চোরের মায়ের বড় গলা

কামরুন নাহার রুমা:

সেদিন একজন বলছিলেন ধর্ষণ ইস্যুটা নিয়ে সবাই লিখছে আপনি কেন লিখছেন না? আমি বলেছিলাম, সবাইকে সব নিয়ে লিখতে হবে কেন? সবাই সব বুঝবে, বা সবাইকে সব জায়গাতেই হাত দিতে হবে এমন নয়। আমি লিখিনি বলে কি লেখা থেমে আছে? লেখা থেমে নেই, তেমনি থেমে নেই ধর্ষণও।  

“জননিন্দিত চরিত্রহীন, লুইচ্চাবদমাশগুলোও যখন দেখি ধর্ষণ নিয়ে সুন্দর সুন্দর আর্টিকেল লিখছে তখন হাসতে হাসতে আমার পেট ফেটে যায়” – আমি কদিন আগে এই স্ট্যাটাসটা দিয়েছিলাম ফেসবুকে। অনেকেই আমাকে পরে বলেছেন ‘আপনি শুধু স্ট্যাটাস দিয়ে ছেড়ে দিলেন কেন লেখাটাকে আরও বড় করুন’, আমি বলেছিলাম ‘করবো’ ।  

ধর্ষণ নিয়ে যারা লিখছেন তাদের অনেকেই ভাল লিখছেন; অনেকে ওয়াজ নসিহত করছেন; কিছু বুঝে কিছু না বুঝে। অনেক লেখা পড়েছি; বেশিরভাগই যুক্তিযুক্ত, ভালো লেখা। কিছু কিছু তো যুক্তি-তর্কে-তত্ত্বে-পাণ্ডিত্যে প্রচলিত ভাষায় ‘সেই’ হয়েছে’। আর এই ‘সেই’ লেখার লেখকগণই জননিন্দিত চরিত্রহীন, লুইচ্চাবদমাশ শ্রেণীর। আর অন্য লেখকদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, হওয়াটাও স্বাভাবিক। এই মরম যাতনা একজন নারী যেভাবে অনুভব করবে, একজন পুরুষ তা করবে না।

লেখকদের নিয়ে কিছু কথা আজ বলতে চাই ।

একজন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার শরীরে হাত দেয়া, তার নামে অশ্লীল কথা বলে তাকে হয়রান করা, কাজ পাবার বিনিময়ে তাকে শুতে বাধ্য করা , নিজের যৌনস্বার্থ চরিতার্থ না হলে একজন নারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা , পদোন্নতি না দেয়া বা খাতায় নম্বর কমিয়ে দেয়া – এই বিষয়গুলোর সাথে আমি ব্যাক্তিগতভাবে ধর্ষণ এর পার্থক্য দেখিনা । দুটো ক্ষেত্রেই নারীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়, যে ক্ষতি সে মেনে নেয় ঠিকই কিন্তু পূরণ হয়না সেই ক্ষতি সারাজীবনেও।  আর এই কাজগুলো যারা অবলীলায় করেন তারাই আজ যখন ধর্ষণ নিয়ে সুন্দর সুন্দর বুলি কপচাচ্ছেন আর্টিকেলে বা টিভি টক শোতে তখন হাসি আর ভাবি আমি আমি কোন দেশে বাস করি?

যে এনজিওবাজ সেমিনারে গিয়ে নারী অধিকার নিয়ে বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলছেন তার নিজের বিরুদ্ধে একাধিক নারীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে। যে সাংবাদিক ধর্ষণ নিয়ে টকশো’র টেবিল চাপড়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তিনি তার সাথে বিছানায় যাননি বলে পাঠিকাকে প্রাইমটাইম নিউজ দেননি, বা ভাল অ্যাসাইনমেন্ট দেননি।

মানুষ গড়ার কারিগর যে শিক্ষক – মাতাল অবস্থায় প্রকাশ্য দিবালোকে তার বিরুদ্ধে ছাত্রীর গায়ে হাত দেবার অভিযোগ আছে, সেই সাথে আছে তার সাথে শোয়ার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ছাত্রীদের নম্বর কমিয়ে দেবার অভিযোগও। এই তিন শ্রেণির উদাহরণ দিলাম, কারণ ধর্ষণ নিয়ে এই তিন শ্রেণির মানুষই লিখছেন বেশি।

শিক্ষকরা তো সমাজের সবচেয়ে অসাধারণ মানুষ – কারণ তাঁরাই সবাইকে আলোর পথ দেখান। তাঁদের মনে করা হয় পরিবারের পরে সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা । অথচ এই আস্থার জায়গাটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি নড়বড়ে দেখেছি এবং দেখছি। যে কারো বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের অভিযোগ যত সহজে মেনে নেয়া যায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে সেটা মেনে নেয়া কঠিন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক বলে আমার জন্য মেনে নেয়া আরও কঠিন। অথচ এদের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন বহু অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এরা বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন , লিখছেন , টক শোতে টেবিল চাপড়াচ্ছেন, বড় বড় বাণী দিচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে কেউ কোন অ্যাকশনে যায় না।  

সাংবাদিকরা সমাজের আয়না অথচ যে আয়নাবাজি ওনারা দেখান তা ধর্ষকের ধর্ষণের কেরামতিকেও হার মানায়। কতটা অভিনব পদ্ধতিতে বড় পদের পুরুষ সাংবাদিকরা (সবাই নয়) নারীদের যৌন হয়রানি করেন  আমার পরিচিত বহু নারী সাংবাদিকের কাছে আমি সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। আমার সাথে নানান সময়ে শেয়ার করেছেন তারা সেইসব অভিজ্ঞতা। অথচ ওনারা ধর্ষণ নিয়ে বিশেষ টক শো বা গোল টেবিল বৈঠক করেন!! এনজিও বাজদের অধিকাংশ প্রকল্পইতো নারীদের ঘিরে, এরাতো সোনায় সোহাগা। নারীদের নানান কায়দায় এরা এদের শিকার বানান। এগুলো আসলে পুরনো গল্প।

নতুন গল্পটা হলো, এরা ধর্ষণ নিয়ে লেখে, ওয়াজ নসিহত করে। আর সেগুলো প্রকাশিতও হয় এবং আরও মজার বিষয় আমরা সেগুলো পড়ি । মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) নিজে চিনি খাওয়া ছেড়ে অন্যকে চিনি খাওয়া ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই গল্পটা আমাদের সবার জানা – নতুন করে বলছি না। আপনারা তথাকথিত সুশীলরা যারা ধর্ষণ নিয়ে দামী দামী আর্টিকেল লিখছেন দয়া করে আগে নিজের চরিত্র ঠিক করেন, তারপর না হয় লিখবেন! আপনাদের আর ঐ ধর্ষকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য আদতে নাই।

লেখক: কামরুন নাহার,  সহকারী অধ্যাপক, প্রেস ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ

শেয়ার করুন: