গণমাধ্যমে নারী এবং দ্য বিউটি মিথ

ইশরাত জাহান ঊর্মি:

আমার শো এর জন্য সারাক্ষণ এটা-সেটা সার্চ করি। শনিবারের অলস দুপুরে বসে বসে নাওমি উলফ এর ইন্টারভিউ দেখছিলাম। প্রথম দিককার। এখনকারও কিছু। রাইটারের ভাবনায় কিছু যুক্ত হয়েছে। পেটেও জমেছে বয়সের মেদ, কিন্তু স্বচ্ছন্দ আর সাবলীল। উলফ বলছেন,

অনেক নারীই আগের তুলনায় অনেক বেশি সম্পদ আর বৈভবের অধিকারী হয়েছে, পেয়েছে সুযোগ, মিলেছে আইনী স্বীকৃতি। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে শরীরের ব্যাপারে আমরা কী অনুভব করছি, কী আমাদের অর্জন – তাহলে দেখা যাবে যে, আমাদের শৃঙ্খলিত বা পরাধীন নানী-দাদীর চেয়েও আমাদের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।

ইদানিংকার বেশিরভাগ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পাশ্চাত্যেও আকর্ষণীয় আর সফল কর্মজীবী নারীর একটি গোপন “অপ্রকাশিত” নিয়ন্ত্রিত জীবন আছে, যা সৌন্দর্য্য-তাড়নার কারণে আমাদের স্বাধীনতাকে বিষময় করে তুলেছে। এটা হচ্ছে আসলে সেলফ পানিশমেন্ট, শারীরিক অবসেশন, বুড়িয়ে যাওয়ার ভয়, আর সেলফ কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলার মতো শিরশিরে এক ধরনের শংকা, যা দ্বারা প্রতিনিয়ত আমরা আক্রান্ত হচ্ছি…”

এইদিনই ইফতারের পরপর ইনবক্সে একটা ম্যাসেজ পেলাম। একটা প্রাইভেট টেলিভিশনে কাজ করা একটা মেয়ে লিখেছে। নিউজ প্র্রেজেন্টার। ধরে নিন তার নাম সেতু। লিখেছে যে, “আপু আমি সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের সাথে নিউজ পড়েছি, দিন নাই, রাত নাই পড়েছি। রাত একটা-দুইটার নিউজ মেয়েরা পড়তে চায় না, আমি কখনও না করি নাই। পড়েছি। ছোট ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে অফিস যা বলেছে, করেছি। এরপর আমি আবার প্রেগনেন্ট হই। স্বাভাবিক ম্যাটারনিটি লিভ থেকে ফিরে এসে আবার নিউজ পড়তে চাইলে আমাকে বলা হয়, আমি মোটা হয়ে গেছি। আমাকে আর গ্ল্যামারস লাগে না। আপু, আমি বিবিসি নিউজ দেখি, সেখানে তো মোটা, চিকন, কালো, ফর্সা কোনকিছুই নোটিশ করে না, অথচ আমার স্বাভাবিক বেবি ফ্যাট জমেছে, সেটাকে অফিস এভাবে নিচ্ছে। এই পদে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্টও দেওয়া হয় না, চুক্তিভিত্তিক নিউজ পড়ি, তাই কোন আইনী পদক্ষেপও নেওয়ার উপায় নাই।”

ম্যাসেজ এর সাথে সেতু তার নিউজ ক্লিপও পাঠিয়েছে। খুবই ঋজু টান টান, বুঝে নিউজ পড়ছে বোঝা যায়।

“দ্য বিউটি মিথ” এর সাথে আমি খুব ভালো মেলাতে পারি মেয়েটির এই ঘটনা।

কর্মক্ষেত্রে নারীর হয়রানি নিয়ে বাংলাদেশে কথাবার্তা কম হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আর দু’একটা এনজিও ছাড়া গবেষণা আর তথ্যও খুব বেশি নেই। গণমাধ্যমে কাজ করা নারীর হয়রানির ধরন একটু আলাদা ধাতের। সেসব লিখতে গেলে ইতিহাস হবে।

শুধু এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের অবিকশিত এবং ধামাধরা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের শুরুর দিকে মেয়েরা নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার জন্য যে যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতো, তা কিছুটা কমেছে। এখন একেকজনের অভিজ্ঞতাও একেক রকম। এই সিস্টেমটা এক অদ্ভুত চক্রের মতো। নারীকে দেখার গণমাধ্যমের চোখ ধীরে ধীরে সমাজের সামনে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হবে।

মজার ব্যাপার হলো আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা নারীকে স্রেফ সেক্স অবজেক্ট হিসেবে দেখে, নিউজ পড়া নামের পেশাটিকে যারা নিজেরাই মিউজিকাল চেয়ার বানিয়েছেন, দারুণ ফিগারের নারী না হলে নিউজ পড়তে দেওয়া যাবে না, তুষ্ট না করলে, নিদেনপক্ষে হেসে হেসে কথা না বললে নিউজ শিডিউল বাদ করে দেয়ার ক্ষমতাধর ‘বসদের’ অনেকেই এই জমানায় এসে দারুণ নারীবান্ধব হয়ে গেছেন। তারা সাংবাদিকতার মহান সব এথিকস এর কথা বলেন, নারী যে “ভোগ্যপণ্য” না, তার যোগ্যতাই আসল, সেই কথা বলেন, ইনফ্যাক্ট জ্ঞানী-গুণী সাংবাদিক বসেরা এইসব তথ্য ইদানিং জানছেন। এবং জেনে ভোল পাল্টেছেন।

তাও ভালো ভোল পাল্টে হোক বা যেভাবেই হোক তারা অন্তত নিজেদের যে পাল্টানো দরকার, সেইটা বুঝেছেন। কিন্তু ধন্যবাদ সেইসব সাহসী নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েকে যারা যুদ্ধ করে এই পথটা তৈরি করেছেন, সেইসব সত্যিকারের সচ্চরিত্র বসদেরও যারা আসলেই নারীকে শরীর হিসেবে দেখেন না, সাংবাদিকতা যে এন্ড অব দ্য ডে যোগ্যতার, পেশাদারিত্বের এবং এই পেশাটা অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারীরা নিচ্ছেন স্বচ্ছন্দের সাথে, পালন করছেন দায়িত্ব- সেটা যে বসেরা বুঝেছেন তাদের স্যালুট।

কিন্তু এই যে সেতু, তার মতো মেয়েরা এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানে নিজের মেধার সবটুকু দিয়েও এইরকম হ্যারাসমেন্টের শিকার হচ্ছে, তার পরিবর্তন এখনও হয়নি। অনেক সময় কম মেধার নারীরাও এর জন্য দায়ী। অনেকেই আছেন যারা সুমনের ঐ গানটার মতো, “এইখানে শিকার বুঝি বসে থাকে শিকারির খোঁজে…,” কিন্তু বাকিরা যারা কাজ করছেন শ্রম দিয়ে, ঘাম দিয়ে, তাদের সাথে যেসব প্রতিষ্ঠান এই রকম আচরণ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কারা?

এইরকম আরও কয়েকটা ঘটনা আমি বলতে পারি। আরেকটা টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত আরেক নাট্য নির্মাতা নারী ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা টেলিফোনে বলে কেঁদে ফেলেছিলেন। তাকে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করা হয়েছিল। টেলিভিশনের ভুঁইফোড় ডিরেক্টরদের একজন তাকে রক্ষিতা বানাতে চেয়েছিলেন। তো এই নারীর তাতে সম্মতি ছিল না। ব্যস, টাকা-পয়সা নিয়ে পুলিশ পর্যন্ত যেতে হচ্ছে তাকে। ভদ্র্রমহিলা কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, আপা, প্লিজ কেস-টেস যা হচ্ছে আমি করবো, আপনারা শুধু আমার পাশে থাকুন, আমি শুধু ঐ লোকটাকে বুঝাতে চাই, আমি একা নই…”

দ্য বিউটি মিথ-এ নাওমি উলফ বলছেন, নারীর এই যে জিরো ফিগার বাতিক, এই যে গায়ের রং ফর্সা করা- এইসব সৌন্দর্য্য তাড়না তাকে বেশিরভাগ সময় এক অদৃশ্য নিগড়ে বেঁধে ফেলে। স্বাধীন বলে মনে হলেও সে আসলে নিগড়ে বন্দি।

আমাদের পুরুষরচিত এবং পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে এখনও যে নারী কেবলই একটা শরীর, সেই জায়গা ভাঙতে এখনই আমাদের চিন্তা-ভাবনা এবং লড়াই শুরু করা জরুরি। অনেক কিছুই ভেঙেছে, এসবও আমরা ভাঙতে পারবো বলে আশা করি।  

শেয়ার করুন: