারের সকালে গান শেখার সময়, আর সপ্তাহের বাকি দিনগুলি বাবাকে পেতাম মায়ের অভিযোগ-অনুযোগে, বিকেল ৬টায় দূরদর্শনের গানের অনুষ্ঠানে বা ভাগ্য ভালো থাকলে রাতে ঘুমাতে যাবার কয়েক ঘণ্টা আগে।

বাবাকে সব সময়েই পেয়েছি ছায়ারমতো। না ছায়া নয়, ভুল বললাম। অরণ্যদেব। চলমান অশরীরী। আছেও। আবার নেই। বাবা ঠিক তেমনই। জয়দীপকাকু একবার বলেছিলেন, বাবা নাকী আসলেই একটা আস্ত সেলুলয়েড চরিত্র। খুব একটা মিথ্যে বলেন নি। ছোটবেলা থেকেই আমার হিরো বলতে বাবাই। তুলনায় মায়ের সুপারপাওয়ারগুলো যেন অনেক বেশি সাদামাটা, বিশ্বাস করতে কোন অসুবিধে হয়না। চিরকালই দেখে আসছি মা একা হাতে বাড়ি-সংসার-অফিস সামলেছে, এবং সময় সুযোগ করে নাটক-গান-নাচের অনুষ্ঠানও দেখতে যাচ্ছে। দূরদর্শনের ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, পাম্মুর চোখ অপারেশান থেকে আমার পরীক্ষার পড়া- মায়ের নজর এড়িয়ে যায়নি কিছুই। দশভূজা মা তাই আমার হিরো হয়নি কখনোই। মায়ের তো এটাই কাজ। মা তো এসব অনায়াসেই করে ফেলে। আলাদা করে কিছু নেই। আমার হিরো সেই লোকটা, যে সবুজ স্কুটার ছুটিয়ে বেড়ায় গোটা শিলচরের আনাচে কানাচে। আমার হিরো কখনও ক্লান্ত হয়না, ক্লান্তি বিষয়ক কোনো অনুযোগ করতেও তাকে কেউ দেখেনি কখনও। না চাইতেই উজাড় করে দিয়েছে যা কিছু সম্বল, আমার হিরো ওই মানুষটাই। এখন বড় হয়ে বুঝি, মা ওরকম দশভূজা রূপ ধারণ না করলে বাবার হিরো হয়ে ওঠাটাই হত না। সব হিরোগিরি প্রতি রবিবার বাজারের থলে হাতেই সীমিত থেকে যেত। আর সমাজ বদলের স্বপ্নও রয়ে যেত কাছাড় কলেজের অঙ্কের ক্লাসগুলোতেই। বা খুব বড়জোর ভোটের আগে রাস্তায় গলা ফাটিয়ে ওরা ভয় পেয়েছে, রোবসন!। অরণ্যদেবের স্বপ্নগুলি তার আশেপাশের জগতে কেই বা কবে বুঝেছে পুরোপুরি? এই সেলুলয়েড চরিত্রের ক্ষেত্রেও তাই।

মনে আছে যখন আমার বয়েস তিন কি চার হবে, তখন কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে গর্বের সাথে উত্তর দিতাম,শুভর মেয়ে! সারা শহরসহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের রীতিমত ডাকসাইটে গায়ক, সাংস্কৃতিক সংগঠক আমার বাবা। ছোট্ট মেয়ে একটু গর্ব তো করবেই।

শুনেছি একবার মা-বাবা কোন এক অনুষ্ঠানে গাইতে গিয়েছিল। আমি পাম্মু আর পিসির সাথে শ্রোতাদের মাঝে। গান শেষ হবার আগেই চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে সগৌরবে গোটা প্রেক্ষাগৃহকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি কে। চিৎকার করে আদেশ আমার, হাততালি! হাততালি! আমার মা! আমার বাবা! আমার গৌরবের ঠেলায় মা-বাবা যারপরনাই লজ্জিত। আমি এসব পাত্তাই দিতাম না তখন।

আমি অপেক্ষায় ছিলাম কবে আমিও বাবার মতো ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, শিলচর শাখার সম্পাদক হবো। রাস্তার কোণ থেকে প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চ মাতাব গানে-কথায়। খুব নকল করতাম বাবার গায়নভঙ্গী ছোটবেলা। এখনও যে করিনা তা বললে মিথ্যেই বলা হবে। একবার মনে আছে মায়ের শোবার ঘরে খাটের ওপর আমি মিছিমিছি জলসার আয়োজন করেছি। সামনের বেতের চেয়ারে পাম্মু, পিসি সবাই। পাশেই রান্নাঘরে মা। আমি একটা ডায়রিকে হারমোনিয়াম বানিয়ে গেয়ে চলেছি একের পর এক গান। হঠাৎ মনে হল বাবা তো গানের মাঝখানে কীসব কথাও বলে বেশ গুছিয়ে, সুতরাং আমাকেও বলতে হবে! ডায়রির খাপ ডানহাত দিয়ে কায়দা করে ধরেছি। আমার কল্পনায় সেটাই হারমোনিয়াম। খানিক ভেবে গম্ভীর গলায় বললাম, আমি এখন যে গানটি গাইতে চলেছি, সেটি আমার মুখস্থ! বলতেই পাম্মু-পিসি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি। আর আমি কিছুটা অবাক, কিছুটা করুণ মুখ বানিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বুঝতে পারলাম নকলে কোথাও একটা গলদ রয়ে গিয়েছে।

এখনও মাঝেমাঝে যখন কোন পাকামো করতে গিয়ে হাবা বনে যাই, বুঝি যে আসলেই আমার নকলে গলদ রয়ে গিয়েছে। পুরোটা ধরে ফেলতে পারিনি আমি কখনোই। কত গানই তো গাই। একান্তে, বা দুনিয়ার সামনে গলা ফাটিয়েও। আমার হিরো, সেই চলমান অশরীরীকে সেখানেও পুরোটা ধরতে পারিনা। কিন্ত জানি এভাবেই একটু একটু করে নকল করতে গিয়ে হোঁচট খেতে খেতেই একদিন পেরে যাব। বাবাকে যখনই গাইতে দেখতাম আগে, গভীরভাবে ভাবতে চেষ্টা করতাম যে লোকটা কী এত ভাবে, কেন ওই গানটা গায়, কেন ওভাবে গায়। এখন অল্প অল্প আঁচ করতে পারি। বাবা আমার কাছে গায়ক নয় কোন দিক দিয়ে। গায়কদের গলা থাকে। সেই গলা দিয়ে যেমন চায় তেমনই সুর বেরোয়। বাবার গান গলা দিয়ে বেরোয় না। বাবা কথা বলে। গানের সাথে। গানও প্রত্যুত্তর দেয় তেমনি। আমরা শুধু কথোপকথনটুকু দেখতে পাই, শুনতে পাই। এই কথা বলাটা আজকাল আমি নকল করি। করতে চেষ্টা করি। কতটুকু পারি জানিনা।

গোয়েন্দা গল্প খুব বেশি পড়ে ফেললে একটা সময়ের পর মানুষ নিজেকেই গোয়েন্দা বলে ভাবতে শুরু করে। চারপাশের সবকিছুতে রহস্য-রোমাঞ্চ খুঁজে বেড়ায়। আমিও আজকাল নিজেকে অরণ্যদেবের ছায়া ভাবতে লেগেছি। তাতে আখেরে যদিও বা অরণ্যদেবের কিছুই যায় আসেনা। সে আছে তাঁর নিজের খেয়ালে। সে জানেও না চব্বিশটা বছর ধরে একজন তাকে সযত্নে নকল করে চলেছে। নকল, অনুসরণ, সব।

চলমান অশরীরী জানেনা আমি তাঁর প্রতিটা সাদামাটা স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করতে চাই। চলমান অশরীরী হয়ত ছায়া হয়েই থাকতে চায় চিরটা কাল। আর আমি তাঁর অজান্তে হয়ে উঠতে চাই রক্তমাংসের বাস্তব। যেখানে কেউ এড়িয়ে যাবেনা কথোপকথন। আমি স্বপ্ন দেখি অরণ্যদেবের ছায়া হয়ে ওঠার নয়। ভাসমান স্বপ্নকে জলজ্যান্ত শরীর দিতে চাই। সব হারিয়ে ভালোবাসতে শেখালো যে, তাকে এত সহজে অশরীরী হতে দিতে চাইনা। মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে নিতে চাই তাকে প্রতিনিয়ত। যাতে আর কখনও আমার দিকে চেয়ে কেউ প্রশ্ন না করে আমি কে। ঠোঁট নাড়ার আগেই যাতে উত্তর ছুটে আসে।

শুভর মেয়ে।

(নবযুগ ব্লগেও প্রকাশিত হয়েছে লেখাটি, লেখকের অনুমতি নিয়েই উইমেন চ্যাপ্টারের পাঠকদের জন্য ছাপানো হলো)

শেয়ার করুন: