ঐশী সমাজের ডোরবেল, ওর পুনর্বাসন জরুরি

সুপ্রীতি ধর: 

রাজধানীর চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট এসবি কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্নার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিনই নিহত দম্পতির মেয়ে ঐশী পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে তার বাবা-মাকে নিজেই খুন করার কথা স্বীকার করেন।

ঐশীর আইনজীবী জানিয়েছেন, তারা উচ্চ আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপীল করবেন। আশা করছি, মেয়েটিকে বেকসুর খালাস দেয়ার পাশাপাশি তাকে নিয়মিত কাউন্সেলিংসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়াই যেতো, কারণ সে খুন করেছে। কিন্তু তাতে করে সমাজ থেকে অন্যায়গুলো কি মুছে যেতো? যে কারণে ঐশী তার বাবা-মাকে পর্যন্ত খুন করে ফেলেছে, সেটা তো কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক কারণ না।

পুরো ঘটনাটি আমরা যারা অনুসরণ করেছি সেই প্রথমদিন থেকে, আমরা জানি, ঐশী যা ঘটিয়েছে, তা অবশ্যই মর্মান্তিক এবং অনভিপ্রেত এক ঘটনা। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সমাজের একটি কুৎসিত রূপ বেরিয়ে এসেছে। বিশেষ করে সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অবহেলা, হঠাৎ করে প্রচুর টাকা হাতে চলে আসা অভিভাবকের এবং তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং তার প্রভাব পড়া সন্তানের ওপর, সর্বোপরি সন্তানের মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করা।

এসব বিষয়ই তখন সামনে চলে আসে আমাদের। সেদিক দিয়ে ভাবলে ঐশী আমাদের অনেকের জন্য, সমাজের জন্য ডোরবেল হিসেবেই কাজ করেছে। বিত্তবান সমাজে, তার ওপর পুলিশ কর্মকর্তার ঘরে ইয়াবার মতো মাদকের অবস্থান সমাজকে কোনদিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা ঐশী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

আমরা অনেকেই, বিশেষ করে যারা কিশোর-কিশোরীদের অভিভাবক, আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়ে ঐশীর ঘটনায়। আমরা নড়েচড়ে বসি। নিজেদের ঘরের দিকে তাকাই। সন্তানদের সময় (কোয়ালিটি টাইম) দেয়ার কথা নতুন করে ভাবি।

কাজেই অপরাধগুলো চিহ্নিত করার জন্য, সমাজের ভালোর জন্য, গবেষণার জন্য হলেও ঐশীকে বাঁচিয়ে রাখা খুবই দরকার। এই ঐশীই হতে পারে মানসিক চিকিৎসার অন্যতম নিয়ামক এবং প্রয়োজনে তাকে দিয়েই সমাজের মাদক নামের ব্যাধির মূলোৎপাটন সম্ভব, যদি রাষ্ট্র ইচ্ছুক হয় এ ব্যাপারে। যদিও রাষ্ট্র চাইবে কীনা, তা নিয়ে যথেষ্টই সংশয় আমাদের। যেখানে অন্যতম মাদক ব্যবসায়ীকে পাশে নিয়েই দেশের প্রধানমন্ত্রী মাদকবিরোধী বক্তব্য রাখেন, সেখানে আমাদের এসব আশা দুরাশা ছাড়া আর কী! উন্নত দেশ হলে এই ঐশীই হয়ে উঠতো আজ অন্যতম সংস্কারক। হতোই।

যাবজ্জীবন হওয়াতে আবার একটা আশংকা কাজ করছে যে, মেয়েটি কারাগারে থেকে না আবার কোন অপরাধে জড়িয়ে যায়। ওর যা বয়স, তাতে করে যেকোনো কিছু ঘটা অসম্ভব না। এই সেদিনই তো বিচারপতির একটা কথা পড়লাম যে, কারাগারে মেয়েদের যৌন কাজে বাধ্য করা হয়। এটা অনেক আগে থেকেই আমরা জানি, উনার কথায় বিষয়টা আরও পোক্ত হলো। ঐশী যখন আমাদের মেয়ে, তখন মা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এই বিষয়টা প্রচণ্ডভাবেই কাবু করে দেয় ভাবতে গেলে।

আশা করছি, যারা ঐশীর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন না কোনভাবে, যারা তার আত্মীয়-স্বজন, তারা বিষয়টা ভাববেন। কারাগারে ওর থাকাটা যদি কিছুটা হলেও নিরাপদ করা যায়, ততোটুকুই মঙ্গল। জানি, যে অপরাধ সে করেছে, তা ক্ষমার যোগ্য না। কিন্তু আবার যদি এটা ধরেই নেই যে, অপরাধটা ওর একার না, অপরাধটা আমাদের সবার, রাষ্ট্রের, তাহলে তো আর ঐশী ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, সে সমষ্টিতে ছড়িয়ে যায়। 

আবারও বলছি, ঐশী কিন্তু আমাদের ডোরবেল। ওর ভালো থাকা, বেঁচে থাকাটা আমাদের জন্যই জরুরি। ওর মানসিক চিকিৎসাটা নিশ্চিত করা হোক একইসাথে। ও নিজে বাঁচুক, আরও অনেক ঐশীকে বাঁচতে শেখাক। আর যে চক্র তাকে নেশার জগতে নিয়ে গেছে, সেই চক্রটা আগে ভাঙা দরকার। সেই চক্র না ভাঙলে বা কক্সবাজারে বদিদের মতো দেশের সমস্ত বদিদের উৎখাত করা না হলে এমন হাজার হাজার ঐশী তৈরি হবে, তাদের আমরা সামাল দিতে পারবো তো! ফাঁসি যদি কাউকে দিতেই হয়, তাহলে এই মাদক ব্যবসায়ীদেরই দেয়া উচিত, যারা আমাদের সন্তানদের, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।

শেয়ার করুন: