আসমা আক্তার সাথী:
আল্লাহ ভাবী, এখনও মেয়ের বিয়ে দেন নাই! কী ভাবী কোনো সমস্যা নাকি! পাত্র পছন্দ করে নাই। পরে তো সমস্যায় পড়বেন। প্রয়োজনে তদবির নেন। বেশি পড়াইলে বা মেয়েরা স্টাবলিশড হয়ে গেলে মেয়েদের জন্য ছেলে পাওয়া যায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হন নাই এমন মায়ের সংখ্যা খুবই কম।
যার ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে, সেই মা-ই আমাদের সমাজের এমন চিত্রের সাথে পরিচিত। শুধু মা নন, মেয়েও পরিচিত। যেন বিয়ে করাটাই মেয়েদের জীবনের একমাত্র মহান লক্ষ্য। তাদের আর কোনো টার্গেট নেই। কী আর বলবো!
বিংশ শতাব্দীর এই দুনিয়ায় কর্মস্থলেও মেয়েদের শুনতে হয় এমন কথা। ক্যারিয়ারে স্যাটেল করার জন্য সময় লাগে, এটা কয়জনে বোঝে? সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের মাথা ব্যথা কমানোর জন্য মেয়েদের বিয়ে করতে হয় নিজেকে বলী দিয়ে।
তা বলে আমি বিয়ে-বিদ্বেষী, তা কিন্তু নয়। তবে যে যার সুযোগ এবং সময়মতো বিয়ে করবে, ভালো লাগলে সংসার করবে, না হলে করবে না, আমার বক্তব্যটা হলো এখানেই।
বিয়েটাকে বলী বলছি এইজন্যই যে, বিয়ের পরে খুব কম মেয়েই আছে যে তার নিজের ইচ্ছেমতো জীবন-যাপন করতে পারছে। বিয়ে হচ্ছে একটি ধারালো অস্ত্র যার পরশে বিবাহিত নারীদের জীবন হয় ক্ষত-বিক্ষত। আমাদের দাদী-নানী, মা-চাচীদের আমল থেকে শুরু করে আজ অবধি চিত্র একই।
কেস স্টাডি ১: লিমার (ছদ্ম নাম) খুব ইচ্ছে ছিল সে অনেক পড়া শোনা করবে, অনেক বড় হবে। প্রশাসন লাইনে নিজের ক্যারিয়ার গড়বে। সেই পরিমাণ মেধাও ছিল তার। স্কুলে বরাবর ভাল ছাত্রী ছিল। লেখাপড়ার জন্য সে এতোটাই ব্যাকুল ছিল যে এসএসসিতে স্টার মার্কস না পাবার কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সে মানতেই পারেনি কেন তার প্রত্যাশিত রেজাল্ট হলো না। আমার কী ভীষণ কষ্ট হয়েছিল ওকে দেখতে গিয়ে যে, লিমা আমাদের চিনতেই পারছে না, আমাদের সাথে কথা বলছে না। আপন মনে তাকিয়ে আছে একদিকে। এরপরে চিকিৎসা আর বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে সে যখন সুস্থ হয়ে উঠলো, তখন এইচএসসিতে পড়তে পড়তেই বাবা-মা তার বিয়ে দিয়ে দিল প্রবাসী কাজিনের সাথে। সেও এখন প্রবাসী। অনেক ভালো আছে। টাকা-পয়সা, সোনা-দানায় আগাগোড়া মোড়া সে। কিন্তু টের পাই লেখাপড়া করতে না পারার কষ্টটা আজও লিমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
কেস স্টাডি ২ (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত): একজন আপু স্টুডেন্ট লাইফে কবিতা পড়তে খুব পছন্দ করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও খুব ভাল কবিতা লিখতেন। তাদের সময় ছিল মাসুদ রানার যুগ। মাসুদ রানার বই বুঁদ হয়ে পড়তেন। মাসুদ রানা পড়তে পড়তে সে তার মাথা নষ্ট করেছে। কিন্তু বিয়ের পরে চিত্রগুলো গেল উল্টে। কবিতা লেখা তো দূরের কথা, কবিতা পড়াও নিষেধ। মাসুদ রানা তো পড়ার প্রশ্নই উঠে না। মাসুদ রানার ছবি দেখাও নিষেধ। তার গেটআপ, তার কথা-বার্তায় চলে আসলো আমূল পরিবর্তন।
কারণ জানতে চাইলে তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি, আমি চাই এ্যাট এনি কষ্ট আমার সংসারটা টিকে থাকুক। তার স্বামী একজন জামাত কর্মী। সুতরাং তার সংসারে এসব কবিতা-টবিতার কোন জায়গা নেই। মানলে সংসার আছে, নইলে তিন কথায় সংসার শেষ। যথারীতি বাধ্য মেয়ের মতো লক্ষ্মী বউয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এক সময়ের সেই সৃজনশীল মেয়েটি। যে কিনা হতে পারতো একজন খ্যাতিমান কবি।
কেস স্টাডি ৩: ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব খারাপ লাগে যখন নারী জঙ্গীদের সবাই গালাগাল দেয়। গালাগাল তো তাকে দিতে হবে যে তাকে এই জঙ্গী হতে বাধ্য করলো। কোন নারী জঙ্গী হয়ে জন্মায়নি। পরিবার (বাবার বাড়ি) থেকেও কেউ জঙ্গী হয়ে স্বামীর বাড়ী আসে না। বরং স্বামীর বাড়িতে এসেই নারীরা জঙ্গী হয়। খাদিজা, আর্জিনা, মর্জিনা, প্রিয়তী, শীলারা কিভাবে জঙ্গী হয়েছে, আমরা সবাই জানি।
একজন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকরি করতো। স্বামীর প্ররোচণায় বাধ্য হয়ে সে জঙ্গী হয়। প্রথমে স্বামী তাকে উদ্বুদ্ধ করে হিযরত করতে এবং খেলাফতের পথে আসতে। রাজী না হওয়ায় খাদিজাকে ছেড়ে একাই হিযরতের পথে নামে স্বামী। পরে সে সংসারটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য হিযরতে যেতে রাজী হয়। স্বামীর কথায় চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দেয় খাদিজা। তারপরের পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি। আহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছিল মেয়েটি! কী বোকার স্বর্গেই না বাস করত।
আমাদের এই সমাজে স্বামীর কথার বাইরে যাবার কোন জো নেই বউদের। স্বামী যদি বলে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে আর পূর্বদিকে অস্ত যায়, তাহলে বউকেও বলতে হবে তাই। নইলে বিধিবাম।
সংসারে স্বামী-স্ত্রী দু’জন দুই মতাদর্শের অধিকারী, অথচ তাদের মধ্যে খুব প্রেম ভালবাসা বিদ্যমান, এমন নজির আমাদের সমাজে বলতে গেলে নেই। আর স্ত্রী যদি নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে তো কথাই নেই। তিন কথায় বাড়িছাড়া। আমাদের সমাজের নির্মম বাস্তবতা এটাই।
অনেক নারীই আছেন যাদের পক্ষে স্বামীর অবর্তমানে সন্তান নিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব। যেমন আমি এক দম্পতিকে চিনি। স্বামী মদ খেয়ে মাতাল হয়ে প্রায়ই বউকে পেটায়। কিন্তু তারপরও বউটি সংসার ছেড়ে যায় না। নানা বিচার সালিশের পরও সেই পোড়া সংসারে পড়ে থাকে। কারণ একটিই, পাঁচ সন্তান নিয়ে কোথায় যাবে সে? নিজে কোন অর্থ উপার্জনও করে না যে একলা পথ চলবে।
তার ওপরে একলা পথ চলতে গেলে এই সমাজে আছে আরও অনেক জটিলতা। সে প্রসঙ্গে লিখবো আর একদিন। সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইলে আত্মনির্ভরশীল হবার কোন বিকল্প নেই। সেই সাথে হতে হবে সাহসী, যাতে প্রয়োজনের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে নারী। খাদিজা হওয়ার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই।
সাংবাদিক ও শিক্ষক