একজন খারাপ মা বলছি

হুমায়রা সুলতানা:
উম্মে ফারহানা মৌ আপুর লেখা বরাবরই কেমন মনের কথা হয়। শেষ লেখাটাও তাই। ফেসবুকে শেয়ারও দিয়েছিলাম। হুবহু টাইটেল মনে নাই, তবে মা সম্বন্ধীয় (লেবুর শরবত সমাচার)। কর্পোরেটেদের মার্কেটিং স্ট্রাটেজি – ওয়ার্কিং বনাম নন-ওয়ার্কিং মায়েদের শ্রেষ্ঠত্ব।
আমি ওয়ার্কিং মা। প্রায়ই শুনি- “আপনার কাজের কি দরকার? আপনারা শখ মিটাতে/ স্টাইল করতে কাজ করেন”। “ভাইয়া তো ভালো স্যালারি পায়। জব করার দরকার কি? বাচ্চাদের সময় দেন”।
অথবা, “বাচ্চাদের সময় দাও। চাকরি করতে বেশি ইচ্ছা হলে আশেপাশে কোন স্কুলে চাকরি নাও”।
প্রথমত, স্কুলের চাকরি কি এতোই ফেলনা? এই রকম মানসিকতার জন্যই আজকে আমাদের আলি গলির স্কুলগুলোর এই দৈন্যদশা।
দ্বিতীয়ত, ভাইয়া ভালো জব করে বলে আমার জব করা যাবেনা কথাটার যৌক্তিকতা কি? আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হাড় মজাইয়া পড়ালেখা করি নাই ভালো ভাইয়া (জামাই) পাবার আশায়। এখনো যে আরেকটা মাস্টার্স করছি সেটাও বিবাহ এগ্রিমেন্ট পোক্ত/ রিনিও করার জন্য না। আমার নিজের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা আছে। আমি নিজে একজন মানুষ, সেই পরিচয় সবার আগে। তারপর অন্য কারো বৌ।
তাহলে মা হইতে গেলা কেন?
মা হইতে গেলাম কেন এইটাও আপনার/ আপনাদের দেখার বিষয় কবে থেকে হলো? যতোদিন মা হই নাই, ততোদিন তো এই আপনাদের প্রশ্ন, চিন্তা আর প্রেস্ক্রিপশনের জ্বালায় আমার গায়ে ফোসকা পড়ছিল যতো, তাঁর চেয়ে আপনাদের দিনের ঘুম হারাম আর মাথার চুল পরে যাচ্ছিল বেশি। বাচ্চা নিতে দেরি করবার কারণে যতো উহু আহা ছিল, কাল মেয়েদের নিয়ে যদি আমার একা জীবন যুদ্ধে নামতে হয় তখন ততোই তফাৎ যাও পলিসি এই আপনারাই নিবেন। সো নিজের চরকায় তেল দিন।
যারা স্টাইল করে জব করেন নাই এবং এখন তাদের বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, তারা কিন্তু ভিন্ন বলেন- জবটা ছেড়ো না। কষ্ট হবে, কিন্তু কন্টিনিউ কর। বাচ্চারা বড় হয়ে যাবে, তখন নিজের পরিচয় খুঁজে পাবে না। আমার মতো ভুল করো না। পরে আর শুরু করা যায় না। এই কথাও শুনি।
(তাই বলে কেউ যে একেবারেই পারে না, তাও বলছি না)।
সকালে যখন ওদের ছেড়ে আসি, তখন আমারো খারাপ লাগে। জ্বরের দিনগুলোতে যেমন লাগে, ঝড়ের দিনগুলোতেও লাগে। আমার বন্ধু মহলের একজনই খুব শুনিয়ে বলেছিল একবার- “তোর বাসায় বুয়া রান্না করে? আমার জীবন আমার সংসার। আমার জীবন স্বার্থক যখন ওদেরকে ওদের প্রিয় খাবার রান্না করে দেই।“ মানে আমি চাকরি করি বলে আমি ভালো মা নই। কারণ আমি ওদের জন্য তিন বেলা রান্না করিনা, কারণ জ্বর হলেও আমি ওদের রেখে ভবঘুরের মত অফিস যাই, কারণ আমি স্কুলের সামনে বসে থাকিনা, কারণ আমি ভর্তি ফরম নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে পারি না, কারণ আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট টাকা কামানো বাচ্চাদের চেয়ে (!?), কারণ আমি মা হবার চেয়ে প্রফেশনাল আইডেনটিটি নিয়ে বেশি কন্সেন্ট্রেশন দেই, কারণ আমি ভাবীসুলভ আলোচনা, বন্ধুমহলের গসিপে সময় দিতে পারি না।
