মোহছেনা ঝর্ণা:
মেয়েটির নাম বলতে চাচ্ছি না। ক, খ, গ, ঘ, যদু, মদু, রাম, সাম, শিশির, বৃষ্টি, মেঘ, নদী যা ইচ্ছা ধরে নিতে পারেন আপনারা। মেয়েটি বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড় ছিল। কিন্তু সম্পর্কটা আমাদের বন্ধুর পর্যায়েই ছিল। সম্বোধনটা ‘তুমি’তেই ছিল। ছিল লিখছি, কারণ তার সাথে অনেকদিন ধরে আমার যোগাযোগ নেই। অথচ একটা সময় নিয়মিত যোগাযোগ হতো।
দেখতে খুব স্মার্ট ছিল। চোখগুলো বড় বড়। কপালে সব সময় একটা টিপ থাকতো। কথায় ছিল আদিবাসি কিংবা উপজাতির টান। ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়ালেখা করেছে। আদিবাসী কন্যা। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ না টাংগাইল কোথায় যেন ছিল ঠিক মনে করতে পারছি না। পরিচয়টা রূপবিশেষজ্ঞ। একটা বিউটি পার্লার ছিল তার।
ময়মনসিংহ কিংবা টাংগাইল এর মেয়ে ঢাকা থেকে পড়ালেখা শেষ করে চট্টগ্রামে কেন ব্যবসা করছে জিজ্ঞেস করতেই প্রথম দিকে লাজুক হাসি দিয়ে বলতো, তোমাদেরকে ভালোবাসি তাই। তারপর কিছুদিন আসা যাওয়া করতে করতে পরিচয়টা আরেকটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর জানালো, এক মুসলিম ছেলেকে ভালোবেসে তার হাত ধরেই চট্টগ্রামে আগমন। সবাই জানে তারা বিবাহিত। কিন্তু বিয়ে আদৌ হয়নি। ছেলেটি আজ না কাল বলে বলে কাটিয়ে দিল পাঁচটি বছর।
বিয়ে না করলে কী করবে এই নিয়ে যখন অল্পবিস্তর মনোমালিন্য হতে লাগলো, তখন ছেলে বন্ধুটি তাকে ব্যবসার পুঁজি দিল। ঢাকায় থাকতেই খুব শখ করে নিজের টাকা দিয়েই পার্লারের কাজ শিখেছিল। সেই বিদ্যাটা এ জীবনে খুব কাজে লাগলো। ছেলে বন্ধুটা বিয়ের পরিবর্তে একটা পার্লার খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করলো। মোটামুটি অল্প সময়ে নিজের প্রচণ্ড পরিশ্রমী মানসিকতার কারণে পার্লারটাকে এক রকম দাঁড় করিয়েই ফেললো। কিছুদিন পর নিজেদের এলাকার তিন-চারটি মেয়েকে এনে কাজ শেখালো। নিজের পার্লারে কাজ দিলো।
খুব সুখী সুখী চেহারা নিয়ে মেয়েটি হাসতো, পার্লারের কাজ করতো, প্রতিদিন নতুন নতুন বউ সাজাতো। যত্ন করে কাজল লাগাতো চোখে, আলপনা আঁকতো হাতে। অনেক চটপটে ছিল। খুব সহজে আপন হয়ে উঠতো। প্রায় কাস্টমারদের সাথেই দেখতাম খুব আন্তরিক সম্পর্ক। দেখতে ভালোই লাগতো। সেই সুখী সুখী চেহারার আড়ালে যে এতো যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল তা তো কেউ জানতো না!
একদিন এক বউ সাজানোর সময় আমি গিয়ে উপস্থিত। আমি আগ্রহ করে বউয়ের সাজ দেখছিলাম বলে বউয়ের কপালে কুমকুমের টিপ দিতে দিতে বললো, যদি তোমার বিয়ের সময় আমি থাকি নিজ হাতে তোমাকে খুব সুন্দর করে বউ সাজিয়ে দিব।
আমি বললাম, যদি কেন বলছো? কোথাও চলে যাবে নাকি?
চাপা একটা হাসি দিয়ে বললো, আরে নাহ! মানুষের তো কোনো বিশ্বাস নাই, কখন কী হয়ে যায়, তাই বললাম আর কী!
মনে হচ্ছিল ওর কন্ঠটা খুব ভারী হয়ে আছে। বউ সাজানো শেষে পার্লারের কাস্টমার একটু কমে আসতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, জীবনটা খুব কষ্টের বুঝছো। চলো একটু হেঁটে আসি বলে আমাকে নিয়ে বাইরের খোলা রাস্তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, আসলে সত্যি কথা বলতে কী, আমি যার সঙ্গে থাকি, আমরা একসঙ্গে থাকলেও আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়নি এই কষ্টটা তো আছেই, আমার আরো কিছু কষ্ট আছে। আমার পার্লারে যে মেয়েগুলো কাজ করে, আমার বন্ধু নামক সঙ্গীটি এখন আমার চোখের আড়ালে তাদের নিয়ে মত্ত থাকে। কয়েকদিন হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। তখন বলে, মেয়েগুলোই নাকি ওকে ডিস্টার্ব করে আমি বাসায় না থাকলে। আর তাই দু’দিন পরপর আমি পার্লারের মেয়ে বদলাই। চরিত্রহীন সংগী থাকার যে কী যন্ত্রণা তা কাউকে বোঝানো যায় না। গত কয়েকদিন ধরে কি হয়েছে জানো, নতুন যে মেয়েটা এসেছে তার সংগেও একই কাজ। গতকাল আমার সাথে খুব ঝামেলা হয়েছে। সে নাকি এখন এই মেয়েকে বিয়ে করবে।
আমি বললাম, এই মেয়ে তোমাদের সম্পর্কের কথা জানে না?
খুব ক্লান্ত কন্ঠে বলল, আসলে আমরা এতো অভাব আর দারিদ্র নিয়ে বড় হয়েছি যে কেউ একটু সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখালেই বোকার মতো তা বিশ্বাস করে ফেলি। এই মেয়েটারও একই দশা হয়েছে। তারপর আবার বললো, আমি অবশ্য এত সহজে ছেড়ে দিব না। এই পার্লারটা ছাড়া নিজের বলতে আর কিছুই নেই আমার। কত কষ্ট করেছি। কত পরিশ্রম করেছি। আর এখন যখন পার্লারটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে তখনই শুরু হয়েছে নতুন তালবাহানা। জানো আমার ব্যবসার টাকাগুলো পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে যায়।
তারপর আবার দু’তিমাস পরে একদিন পার্লারে গিয়ে দেখি মেয়েটি নেই। অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, বেড়াতে গেছে। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারলো না। তার মোবাইলে ফোন দিলাম। দেখলাম মোবাইল বন্ধ। এরপর মাসখানেক পর একদিন আবার পার্লারে গিয়ে দেখি সে পার্লারে বসে আছে। আমাকে দেখে বসা থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো। আমারও এত খুশি লাগছিল। অনেকক্ষণ গল্প করে বলল, চলো একটু বাইরে হেঁটে আসি। বাইরে আসার পর বললো, ওখানে অন্য মেয়েরা আছে তো তাই কথা বলতে পারছিলাম না। আমি হেরে গেছি। বদমাইশটা বিয়ে করেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, পার্লারের মেয়েটাকে?
বললো, আরে ধূর, যাদেরকে মিষ্টি কথা বললেই পাওয়া যায় তাদেরকে বিয়ে করার আদিখ্যেতা করতে হয় না। বাবা- মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছে। একটা কথা মনে রাখবা, ছেলেদের মিষ্টি কথায় ভুলবা না। বোকার মতো কাউকে বিশ্বাস করবা না। কষ্টি পাথরে মানুষ যাচাই করে তারপর কাউকে পথ চলার সংগী বানাবে।
চুপ করে থাকি আমি। তারপর এক সময় দেখি হু হু করে কেঁদে উঠে বলে, একটা জীবন এতো বঞ্চনার হয় কেন বলতো? আর তো সহ্য করতে পারি না।
সান্ত্বনার জন্য তেমন কিছুই বলতে পারিনি। শুধু মন খারাপের বেদনায় একাত্ম হয়ে ছিলাম।
সেই ছিল তার সাথে আমার শেষ দেখা। এরপর একদিন পার্লারে গিয়ে দেখি পার্লারের নামটা বদলে গেছে। ভেতরে ঢুকে দেখি নতুন কিছু মুখ। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ সেরে চলে এসেছি। তার কথা জিজ্ঞেস করিনি। এরপর আর কোনোদিন তার সাথে দেখা হয়নি। কথা হয়নি। কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না। বেঁচে আছে না মরে গেছে, তাও জানি না।
গত কয়েকদিন ফেসবুকে বড় বড় মানুষদের প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতার কথা পড়তে পড়তে সেই মেয়েটির কথা আমার খুব মনে পড়ছিল। ভালোবাসার নামে প্রেমিকের প্রতারণার কাছে হার মেনে কোথায় যে লুকিয়ে গেল!! বিশ্বাস কেমন ঠুনকো হয়ে গেল ভণ্ডদের মুখোশের আড়ালে!! পথ চলতে গিয়ে নতুন কোনো সংগী পেল কিনা কে জানে! আহ! যেখানেই থাকুক, যেন ভালো থাকে।