তাসলিমা শাম্মী:
আমাদের বাড়ির পিছনের বাড়ির এক চাচাকে কুকুর কামড়ে ছিল, চাচার বয়স তখন ষোল বা সতের হবে, আমি তখন অনেক ছোট, ভালো মতো সবকিছু মনে পড়ে না। শুধু এতোটুকুই মনে পড়ে দাদা দাদু আর আমার মায়ের অনেক পছন্দের ছেলে ছিল সেই চাচা। অনেক ভাল পাতার বাঁশি বাজাতে আর বিভিন্ন প্রাণীর আওয়াজ নকল করে সবাইকে মুগধ করতে পারতো চাচা। উনার গল্প মা আর দাদুর মুখে বড় হবার পরও অনেক অনেক বার শুনেছি।
সেই দুরন্ত, প্রাণবন্ত ছেলেটিকে একটা পাগলা কুকুর কামড়েছিল। নাভির পাশে শুনেছিলাম চৌদ্দটির মতো ইঞ্জেকশন দিয়েছিল। অনেকদিন ভয়াবহ কষ্টের পর মারা গিয়েছিল চাচা। সন্ধ্যার পর আমাদেরকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে মা আর দাদু পিছনের পাড়ায় গিয়ে চাচাকে দেখে আসতেন।
আমি আর আমার ছোট বোন দাদুর সাথেই ঘুমাতাম, দাদু সেই রাতে খেতে পারতেন না, ঘুমাতে পারতেন না। পরের কয় দিন খালি চাচাটার কষ্টের কথা বর্ণনা করতেন। শেষের দিনগুলোতে উনাকে পানি দেয়া হতো না। তেষ্টায় ছটফট করতো, কিন্তু পানি দেখলেই নাকি ভয়ে চিৎকার করতো। চাচার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি আল্লাহ তায়ালার কাছে।
পরে শুনেছি যেই কুকুরটা চাচাকে কামড় দিয়েছিল সেই কুকুরটাকে দাদার লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়ে দাদা নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল। দাদা বলেছিলেন অন্তত একটা পাগলা কুকুর তো কমলো। এরপর হয়তো আরো অনেক কুকুর আরো অনেককেই কামড়েছিল, কেউ সুস্থ হয়েছিল, কেউ হয় নাই, কিন্তু তালিব চাচার ঘটনা মানুষের মনে এতোটাই প্রভাব পড়েছিল যে, ছোট বড় সবাই বাইরে কুকুর দেখলেই ভয় পেতাম। স্কুলে না যাওয়ার বাহানা খুঁজতাম।
দাদু বলতেন স্কুলের দরকার নাই, বেঁচে থাকলে লেখাপড়া, আর দাদা ধমক দিয়ে বলতেন, কুকুরের ভয়ে মানুষ ঘরে বসে থাকবে? সবকিছুই চলবে, কিন্তু সাবধানে, কিছু ট্রিক্স শিখিয়ে দেয়া হতো তখন কুকুর দেখলে কিভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে আসতে হবে। আর সরকারিভাবে পাগলা কুকুর নিধন শুরু হয়েছিল এলাকাতে, যে যেদিকে পারতো পাগলা বা ভাল কুকুর দেখলেই মেরে ফেলতো।
সবার আগে আশরাফুল মাখলুকাত, মানুষের জীবন আগে। মানুষের নিরাপত্তার জন্য, রোগ না ছড়ানোর জন্য কত কত আল্লাহর সৃষ্ট জীব আমরা বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলি! সেই আধুনিকতার ছোঁয়াহীন গ্রামে কুকুরের ভয়ে কিন্তু মানুষ হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারতো না। সারা গায়ে কালো কাপড় জড়িয়ে দিনে আর রাতে ঘরের কাজে বের হতে হতো না। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে যখন কুকুর পাগল হতো, তখন গ্রামের স্বেচ্ছাসেবক দল পিটিয়ে সেসব পাগলা কুকুরদের মেরে ফেলত।
আজকে আমরা অনেক আধুনিক, ডিজিটাল দেশের হাইক্লাস সোসাইটি থেকে শুরু করে পাড়াগাঁর টং দোকান অবধি এক আংগুলের ছোঁয়ায় আমরা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের ব্রেকিং নিউজ মুহূর্তেই পেয়ে যাই। আমরা দেশের যেকোনো ঘটনার বিচারের রায় নিজেরাই দিয়ে দিই। কে শতে নব্বই ভাগ, আর কে দশ ভাগ দোষ করেছে, সেই মতামত দেবার অধিকার আছে বলে দাবি করি।
জানোয়ারদের নিষ্পাপ আর মানুষকে দোষি সাব্যস্ত করার মতো আধুনিক আমরা অবশ্যি হয়েই গেছি, এখন শুধু চারপেয়ে সেসব অবোধ প্রাণীদের রেহাই দিয়ে দুপেয়ে জানোয়ার, যাদের কোনো নির্দিষ্ট সময় বা সুযোগ লাগে না নরম নারীদেহ পেলেই যারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, সে যেকেউ হোক, যেকোনো বয়সেরই হোক না কেন, তাদের দানব নামকরণ করা বাকি।
সবশেষে ক্লান্ত হয়ে একটা কথাই বলতে চাই, আসলেই ক্লান্ত লাগছে। সত্যি আজকে আমরা মানুষ হিসেবে অনেক বেশি এবং একটা মেয়ের মা হিসেবে আরো বেশি ক্লান্ত তার বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার চিন্তা করতে করতে। কেন মা হলাম? আক্ষেপ হয় মাঝে মাঝে। পুত্র হলে ধর্ষক আর কন্যা হলে ধর্ষণের শিকার যদি হয়, এই ভয় নিয়ে আর যাই হোক, শান্তিমতো ঘুম আসে না।