আমার রাত আর সকালের মাঝে পার্থক্য ৪-৪.৩০ ঘণ্টার। আমি দুপুরে বাচ্চাদের বুকে নিয়ে ঘুমাই না, সন্ধ্যায় বাচ্চাদের পড়ানোর পাশাপাশি কাহানী ঘর ঘর কি দেখি না।
একবার ইউনিভার্সিটির সিনিয়র জুনিয়ররা মিলে একটা কিছু করবার তাগিদে কতগুলো মিটিং এটেন্ড করতে হলো। সবগুলোতেই করলাম। আমি মোদ্দা আলোচনা সেরেই দৌড়ে বাড়ি ফিরি। যত দ্রুত বাচ্চাদের কাছে যাওয়া যায়। কাজগুলোও সময় মতো দিচ্ছি। শেষ একটা মিটিং এর পর আর যাইনি। এক সিনিয়র বড় ভাই বললেন- “মিটিং শেষ না করেই চলে যাওয়া ব্যাড প্র্যাক্টিস। তুমি সবসময় এমন করো”।
আমি অফিস করে, মিটিং এটেন্ড করি, বাড়িতে বাচ্চা রেখে, এবং এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করি। ডিপার্টমেন্ট এর অন্য বিবাহিত/অববাহিতদের ছাত্রীদের মতো বিবাহজনিত বা অফিসজনিত কারণ দর্শাইয়া মিটিং এটেন্ড করি নাই বা কাজ করি নাই, তা-ও না। শুধু মোদ্দা কথা, সেরে বেরিয়ে যাই বলে কথাটা শুনতে হবে-মেনে নিতে পারি নাই।
আচ্ছা, ফিরে আসি আবার। আমি হাউজওয়াইফ বা এক্সক্লুসিভলি মা নই বলেই সংসার আমাকে বাবুর্চি, ডাক্তার, সুইপার, ধোপা, গৃহশিক্ষক তদুপরি গৃহপরিচারিকা সেই সাথে গ্রৃহপরিচালিকার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে সেইটা কে বলল আপনাকে? আমি সব মেইন্টেন করতে পারি আপনি পারেন না, বা আপনি পারেন আমি পারি না, তাতে মাতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব-পরাজয়ের দ্বন্দ্ব কোত্থেকে আসে? সময় থাকলে, পায়খানা জিলাপীর মতো পেঁচিয়ে ত্যাগ করা যায়। আফসোস আপনার ওই গুণ আছে, আমার বা আমাদের মতো যারা কর্মী / কর্মজীবী মা, তাদের ওই সময়টা নাই। যা আছে তা দিয়ে আর যাই হোক, কাজ আর সংসারের বাইরের কিছু নিয়ে ক্রিয়েটিভ হওয়া যাচ্ছে না। সরি বস।
জ্বর নিয়ে সারাদিন আপনি কাজ করেন, ছুটি নাই। আমরাও করি। কারণ ঐ ছুটিগুলো জমিয়ে রাখি ভেবে যদি কোনো কারণে বাবুর জন্য ছুটি নিতে হয়! বাইরে কাজ করি বলেই অবাধ স্বাধীনতা, যাচ্ছে তাই করতে পারি ভেবে বেহুশ হবার দরকার নাই। আমরা চরকির মতোই দৌড়াই।
মাতৃত্ব মাতৃত্বই! এখানে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই নাই। পেট কেটে বের করলেও যা, পেট না কেটে বের করলেও তা। পেট কাটার জন্য বা না কাটার জন্য ভালোবাসার তারতম্য হয় বলে আমার মনে হয় না। হোম মেকার হোন বা চাকরিজীবী হোন, মা তো মা-ই। আর আপনি-আমি এমন কোনো সমাজে থাকি না যে কর্মজীবী বলেই জেন্ডার সাম্য, সমান অধিকার/ নানাবিধ সাংসারিক কাজ থেকে মুক্তিও পেয়ে গেছি। সংসার –অফিস কোনটাই কোনটার চেয়ে কম না। কর্মজীবী মায়েদের সংসার আর চুলা সেই সাথে সমাজকে ম্যানেজ করতে হয়। এই যে বললাম- এখনি আবার বলবেন- তো করার দরকার কী! দরকারটা মানুষ হিসেবে পরিচয়ের, দরকারটা কারো ছায়ার নিচে না বেঁচে নিজের একটা ছায়া তৈরি করা যেখানে আরামে থাকবে আপনার প্রিয় মানুষ।
মা হবার আগে মানুষ হোন- মেয়ে মানুষ না। মানুষ হলেই ‘মান’ ও ‘হুশ’ থাকবে। ওই দুইটা থাকলেই পার্সোনাল ও পাবলিক ইস্যুর ফারাক বুঝবেন। ঐ দুইটা থাকলেই মুখ খুলবেন বুঝে, তর্কের খাতিরে না। ওই দুইটা থাকলেই- ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী থাকবে’। ভালো থাকুন।

শেয়ার করুন: