রীমা দাস:
ঐ নীলিমায় ছোঁয়া দূরের আকাশ
নয়তো উঁচু এতো আমার বাবার মত—–

তখনকার সময়ের সব মা-বাবাই চাইতেন মেয়ের পর ছেলে হবে। আমার জন্ম নভেম্বরের সন্ধ্যায়। শীতের সন্ধ্যা। সিলেট সদর হাসপাতালে আমি মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণের জন্য এলাম। আমার মায়ের নির্লিপ্ত মুখ দেখে আমি কি ভয় পেয়েছিলাম খুব? হয়তো আমার মা এর নির্লিপ্ততার কারণে বা তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমি অনেকক্ষণ রক্তমাখা অবস্থায় রইলাম। আমার বাবা ত্রাতা হিসেবে এলেন। একজন মহিলা এনে আমাকে পরিষ্কার করালেন বাবা। আমি কি প্রথম বাবার কোলেই উঠেছিলাম? মনে পড়ে না আমার। তবে এটুকু টের পাই বাবার সাথে আমার বন্ধন অনেক জোরালো।
মা’র অভিমান কিন্তু তখনও কাটেনি। মা, তুমি কি খুব কষ্ট পেয়েছিলে সেদিন? দোষটা কি আমার ছিল মেয়ে হয়েছিলাম বলে? এসবই মায়ের মুখ থেকে শোনা। মা’য়ের কোলে বসেই জেনেছিলাম বাবার সাথে আমার বন্ধুত্বের, বন্ধনের কারণ।
আমি বাবার ছায়ায় বেড়ে উঠি। ছোট থেকেই বাবার সাথে আমার রাজ্যের কথা। বাবাকে শাসন করি আমি। আমার যে বাবাকে সবাই ভয় পায় সে বাবাকে আমি মোটেও ভয় পাই না। আমার মনে পড়ে কতদিন বাবাকে ঠাম্মির মতো করে ডেকে বলেছি– খোকন, মশারী গুঁজো, ভাত খাও …ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আমার ঠাম্মিকে দেখিনি। তবে বাবা বলতেন, আমি তার মা, তার মায়ের মতোই নাকি আমার চেহারা কথা বলা, সব। এর মধ্যে আমার আদরে ভাগ বসাতে এলো ভাই ও বোন। আমার ছোট ভাই বোন জমজ। ভাই এর জন্মে পরিবারে সাজ সাজ রব এলো। সবাই খুব খুশি। আমি হয়তো সে খুশিতে আত্মহারা হইনি। আমি আরও বেশি করে বাবার সাথে মিশে থাকলাম। বাবাও আমাকে তাঁর আশ্রয়ে রাখলেন, প্রশ্রয় দিলেন। বাবার আদর পেতে পেতে আমি বেশ আদুরে হয়ে গেলাম। কেউ বিশ্বাসই করতো না আমি বাবা মা’এর তৃতীয় সন্তান।
বাবা আমাকে কখনও মারেননি। মায়ের বকুনি, পিটুনি ছিলো আমার কাছে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বাবা অফিস থেকে বাসায় ফিরলেই আমি আমার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসতাম। মা’য়ের নামে নালিশ দিতাম। আর বাবা সেগুলো শুনে মিটি মিটি হাসতেন। বাবা স্বভাবে খুব গম্ভীর, কিন্তু আমার সাথে দুষ্টুমিও করতেন। আমি বেড়াতে পছন্দ করতাম বলে বাবা আমাকে মাকড়সা বলতেন। আমি আরও বেশি করে বাবার ন্যাওটা হয়ে উঠলাম।
আমার কিছু অদ্ভুত পছন্দকে বাবা প্রশ্রয় দিতেন। আমি আর বাবা মিলে রাত বারোটায় বিটিভিতে ইংরেজি উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতাম, বাংলা উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতাম। কবিতা পছন্দ করতাম ভীষণ,সেটাও বাবার জন্য। বাবা ভরাট কন্ঠে শুনাতেন — আবার আসিব ফিরে বাংলার … হয়তো হাঁস হবো, কিশোরীর ঘুঙ্গুর রহিবে লাল পা’য়…।
আমার মনে হতো ঐ কিশোরী আমি, যার লাল পা’য়ে ঘুঙ্গুর বাঁধা। বাবা আমাকে কবিতার রাজ্য দিলেন, যেখানে আমি একাই রাজকন্যা, শুধুমাত্র আমার বাবা। আমি একা একা কবিতা পড়লে আমার মা মাঝে মাঝে রাগ করতেন। আমি তখন তাঁকে বলতাম—- যে কবিতা শুনতে জানে না সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে। আমি তাই বিশ্বাস করতাম এবং করি।
আমার বাবা আমাকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন। আমি খুব একরোখা, জেদী টাইপের ছিলাম। কেউ আমাকে দিয়ে কিছু করাতে পারতো না। কিন্তু বাবা ঠিকই জানতেন তার এই পাগল মেয়েকে বকে কিছু করানো যাবে না। পাগল এই মেয়ের সংকটে, অস্থিরতায়, বিপদে তার বাবা শুধু তাকে বুঝিয়েছে। আর এই বুঝানোতেই অনেক কাজ হয়েছে।
ইন্টার পাস করার পর পরই সরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়ে গেলো। সবাই আমাকে বলছে যোগদানের জন্য। একমাত্র বাবা বিপক্ষে। আমি বাবার উপর ভীষণ রাগ করলাম। বাবা আমাকে দেখলেন দুই দিন। তারপর কাছে বসালেন। খুব আদর করে বললেন আমি চাই-………………।
বাবার কথা শুনে আমার চোখ ভরে জল এলো। আমি যা স্বপ্ন দেখেছি আমাকে নিয়ে আমার বাবা সেগুলো বলে দিলেন। অথচ আমি এই কথাগুলো কাউকে বলিনি, কারো সাথে শেয়ার করিনি। এমনকি বাবাকেও না। আমার মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো। এই না হলে আমার বাবা! আমি সেই চাকুরীতে যোগ দেইনি। পড়ালেখা কন্টিনিউ করেছি। আজকের যে আমি, যতটুকু আমি, তার ৯০% আমার বাবার কারণে।
আমি প্রায়ই লজ্জায় নুয়ে থাকতাম। আমার বাবা কত বড় খেলোয়াড়, কিন্তু তার মেয়ে হয়ে আমি স্কুল এবং কলেজের বার্ষিক খেলায় কখনও পুরস্কার আনতে পারিনি। এজন্য আমি অনেক কথা শুনেছি। তবে আমার বাবা আমাকে কখনও কিচ্ছু বলেননি। বাবা আকাশের মতো উদার। ছোট ছোট বিষয়ে তাকে কখনও মাথা ঘামাতে দেখিনি। আমার সীমাবদ্ধতা তিনি বুঝতেন। সেই ছোট থেকেই আমি বাবার পি.এস। এখনও আছি। আমাকে ছাড়া বাবা ডাক্তারের কাছে যান না। কোথাও বেড়াতে গেলে আমি পোশাক ঠিক করে দেই, গুছিয়ে দেই (এখনও)। আমাকে ছাড়া বাবার চলে না। সেজন্য আমি খুব গর্বিত।
আমরা যখন বড় হচ্ছি তখন ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বলা নিষিদ্ধ ছিলো। আমরা মনে করতাম বাবাকে আবার ভালোবাসি বলা যায় নাকি? বাবাকে কখনও প্রকাশ্যে বলা হয়নি — ভালোবাসি বাবা তোমাকে, অনেক ভালোবাসি। ফেবুর এই জগতে বাবাকে নিয়ে লিখতে পারায় খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বাবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি ইথারবার্তা। আমার বাবা আমার একান্ত সূর্যালোক। যেখান থেকে আমি শক্তি নেই বেঁচে থাকার। আমার বাবা বটগাছ, যার ছায়ায় ক্লান্ত আমি বিশ্রাম নেই। ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহ যখন আর চলে না তখন বাবার পায়ের কাছে/ মাথার কাছে বসি। বাবা হয়তো তখন সব কষ্ট দুঃখ শুষে নেন। আর আমি আবার পথ চলি।
তুমি আমার সূর্যালোক
আমার একান্ত সূর্যালোক
আকাশ ধূসর হলেও
তুমি আমায় সুখী কর।
তুমি জানো না হে পিতা
কত ভালোবাসি তোমাকে।
আমা হতে নিও না সরিয়ে
এই আলো কোনদিন।।
বাবার সূর্যালোকে পথ চলতে চাই। ভালোবাসি বাবা তোমাকে অনেক অনেক অনেক।
পৃথিবীর সকল বাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।।