সেবিকা দেবনাথ:
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে আমরা ভালবেসে হাসু’বু বলে ডাকি। তাকে আমার যতোটা না প্রধানমন্ত্রী মনে হতো, পাশের বাড়ির মানুষ মনে হতো তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। সব ভালো লাগার ব্যাখ্যা হয়তো সবার কাছে থাকে না। আমার এই ভালো লাগার ব্যাখ্যাও আমার কাছে নেই।
আমি কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই। রাজনীতির অ-আ-ক-খ কিছুই বুঝি না। সাদামাটা চোখে যা দেখি তাই বলি। হাসু’বু যখন স্বজন হারানোর স্মৃতিচারণ করে আবেগে আপ্লুত হয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মোছেন, তখন অন্য অনেকের মতো অজান্তে আমারও চোখে জল আসে। তিনি যখন দুঃখী মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি যখন প্রাণ খুলে অন্যের গানে গলা মেলান, বাংলাদেশের খেলা হলে খেলার মাঠে গিয়ে উপস্থিত হয়ে চার-ছক্কা মারার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন, রিকশা, ভ্যানে চড়ে বেড়ানো, কিংবা সমুদ্রে পা ভেজানো দৃশ্য দেখে ভাবি, একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী এতোটা সাধারণ হতে পারে?
আর কেউ পারে কিনা জানি না, আমাদের হাসু’বু পারে। হাসু’বু যখন বলেন, তিনি নিজের জন্য না দেশের সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেন, কেন জানি না কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু গত কয়েক মাসে পরিচিত হাসু’বু কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠছেন। তখন সত্যিই খুব কষ্ট হয়।
নারী ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রবল আপত্তির পরও বিশেষ ধারা রেখে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন পাস করলেন তিনি। নারী ও মানবাধিকার কর্মীদের সম্পর্কে তিনি যে বিরুপ মন্তব্য করেছেন, তাতে কষ্ট পেয়েছি খুব। হেফাজতের সাথে যখন হাসু’বুর সখ্যতাপূর্ণ ছবি দেখেছি, আমার বিশ্বাস টলতে শুরু করলো। সাক্ষাতে হাসু’বু যখন শফি হুজুরকে হাইকোর্টের সামনে থেকে ভাষ্কর্য সরানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন, তখনও ভাবিনি এমনটা হবে। কোথায় যেন একটা বিশ্বাস ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী দল হিসেবে, দলের প্রধান হিসেবে সর্বোপরি আমাদের হাসু’বু হিসেবে, তিনি আর যাই করুন না কেন, দেশটাকে যারা আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তান বানাতে চায় তাদের সাথে তিনি কখনই আপোষ করতে পারেন না।
আমরা জানি হাসু’বু আপনি নিজে একজন ধর্মভীরু মানুষ। দেশের বড় কোনো বিপর্যয়ে দেশের ও দেশবাসীর মঙ্গল কামনায় আপনি জায়নামাজে বসে মোনাজাত করেন। রোজা রাখেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ধর্ম পালন আর ধর্মান্ধদের সাথে হাত মেলানো যে এক নয়, এটি আপনার মতো বিচক্ষণ মানুষ অবশ্যই জানে। তারপরও আপনি তাদের সাথে আপোষ করলেন।
ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এখন টের পাচ্ছি এতোদিন আমি বোকার স্বর্গে বাস করতাম। ক্ষমতা আর ভোটের রাজনীতিতে সব কিছুই বৈধ। রাজনীতিতে আসলে বিশ্বাসের কোনো জায়গা নেই। এজন্যই বোধ হয় কথায় বলে ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’।
হাসু’বু, ভোটের রাজনীতি কিংবা হেফাজতিদের মন রক্ষায় এখন না হয় সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে নারী ভাষ্কর্য সরিয়ে নিলেন। এখন আপনি হেফাজতের লাল গোলাপ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনে ভাসছেন। হেফাজত, যে সারা দেশে স্থাপিত সব ভাষ্কর্য তাদের ভাষায় অবশ্য ‘মূর্তি’ সরানোর দাবি জানিয়েছে, এর সুরাহা কী হবে? সেই প্রক্রিয়া-ই বা কবে শুরু হবে? আগামী নির্বাচনের আগে, নাকি পরের বার ক্ষমতায় গিয়ে?
আপনাকে উপদেশ দেবার ধৃষ্টতা বা জ্ঞান কোনটাই আমার নেই। তবে সাধারণ একটা প্রশ্ন, যাদের খুশি করার জন্য মধ্যরাতে ভাষ্কর্য সরানোর কাজটি করা হলো, পিতার মৃত্যুর পর আপনি যখন দেশে ফিরে এসেছিলেন তারা কি আপনার পাশে ছিলো? ভবিষ্যতে বড় কোনো বিপর্যয় ঘটলে ওরা আপনার পাশে থাকবে তো?
অভিশাপ দিচ্ছি না হাসু’বু, সাধারণ মানুষের মনে যে আঘাত আপনি দিয়েছেন এর মাশুল একদিন আপনাকে দিতেই হবে। ভাষ্কর্য সরানোর প্রতিবাদে শাহবাগে হয়তো বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ বা মিছিল হয়নি, কিন্তু সুকান্ত ভট্টাচার্যের দেশলাই কাঠি কবিতার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ক্ষুদ্র একটা দেশলাই কাঠির মধ্যেও আছে অসীম ক্ষমতা। পুরো দেশকে জ্বালিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে ওইটুকুন একটা দেশলাই কাঠি। যারা এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলো তারা এখন আপনার কাছে ভিলেনে পরিণত হয়েছে। পুলিশ তাদের উপর টিয়ারশেল, জলকামান ও লাঠিচার্জ করেছে।
কিন্তু বিশ্বাস করুন হাসু’বু, তারা সত্যিই আপনাকে ভালবাসে। আর ভালবাসে বলেই আপনার দল ক্ষমতায় থাকার সময় এমন একটা ঘটনা ঘটেছে বলেই ওদের কষ্টটা আরও বেশি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী দল বলে যে গর্ব আপনি করেন, সেই গর্ব আমরাও করি। আমি অতি নগন্য একজন মানুষ। আমার কথা আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না জানি।
তবুও একটা প্রশ্নের উত্তর খুব জানতে ইচ্ছা করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যে হাসু’বু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না, যে হাসু’বু দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে আপনি কি আর আমাদের সেই হাসু’বু নেই?