পারিবারিক সহিংসতা ও আমরা

সালমা লুনা:

(1) যাত্রা ও গন্তব্য:

একজন নারী নির্যাতক পুরুষকে সাহায্য করতে, অভয় দিতে এবং বাঁচিয়ে দিতে সবসময়ই পাশে থাকে প্রথমতঃ আরেকজন পুরুষ । সে হতে পারে ভাই, কোন বন্ধু, যেকোন আত্মীয় কিংবা অনাত্মীয় পুরুষ।

এরপর এগিয়ে আসে তার পরিবারের সকল সদস্য । এমনকী মা বোন ও যেকোন নারী আত্মীয়ারাও ।

ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কায়দায় তারা নির্যাতক পুরুষটির পক্ষ নেয়। নারী বলে তারা আরেকটি নারীর সকল গোপনীয়তা , দুর্বলতা এবং আঘাতের মোক্ষম জায়গাটি ভালোমতোই জানে। ফলে সহজ হয় নারীকে উপূর্যুপরি আঘাত করে নাস্তানাবুদ করে কোনঠাসা করে পুরুষটিকে তার পাপ ও তার সব অন্যায় অপরাধ থেকে মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা থেকে বের করে আনতে ।
আর সেই নারীটি যদি হয় ওই নির্যাতক পুরুষটির স্ত্রী , তবে তো কথাই নেই! চুটকি বাজাতে সময় লাগবে কিন্তু ওই স্ত্রী নামক নারী বা মানুষটির একশো একটি দোষ বের করতে সময় লাগবে না কারো ।
তার পাশে কেউ দাঁড়াবে তো নাইই , বরং কেউ দাঁড়ালে তারও দফা রফা করে ছাড়ে।

তাহলে কী দাঁড়ায়?
শুরু থেকে যদি দেখি তাহলে দেখবো একজন নির্যাতকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আসলে প্রথমেই তার পরিবার। তারপর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। রাষ্ট্রের ভুলভাল এবং পুরুষবান্ধব আইন কানুন তো আছেই !

একটি মানবশিশু কখনোই নির্যাতক হয়ে জন্মায় না।
একটি নির্যাতক পুরুষের জন্ম ও উত্থানে পরিবারের ভূমিকাই আসল। পরিবার চাইলে কখনোই একজন নির্যাতক পুরুষ তৈরি হতো না। পরিবার তথা বাবা-মা বা অভিভাবকদের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞানতা হেতু তাদেরই সুশিক্ষার অভাবে পরিবারের ছেলে শিশুটির নির্যাতক পুরুষ রূপে অভিষেক হয়। এটি হতে পারে বাবাকে দেখে। হতে পারে কোন আত্মীয়কে দেখে। হয়তো ছোটবেলা থেকেই ছেলেশিশুটি দেখে বড় হয় তার বাবা তার মাকে মানসিক বা শারীরিকভাবে অত্যাচার করছে। তার প্রতিটি কাজের ভুল ধরছে। তাকে বাধ্য করছে বিনা বাক্যব্যয়ে তার প্রতিটি কথা মেনে নিতে এবং না মেনে নিলেই শুরু হচ্ছে রাগারাগি, অকথ্য গালিগালাজ, ঘরে জিনিসপত্র ভাঙচুর এবং প্রয়োজনে গায়ে হাত তোলা। ওই একটু আধটু চড় চাপড় কী একখানা লাঠির বাড়ি !

এই শিশুটি বড় হয় কী মেসেজ নিয়ে?
শিশুটি যখন দেখে তার বাবা শুধু রোজগার করে আনে বলেই সারাদিন সংসারের কাজ করা তাদের মা কে যে কীনা তাদের সংসারের কর্ত্রী তাদের সবার দেখভাল করনেওয়ালী এবং অনেকখানি ক্ষমতার অধিকারিনী- তাকেও এইরূপ হেনস্থা করতে পারে তাহলে এটি সর্বতোভাবেই জায়েজ ।

আশ্চর্য হলেও সত্য এই মমতাময়ী মা ও তার আদরের ধন মানিক রতনটিকে নিজের অজান্তেই একটি রাক্ষসে পরিণত হওয়ার সব বীজমন্ত্র দিতে থাকেন ।
তার বেড়ে উঠার সকল ব্যবস্থায় জপমালার মতো বলা হতে থাকে, তুমি ছেলেমানুষ। তোমার জন্য এই, তোমার জন্য সেই, তোমার এটা করা উচিত, ওটা অনুচিত। ছেলেরা একটু আধটু এটা করবেই। তারা কেন ঘরের কাজ করবে, মেয়েদের কাজ করবে? ছেলেদের একটু রাগ বেশিই থাকে, এতে আর দোষ কী! ছেলেরা হীরার আংটি, বাঁকা হলেও ক্ষতি নেই। ছেলেরা মাছের মাথাটা খাবে, রানটা- সিনার টুকরাটা, দুধটা- প্রতিদিন ডিমটা ….ব্লা ব্লা ব্লা ।

ফলে সে নিজেকে বড় এবং আলাদা – এই মানসিকতা নিয়েই বেড়ে উঠতে থাকে।

এরপরের কাহিনী তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না । তার এই মানসিকতার আগুনে হাওয়া দিতে এগিয়ে আসে একে একে পারিপার্শ্বিকতা, ধর্ম, সমাজ এবং রাষ্ট্র ।

পরিণত বয়সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে হয়ে উঠে একজন শুধুই ‘পুরুষ’। এরপর সে যখন সংসার জীবনে প্রবেশ করে এবং হাতের কাছে পেয়ে যায় একটি স্ত্রী নামক বস্তু তখন তার সেই ‘পুরুষ’ রূপটি ধারালো হয়ে উঠতে উঠতে একজন খাঁটি নির্যাতকে পরিণত হয়।

বিশেষ করে স্ত্রী টি যদি শিক্ষিতা হন,অধিকার সচেতন হন তাহলে তো কথাই নেই! না হলেও অসুবিধা নেই, তার কিচ্ছুটি আটকায় না সেই স্ত্রী তথা বিবাহ নামক বন্ধনের দ্বারা অধিকৃত রক্তমাংশের পোটলাটিকে তার একান্ত অনুগত দাস বানাতে। এর বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটলে বেরিয়ে আসে একজন নির্যাতক। মানসিক এবং শারীরিক উভয় নির্যাতনে তার মতো সিদ্ধ আর কেউ হয় না!

ভাবছেন, যে পরিবারের পিতা এমন সেই পরিবারে শুধু ছেলে শিশুটিরই এমন মানসিক বৈকল্য ঘটে?

ভুলেও ভাববেন না।

এসব পরিবারের মেয়েশিশুরা আরও ভয়ঙ্কর বোধ নিয়ে বেড়ে উঠে একেকজন প্রচণ্ড ‘পুরুষালী’ নারীরূপে !
বলতে নেই , এরা হয় একেকজন বিকৃত মানুষ।
তারা একাধারে নিজেকে নির্যাতক পুরুষ থেকে রক্ষা করার পথ খুঁজতে থাকে। নিজের অধিকার বিষয়ে বাড়াবাড়ি রকমের সচেতন হয় কিন্তু একই সাথে মনে করতে থাকে ঘরে থাকা নারী নির্যাতনের যোগ্য। ভাইয়ের বউটি অথবা শ্বশুড়বাড়িতে থাকা যে কোন নারী অনুগত হতে বাধ্য।

এরা নিজের বা নারী অধিকার বলতে বোঝে শুধু সম্পত্তির অধিকার আর গায়ের জোরে কথা বলার অধিকার। এরা ভাবে ঘরের বাইরে কাজ করা বা অর্থ উপার্জনকারী নারীটিই সম্মান পাবার যোগ্য। বাকীরা গৃহী তাই স্বামীর অন্যায় আচরণ মানতে বাধ্য, কেননা তাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নেই। এরা নিজ নিজ শ্বশুরালয়ে স্বামীগৃহে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে জান লড়িয়ে দেয় অথচ কখনোই অন্য যেকোন নারী কিংবা নির্যাতিত নারীর প্রতি সদয় হয় না।
এমনকী নিজ পিতৃ পরিবারেও না।

নিজে শ্বশুরালয়ের প্রতিটি সিদ্ধান্তে নিজ মত প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠে, কিন্তু নিজ পিতৃ পরিবারে ভাইয়ের বউকে মত প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, মত দেবার যোগ্যই মনে করে না। অথবা উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করে না, কারণ তারা ভাবে নারীটি তার মতো কেউ নয় সে তাদের বাড়ির বউ !
এইরকম মানসিকতা নিয়ে ভাইয়ের বউদের তো বটেই ক্ষেত্রবিশেষে এরা পিতা কর্তৃক নির্যাতিত মায়েরও দোষ খুঁজে বের করে ফেলে!

মোদ্দা কথা পিতার নির্যাতন তাদের কাছে পরিবারের কর্তা হিসেবে একরকম ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হয়ে যায় এবং পারিবারিক শিক্ষা বা অভ্যস্ততা থেকেও ওই নির্যাতক পিতার যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে সেও নির্যাতক বা নির্যাতকের সহযোগী হয়ে উঠে ।

এইভাবে পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতার যাত্রা শুরু হয় যা আরো কিছু ধাপ পেরিয়ে হয়তো কখনো ভয়ঙ্কর গন্তব্যে পৌছে যায় ।

(চলবে)

শেয়ার করুন: